রাজবাড়ীর গোয়ালন্দ উপজেলার পদ্মাপাড় কছিমদ্দিন পাড়ার ছেলে মো. হুমায়ুন কবীর। বাবা ফেরি করে পান-সিগারেট ও অন্যান্য জিনিস বিক্রি করে সংসার চালাতেন। ২০০০ সালে তাঁর বাবা ছোট্ট একটা মুদির দোকান দেন। সেই দোকানে সকাল বিকেল বসতে হতো হুমায়নকে। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় হওয়ার পরিবারের দায়িত্বও বেশি ছিল। কিন্তু পড়াশোনার প্রতি ছিল অদম্য ইচ্ছা। মনোযোগ দিয়ে করতেনও সেটা। এভাবে ২০০৯ সালে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ অর্জন করেন। তাঁর এই অভাবনীয় ফলাফলে প্রথম আলোয় সংবাদ প্রকাশ হয়। দেওয়া হয় ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি। বৃত্তির সহায়তা কলেজ পর্যায়ে পড়াশোনা করেন তিনি। পরে ২০১১-১২ সেশনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগে ভর্তি হন। বর্তমানে মো. হুমায়ুন কবীর গোয়ালন্দ উপজেলার বেতকা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত।
পদ্মা পাড়ের ছিলেটির আজকের এই জায়গায় পৌঁছানোর গল্প শোনাতে অতিথি হয়ে এসেছিলেন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’অনুষ্ঠানে। তাঁর কাছ থেকেই। গত ১২ জুন ২০২৪, বুধবার বিকেল ৫টায় প্রথম আলো ট্রাস্টের এ অনুষ্ঠানের আলোকে তুলে ধরছি বিস্তারিত।
নিজের মনে একটা শক্ত দরজা থাকতে হবে। যেখানে ভালোটা আটকে মন্দকে ছেড়ে দিতে হবে— অদম্য মেধাবী হুমায়ুন কবীর।
বাবার সঙ্গে সংসারে দায়িত্ব পালন করা হুমায়ুন তাঁর ছোটবেলার গল্প বলেতে গিয়ে বলেন, ‘ধন্যবাদ প্রথম আলোকে আমার পাশে থাকার জন্য। যে সময়টাতে পথ খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন প্রথম আলোকে পাশে পাই। রাজবাড়ীতে পদ্মাপাড়ে আমাদের বাড়ি ছিল। পদ্মার ভাঙনে সব বিলীন হয়ে যায়। ১৪-১৫ বার নদী ভাঙন হয়। এখনো আমার কর্মস্থল পদ্মার তীরেই। শিক্ষক হিসেবে স্কুলের বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করি কার কি সমস্যা। শিক্ষার্থীদের কথা শুনে বুঝি—তারাও অনেক প্রতিকূলতা পাড় করে আসা। তাদের বলি—এগুলো মোকাবিলা করতে হবে। চেষ্টা করতে হবে নিজেকে গড়ার।’
পরক্ষণে যুক্ত করে বলেন, ‘আমার বাবার বয়স যখন ১২ বছর তখন দাদা মারা যায়। তখন বাবা আর চাচা পরিবারের হাল ধরেন। তখন প্রায় ১২ বছর অন্যের বাড়িতে আশ্রিত ছিল। পরে ৪ শতাংশ জমি কিনে থাকার ব্যবস্থা হয় আমাদের। বাবাই মূলত পরিবারের হাল ধরেন। বিভিন্ন মেলায় ফেরি করতেন। পরে একটা দোকান দেন। বেশি বিক্রি হতো না। হাট বাজারে গিয়ে বিক্রি করতেন। ওই সময়টাতে আমার মনে একটা বিষয় কাজ করছে সেটা হলো—পড়াশোনা ছাড়া কিছু করা সম্ভব না। তাই মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতাম। সব সময় একটা ভালো মানুষ হতে চেয়েছি। এখনো চেষ্টা আছে। সকালে দোকানে বসতাম। আবার স্কুল থেকে এসেও দোকানে বসতাম। শৈশবে একটা কিশোর যেভাবে খেলাধুলা করে কাটায়, আমি তা পারিনি।’
হুমায়ুন জানালেন, ‘এমনও সময় গেছে আমাদের… কখনো সকালে রান্না হয়নি। প্রতিবেশীর বাসায় গিয়ে নাশতা করে স্কুলে গেছি। স্কুল থেকে এসেও দেখি রান্না হয়নি। মা বলেছে বাবা বাজার করতে পারেনি।’
এলাকায় মাঝেমধ্যেই চুরি হতো বলে দোকানে থাকতে হতো হুমায়নকে। তিনি বলেন, ‘চোর হয়তো জানে না এই দোকানের মালিকও দিনে একবার খেতে পায়। আমি যখন দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ি, তখন থেকেই দোকানে থাকি। কলেজ পর্যন্ত বাবার সঙ্গে দোকানে থেকেছি।’
এখন আপনি সফল হয়েছেন। বাবা-মা কি বলেন, নিজের অনুভূতি কি? উত্তরে বলেন, খুব ভালো অনুভূতি তাঁদের। মা খুব খুশি। সে জন্য কয়েকটা ব্যাংকে চাকরি হলেও শিক্ষকতাকে বেছে নিয়েছি। প্রতিদিনই আমার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করি। শিক্ষক হওয়ার পর মনে হয় এই বাচ্চাগুলো আমার—আমি ওদের সঙ্গে মিশে থাকি। আমি প্রত্যাশা করি, অনেক ভালো মানুষ উপহার দিতে পারব। এদিকে আব্বাও অনেক খুশি। পরিবারের সবার সঙ্গে গল্পগুলো শেয়ার করি। তাঁরা অনেক খুশি হয়।’
যেকোনো কাজে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে আফসোস থাকে না। পরিশ্রম করে হারলেও জিতব, আর জিতলে তো জিতলামই— অদম্য মেধাবী হুমায়ুন কবীর।
আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই ভালো, মন্দ বিষয়গুলো থাকে। মন্দ সময়টা কীভাবে মোকাবিলা করব? এ ব্যাপারে হুমায়ুন বলেন, ‘প্রথম আলো গোয়ালন্দ প্রতিনিধিকে ধন্যবাদ। তিনি আমাকে খুঁজে বের করেছেন। আসলে নিজের কথা বলতে গেলে কোনো প্রস্তুতি লাগে না। নিজের কথাগুলো হৃদয়ে গেছে থাকে। নিজের মনে একটা শক্ত দরজা থাকতে হবে। যেখানে ভালোটা আটকে মন্দকে ছেড়ে দিতে হবে। তা ছাড়া জীবন কিন্তু থেমে থাকে না। শেষ হবে একদিন। যেকোনো কাজে চেষ্টা করে ব্যর্থ হলে আফসোস থাকে না। পরিশ্রম করে হারলেও জিতব, আর জিতলে তো জিতলামই। বিপদ আসলে মনোবল ভাঙা যাবে না, আরও শক্তি সঞ্চার করে এগোতে হবে। পরিশ্রম আছে বলেই ফলটা অনেক ভালো লাগে।’
প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন এই অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।