চা বাগান শ্রমিক পরিবারের বড় মেয়ে বন্যা উরাং। বাবা-মা ও দুই ভাই-বোনের সংসারে তখনো অভাব বা জীবনের বাস্তবতা বোঝেননি বন্যা, যত দিন না তাঁর তৃতীয় বোনের জন্ম হলো। তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত সব সময় ক্লাসে প্রথম হওয়া বন্যার কাছে আসলো ছোট বোনের দেখভাল করার দায়িত্ব। ভালো ফলাফল থেকে একটু একটু করে দূরে যেতে লাগল বন্যা। তবে জীবনের বাস্তবতা আর কষ্ট বলতে যা বুঝায়, তা বুঝতে পারেন যখন ছোট বোন এলো সংসারে। চার চারটা ছেলেমেয়ের জন্য খানিকটা হিসেব করে চলতে শুরু করল বন্যার বাবা-মা। ছোট দুই বোনদের দেখভাল-পড়াশোনা সামলে বেশ ভালো ফলাফল নিয়েই পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ হন বন্যা। অভাব অনটন কাকে বলে ধীরে ধীরে বুঝতে শুরু করলেও পড়াশোনা বন্ধ করেনি । নবম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার সময় বন্যার বাবা, অনেকটা জোর করেই বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি করান। মানবিক বিভাগের প্রতি আগ্রহী বন্যা অনেকটা অনিচ্ছাতেই পড়তে থাকেন। এসএসসিতে ফলাফল তেমন ভালো হলো না। উচ্চমাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার সময় মানবিক বিভাগ নিতে চাইলেন। এইবারেও বন্যার বাবা তাঁকে বোঝান যে, এত দিন বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়াশোনা করে উচ্চমাধ্যমিকে মানবিক নিলে পরবর্তীতে সে ভালো কিছু করতে পারবে না। আর অন্যদিকে বন্যার বাবার বিশ্বাস ভালো শিক্ষার্থী যারা, তারাই বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করে।
পরিবারের আর্থিক অসংগতি, বাড়ির কাজ, ছোট বোনদের দেখভাল করা, বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করাটাও অনেক ব্যয়বহুল। এই এতসব কিছু সামলে নেওয়ার জন্য বন্যা টিউশনি করানো শুরু করেন। হঠাৎ করেই একদিন বন্যার বাবা কাজ করতে গিয়ে কোমরে ব্যথা পান। কোনো কাজ করতে পারতেন না তিনি। ঠিকমতো বেশিক্ষণ দাঁড়াতে পারতেন না। সেই সময়ে বাড়ির গরু, ছাগলের জন্য ঘাস কাটা থেকে শুরু করে ঘরের কাজ সব সামলে পড়তে হয়েছে বন্যাকে। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে পরিবারের সঙ্গে সঙ্গে এইবার জীবনের বাস্তবতাও বুঝতে শুরু করল বন্যা। এক সময় তাঁর মনে হলো প্রতিরক্ষা বাহিনীতে ভর্তি হতে পারলে মনে হয় সে তাঁর পরিবারকে নিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে পারবেন। উচ্চমাধ্যমিক দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্রী বন্যা সেনাবাহিনী, পুলিশ এবং বিজিবিতে ভর্তি পরীক্ষা দেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য প্রতিটি বাহিনীতেই একদম শেষ নির্বাচনী পরীক্ষায় তিনি বাদ হয়ে যান।
উচ্চমাধ্যমিকে পড়া বন্যা ভাবতে শুরু করেন সংসার কীভাবে চলবে, ভাই বোনদের কি হবে, তাঁর নিজের পড়াশোনার কি হবে? ওদের ভবিষ্যৎ কি? উপবৃত্তির টাকা দিয়ে না হয় এত দিন পড়লেন। কিন্তু এর পরে কি হবে? কষ্ট, দুশ্চিন্তা, হতাশা সবকিছু নিয়ে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত বন্যা একদিন কলেজে ক্লাস চলাকালীন সময়ে প্যানিক অ্যাটাকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন। একবার ভেবেছিলেন ওই বছরে আর পরীক্ষা দেবেন না। আবার ভাবলেন ওই বছরে পরীক্ষা না দিলে একটা বছর নষ্ট হবে। শত দুশ্চিন্তা, হতাশা চেপে রেখে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। সবকিছু মিলিয়ে উচ্চমাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগ নেওয়ার সিদ্ধান্তটা যে ভুল ছিল, সেটা প্রমাণ হলো ফলাফল প্রকাশের পর। পদার্থবিজ্ঞানে বন্যা অকৃতকার্য হলেন। আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব সকলে উপহাস করতে শুরু করল। পরবর্তী পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নেন বন্যা। এইবার বন্যা পাস করে শ্রীমঙ্গল সরকারি কলেজে বাংলায় স্নাতকে ভর্তি হলেন।
একদিন শ্রীমঙ্গলে যাওয়ার পথে বাসে কলেজের বান্ধবী সূচনার সঙ্গে দেখা হয় বন্যার, যিনি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে (এইউডব্লিউ) শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করছে। বন্যার কাছে সব কথা শুনে সুচনাই ওকে বলে এইউডব্লিউতে ভর্তি পরীক্ষা দিতে। যিনি চা বাগানের মেয়েদের উচ্চশিক্ষার বিষয়ে সহায়তা করে থাকেন, তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করার সুযোগও করে দেয়। সেদিন বাসায় ফিরে এসে বন্যা তাঁকে ফোন করে বিস্তারিত জেনে নিয়ে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ভর্তি পরীক্ষা দেন। কিন্তু পরীক্ষা যতটা ভালো হবে বলে ভেবেছিলেন, ততটা ভালো হয়নি। মনে মনে বন্যা পরের বছরে আবার এইউডব্লিউতে ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। প্রচণ্ড এক বৃষ্টির দিনে বন্যা লেবু বাগানের চা বাগানে গেছেন বাড়ির গরুর জন্য ঘাস কাটতে। ফিরে এসে দেখেন যার সহায়তায় পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন করেছিলেন তিনি ফোন দিয়েছেন। ফোন দিয়েই তিনি বলেন, ‘বন্যা, বাবাকে বলো আগামী ৫ বছর আর তোমাকে বিয়ে দেওয়ার চিন্তাও যেন না করেন। তুমি এইউডব্লিউতে ভর্তির সুযোগ পেয়ে গেছো। কি যে আনন্দের দিন ছিল সেই দিনটা বলে বুঝাতে পারব না।’
এরপরের গল্পটা একেবারে ঝড়ের পরের পরিষ্কার আকাশের মত ঝকঝকে। বন্যা এখন চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের 'অদ্বিতীয়া' শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করছেন। শিক্ষাবৃত্তির জন্য যেই টাকাটা পান সেটা দিয়ে নিজের খরচের পাশাপাশি মাঝে মাঝে ছোট ভাইকেও সাহায্য করতে পারছেন। কম্পিউটার সায়েন্স নিয়ে স্নাতক শেষ করে, যদি সুযোগ পান তবে স্নাতকের পরে দেশের বাইরে গিয়ে স্নাতকোত্তর শেষ করতে চান বন্যা। এইউডব্লিউ থেকে যা শিখবেন, তাই যেন ছেলে- মেয়ে নির্বিশেষে সবাইকে শেখাতে পারেন, সেই স্বপ্ন নিয়েই পড়াশোনা শেষ করে শিক্ষক হয়ে পরিবার তথা সমাজের পাশে দাঁড়াতে চান অদ্বিতীয়া বন্যা উরাং।