লক্ষ্যে পৌঁছাতে হাল ছাড়েননি সোমা

অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থী সোমা গোস্বামী

অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থী সোমা গোস্বামী পড়ছেন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে। সোমার বাবা পেশার চা-বাগান শ্রমিক। তখনো সোমার ছোট ভাইয়ের জন্ম হয়নি। আশপাশের লোকেরা যখন সোমার বাবাকে বলতেন, তুমি মারা গেলে তো তোমার মুখে আগুন দেবার জন্য ছেলে সন্তানও নেই। তখন সোমার বাবা বলতেন আমার তিন মেয়েরাই আমার মুখে আগুন দেবে। বাবার এই শক্ত মানসিকতাই মূলত সোমাকে মানসিকভাবে শক্ত করে তুলেছে সেই ছোটবেলা থেকে।

চা বাগানের মধ্যে যে উচ্চ বিদ্যালয় বিদ্যালয় ছিল সেখানেই বেশির ভাগ চা শ্রমিকের সন্তানেরা ভর্তি হতো, কিন্তু সোমার বাবার ইচ্ছা ছিল তাঁর মেয়ে শহরে গিয়ে পড়াশোনা করবে, যেন চা বাগানের গণ্ডির বাইরে গিয়ে সকলের সঙ্গে মিশে ভালো কিছু শিখতে পারে। তিনি এটাও জানতেন, যে শহরের স্কুলে গেলে যাওয়া আসার ভাড়া দিতে হবে, টিফিনের টাকা দিতে হবে আর এর বাইরে পড়াশোনার আলাদা খরচ তো আছেই। তখন সবাই বলেছিল, শহরের স্কুলের খরচ পোষানো তাদের পক্ষে সম্ভব না, মেয়েকে বরং এলাকার স্কুলেই দাও। কিন্তু বাবা কারও কথাই শোনেন নি। তিনি কষ্ট করে হলেও বড় মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে গেছেন সোমা। সহপাঠীদের কাছ থেকেও অনেক সহায়তা পেয়েছেন। অষ্টম শ্রেণিতে বৃত্তি পাওয়ার পর সে একটু দ্বিধায় পরেগেলেন বিজ্ঞান নিয়ে পড়বেন না বাণিজ্য নিয়ে পড়বেন। অনেকেই বাণিজ্য নিয়ে পড়তে বলেছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিজ্ঞান বিভাগেই পড়ার সিদ্ধান্ত নিলেন সোমা। সেখানেও পাশে ছিলেন তাঁর পরিবার। তাঁরা বলেছেন, কষ্ট করে হলেও সোমার পড়াশোনার টাকার ব্যবস্থা তাঁরা করবেন। সোমার কাজ কেবল মন দিয়ে পড়াশোনা করা।

জীবনে বাঁধার তো শেষ নেই। সোমা বলেন, ' বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার জন্য যেই পরিমাণ টাকার দরকার গাইড, বই, মডেল বই, ক্যালকুলেটরের জন্য তা আমার ছিল না। আমি যখন আমাদের শিক্ষককে জানালাম যে আমার পক্ষে গাইড বা বই বা কোচিং করা সম্ভব না। তখন আমার শিক্ষকেরা আমাকে সহায়তা করেন। আমি সেখানে বিনা মূল্যে পড়ার সুযোগ পাই। আমার এক বান্ধবী আমাকে গাইড দিয়ে সহায়তা করেছেন। ওরা যার কাছে প্রাইভেট পড়ত, আমি তাদের কাছে একেবারেই স্বল্পমূল্যে প্রাইভেট পড়েছি। এভাবেই আমি এসএসসি পাস করি।'

উচ্চমাধ্যমিকে সুজা মেমোরিয়াল কলেজে কলেজে যখন ভর্তি হলেন সেইখানে উপবৃত্তির তালিকায় সোমার নাম আসেনাই। যার অর্থ কলেজে পড়তে গেলে সোমাকে বেতন দিয়ে পড়তে হবে। আর বেতন দিয়ে কলেজে পড়া তাঁর পক্ষে সম্ভব ছিল না। পরবর্তীতে একজন সাংবাদিক তাঁর কলেজের বেতন দিয়ে তাঁকে পড়তে সহায়তা করেন । এসএসসির পর থেকেই নিজে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনিও শুরু করেন সোমা।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সময়ও হাল ছাড়েন নি তিনি। প্রথম বার ভাইভা ভালো না হওয়ায় সুযোগ পাননি। আবার প্রস্তুতি নেন দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দেওয়ার জন্য। কিন্তু দ্বিতীয়বারেও ভর্তি হতে পারেননি। এটা তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না। একটা জেদ চেপে বসে তাঁর। কেউকে না বলে তৃতীয়বারের মতো পরীক্ষা দেওয়ার প্রস্তুতি নেন। শেষবারের চেষ্টায় সোমা সুযোগ পান এশিয়ান ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির। একই সঙ্গে পেয়ে যান আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তিও। হার না মানা এই অদ্বিতীয়াকে জানাই অভিবাদন।