ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি
প্রতিকূলতা জয় করে বিসিএসে সফল অদম্য আওলাদ
সুনামগঞ্জের ধরমপাশা উপজেলার পাইকুরাটি ইউনিয়নের আলীপুর গ্রামের বাসিন্দা মেধাবী শিক্ষার্থী আওলাদ হোসেন। দারিদ্র্যের সঙ্গে যুদ্ধ করে আওলাদ হোসেনের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। এক সময় পারিবারিক অভাব এতটাই প্রকট ছিল যে, রাতে কেরোসিনে তেল ফুরিয়ে লেখাপড়া করতে গিয়ে হিমশিম খেতে হতো। ফলে তাঁকে দিনের আলোতেই বেশির ভাগ সময় ধরে লেখাপড়া করতে হয়েছে। সেই আওলাদ এখন পুরোদস্তুর চিকিৎসক। সেবা দিচ্ছেন তাঁর গ্রামসহ আশপাশের মানুষদের। এরই মাঝে খবর এলো আওলাদ হোসেন ৪২ তম বিশেষ বিসিএসে (স্বাস্থ্য) সহকারী সার্জন হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।
অদম্য মেধাবী ডা. আওলাদ হোসেন সাহস নিয়ে প্রতিকূলতা অতিক্রম করেছেন এবং সফলও হয়েছেন। তাঁর এই সফলতার গল্প ওঠে আসে ১০ অক্টোবর ২০২১, বিকেল ৪টা ৩০মিনিটে প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদম্য মেধাবীর সঙ্গে’ অনলাইন অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানটি একযোগে প্রচার করা হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ইউটিউব চ্যানেল এবং প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক পেজ থেকে। সঞ্চালনায় ছিলেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।
আওলাদ শুরু করেন তাঁর জীবনের গল্প দিয়ে। প্রথমেই বলেন, ‘সবার জীবনেই কিছু গল্প থাকে। আমারও আছে। আমার বাবা কৃষক, মা গৃহিনী। দরিদ্র পরিবার। কৃষি কাজ করে সংসার সংসার চলত না। অভাব-অনটনের সংসারে পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াই কঠিন ছিল। দারিদ্র্যতার কারণে আমার বড় পড়াশোনা করতে পারেনি। ২০১০ সালে আমি এসএসসিতে জিপিএ-৫ পাওয়ার পর প্রথম আলোর প্রতিনিধি আমাদের বাড়িতে আসেন, ছবি তোলে নেন। পরে আমারে এই সাফল্য নিয়ে প্রথম আলোয় ‘কুপিতে তেল ছিল না, আওলাদ পড়েছে দিনের আলোয়’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। আমার মেধা, পরিবারের অবস্থা দেখে পাশে দাঁড়ায় প্রথম আলো ট্রাস্ট। শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয় ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী তহবিল থেকে। পরে আমাকে আর লেখাপড়ার খরচ চালাতে পিছু তাকাতে হয়নি।’
প্রথমে ভাবছিলাম, আমাকে শহরে বা ভালো কোনো কলেজে পড়ার সুযোগ হবে না। এদিকে এলাকার কলেজে থেকে সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার অফার পেলাম। কিন্তু ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি আমার মনোবলকে আরও অদম্য করে দেয়। আমি ভর্তি হই ময়মনসিংহে মিন্টু কলেজে। এর পর থেকে ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্টের কাছে আমি ঋণি। একই সঙ্গে কৃতজ্ঞ। কারণ প্রত্যেকটা মানুষকে উপরে উঠলে হলে কিছু কিছু সহায়তা, টাকার প্রয়োজন হয়। আমার ক্ষেত্রে প্রথম আলো ট্রাস্ট সেই দায়িত্ব পালন করেছে। কথাগুলো বললেন আওলাদ হোসেন।
আপনি ৪২ তম বিশেষ বিসিএসে (স্বাস্থ্য) সহকারী সার্জন হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। এটা খুবই খুশির খবর আমাদের জন্য। এখন কি করছেন জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘২০১০ সালে যখন ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট শিক্ষাবৃত্তি পাই তখন আমাদের ঢাকায় নিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেই অনুষ্ঠানে ‘ডেইলি স্টার’এর একজন সাংবাদিক আমার সাক্ষাৎকার নেন। তিনি জানতে চেয়েছিলেন, আমি কি হতে চাই। তখন আমি বলেছিলাম, আমি ডাক্তার হয়ে মানুষের করতে চাই। সেই আশা পূরণ হয়েছে। আমি ২০১৯ সালে কিশোরগঞ্জের শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস শেষ করে গ্রামে গিয়ে প্রতিদিন চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাচ্ছি।’
গ্রামের মানুষ কীভাবে দেখে চিকিৎসক আওলাদ হোসেনকে জানতে চাইলে জানান, ‘এলাকার সবাই আমাকে অনেক ভালোবাসে। তাঁরা তো জানেন, গরিবের সন্তান। দারিদ্র্য ও অভাব অনটনের মধ্যদিয়ে বড় হয়েছি। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম। যখন মেডিকেলে চান্স পেলাম তখন এই ভালোবাসা আরও বেড়ে যায়। এলাকার ছেলে চিকিৎসক হবে এটাও তাদের গর্বের বিষয় হয়ে ওঠে।
মা-বাবা কি স্বপ্ন দেখে ছেলেকে নিয়ে? এর উত্তরে আওলাদ জানান, ‘বাবা-মা অনেক খুশি আমাকে নিয়ে। তারাঁ চান আমি যেন নিজ এলাকার পাশাপাশি সারা বাংলাদের মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিতে পারি।’
পরিবারে অন্যান্য সদস্যদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে আওলাদ জানালেন, ‘বড় ভাই দারিদ্র্যের কারণে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত যেতে পেরেছেন। এখন বাড়িতে থেকে কৃষি কাজ করেন। ছোট ভাই সিলেটে এমসি কলেজে অর্থনীতিতে ফাইনাল ইয়ারে আছে। আর ছোট বোন ডিগ্রি প্রথম বর্ষে পড়ছে।’
আমাদের অন্যান্য অদম্যদের জন্য আওলাদের পরামর্শ কি জানতে চাইলে জানান, ‘আসলে সবার জন্য পরামর্শ হলো- নিজের সিদ্ধান্ত নিজেকে নিতে হবে। সমাজের অনেকই নানা কথা বলবে, পিছু টানবে। এগুলোতে কান না দিয়ে নিজের জন্য যেটা ভালো সেটা করতে হবে। দেখা যায় যে, বড় লোকের ছেলে বড় মোবাইল, বড় গাড়ি, ভালো জামাকাপড় পড়ছে। তখন একটা ডিপ্রেশন আসে। প্রায় সবার ক্ষেত্রেই এটা আসে। সে ক্ষেত্রে এগুলো অতিক্রম করার মনোবল থাকতে হবে। আমি যখন মিন্টু কলেজে পড়ি তখন একটি ও একটি প্যান্ট দিয়ে পুরো কলেজজীবন শেষ করেছি। আমার কখনো খারাপ লাগে নি। মনে হয়নি আমার এটা নেই, ওটা নেই। সুতরাং নিজের সাহস নিজেকেই জুটাতে হবে। এসএসসির পর অনেকেই স্পিরিট হারিয়ে ফেলে। জিপিএ-৫ পাওয়ার কারণে মনে একটা ভাব চলে আসে। এটা করা যাবে না। এইচএসসিতেও ভালো করতে হবে, জিপিএ-৫ পাওয়া লক্ষ্যে এগোতে হবে। দিন শেষে কথা হলো, পড়াশোনার বিকল্প নাই। সুতরাং নিজেকে ভালো অবস্থানে নিতে হলে মনোবল, কঠোর পরিশ্রম ও সৎ সাহসের বিকল্প নেই।’
ব্যক্তি আওলাদ কি স্বপ্ন দেখে? এর জবাবে তিনি বলেন, ‘বিসিএসে সৃপারিশকৃত হলাম। দুই বছর পর পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ডিগ্রি যেমন এফসিপিএস, এমডি, এমএস-এ পড়াশোনা করে আমার সেবার মান উন্নত করব। এর পাশাপাশি ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট নিয়ে আরেকটা বড় স্বপ্ন আছে আমার। সেটা হলো, ব্র্যাক ব্যাংক-প্রথম আলো ট্রাস্ট যেভাবে আমার পাশে থেকে সহযোগিতা করেছে, আমি তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আমার মতো যারা অদম্য মেধাবীরা আছে তাদের পাশে দাঁড়াব, সহযোগিতার হাত বাড়াব। ধন্যবাদ আপনাদের সবাইকে।’