‘চোখে যার অদম্য স্বপ্ন, তাঁকে আটকানো কঠিন’

২০১২ সালে অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্ত সিনথিয়া খন্দকার ঊর্মি ।

সিনথিয়া খন্দকার ঊর্মি, ২০১১ সালে এইচএসসি পাস করেন। কিন্তু স্নাতকে কোথায় ভর্তি হবেন তা নিয়ে ছিলেন দ্বিধায়। কারণ সিনথিয়ার পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি তাঁর বাবা, যিনি পেশায় একজন টেইলর মাস্টার। সিনথিয়ার স্বপ্ন বড় হলেও বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। তবে সিনথিয়া একটু অন্যরকম স্বপ্ন দেখত। সে চাইতো বাইরের জগৎটাকে দেখতে। বাস্তবতা যাই হোক না কেন, চেষ্টা করতে তো দোষ নেই! সিনথিয়া পত্রিকার পাতায়, ইন্টারনেটের দুনিয়ায়, বিভিন্ন দূতাবাসে নিজে গিয়ে খোঁজ নিতেন দেশে বা দেশের বাইরে বৃত্তি নিয়ে কোথাও পড়ার সুযোগ আছে কিনা। খুঁজতে খুজতেই প্রথম আলোর পাতায় একদিন হঠাৎ চোখে পড়ে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে (এইউডব্লিউ) ভর্তির বিজ্ঞাপন। ইউনিভার্সিটির ওয়েবসাইটে গিয়ে জানতে পারেন বিস্তারিত। জানলেন যে এইখানে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ আছে। কিন্তু পরীক্ষা দিতে হবে। নিজেকে তৈরি করলেন সেই পরীক্ষার জন্য। এইউডব্লিউ যেন একদম সিনথিয়ার পছন্দের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বিদেশি সিলেবাসে পড়াশোনা, মেয়েদের জন্য একটি বিশেষায়িত বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বের প্রায় ১৯টি দেশের শিক্ষার্থীরা এখানে পড়াশোনা করেন। প্রতিষ্ঠানের ৫৫% বিদেশি শিক্ষকদের মধ্যে প্রায় ১০টি দেশের শিক্ষকেরা আছেন। কিন্তু মনের মধ্যে দুশ্চিন্তার সুঁইটা খচখচ করেই যাচ্ছে। যদি বৃত্তি না পান, তাহলে কি হবে? পরিবারের সেই সামর্থ্য নেই যে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন, কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর খরচ জোগাতে পারবে।

এরই মধ্যে একদিন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ফোন করে জানালেন যে এইউডব্লিউ-প্রথম আলো 'ফার্স্ট ফিমেল ইন দ্য ফ্যামিলি শিক্ষাবৃত্তি' নিয়ে সিনথিয়া তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছেন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানো পরিবারের প্রথম নারী, যারা আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে উচ্চশিক্ষা অর্জন করতে পারছে না, তাদের অনুপ্রাণিত করার জন্য দেওয়া হয় এই শিক্ষাবৃত্তি। ২০১২ সাল থেকে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এবং প্রথম আলো ফার্স্ট ফিমেল ইন দা ফ্যামিলি স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড নামে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান শুরু করে।

২০১২ সালে অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্ত সিনথিয়া খন্দকার ঊর্মি।

প্রতিবছর পরিবারের প্রথম নারী অথচ অসচ্ছল, যিনি উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজ গঠনে আগ্রহী, এ রকম ১০ জনকে ট্রান্সকম গ্রুপের সহায়তায় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এ শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া শুরু করে। ট্রান্সকমের সহায়তায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪২ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন। ২০১৭ সাল থেকে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড এই শিক্ষাবৃত্তির দায়িত্ব নেয়। নামকরণ করা হয়েছে অদ্বিতীয়া। আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সহায়তায় ৪৬ জনসহ এ পর্যন্ত মোট ৮৮ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনও তাঁদের আবাসন, টিউশন ফি সুবিধাসহ নানা সুযোগ দেয়।

২০১২ সালে সিনথিয়া এই শিক্ষাবৃত্তি পান। শিক্ষাবৃত্তিসহ পড়ার সুযোগ পাওয়ার আনন্দে সেদিন মাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিলেন সিনথিয়া। চোখে একরাশ স্বপ্ন নিয়ে ঘরের গণ্ডি থেকে বের হলেন সিনথিয়া। ঢাকা থেকে এলেন চট্টগ্রাম। চলতে থাকল পড়াশোনা। ২০১৩ সালে জানতে পারেন এইউডাব্লিউর সাথে ফ্রান্সের ইন্সটিটিউট অব পলিটিক্যাল সাইন্সের একটি চুক্তি সাক্ষর হয়েছে। সেই চুক্তি অনুযায়ী প্রতি বছর দুজন শিক্ষার্থী প্যারিসে গিয়ে এক বছর পড়াশোনা করতে পারবে। সিনথিয়া এইবারও যুদ্ধে নামেন। প্যারিসে গিয়ে পড়াশোনা করার যুদ্ধ। কারণ তাঁর ব্যাচে ৮৯ জন শিক্ষার্থী আছে। এদের মধ্য থেকে কেবলমাত্র দুজনই এই সুযোগ পাবেন। চোখে যার অদম্য স্বপ্ন, তাঁকে আটকানো কঠিন। ধাপে ধাপে পরীক্ষা দিয়ে অবশেষে সেই কাঙ্ক্ষিত দুজনের তালিকায় নিজের নাম নিশ্চিত করেন সিনথিয়া।

২০১৬ সালে প্রথম প্যারিসে যান এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামের অংশ হিসেবে। পড়াশোনা করতে করতে স্বপ্ন দেখতে শুরু করলেন, যদি পড়াশোনার বাকিটা সময় ফ্রান্সেই পড়ার সুযোগ পাওয়া যেত। কিন্তু এইখানে বাদ সাধল ভাষা। ফ্রান্সে যাওয়ার আগে ভেবেছিলেন, হয়তো ইংরেজিতে কথা বলে কাজকর্ম চালিয়ে নিতে পারবেন। কিন্তু একদম প্রথম দিন বুঝে গিয়েছিলেন, ফ্রান্সে থাকতে হলে তাকে সেই দেশের ভাষা শিখতেই হবে। শুধু মাত্র ক্লাসে যেই ভাষা শেখায় তা কি যথেষ্ট হবে সিনথিয়ার স্বপ্ন পূরণের জন্য? চিন্তায় পরে গেলেন সিনথিয়া। ভিনদেশে গিয়েও সিনথিয়া খুঁজতে থাকেন নিজেকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথ। পড়াশোনার পাশাপাশি একটি চাকরি করতে শুরু করেন তিনি। দায়িত্ব হলো তিন বছরের এক ফরাসি বাচ্চাকে ইংরেজি শেখাতে হবে। হাতে যেন চাঁদ পেলেন। ফরাসি বাচ্চাকে ইংরেজি শেখালেন আর নিজে শিখলেন ফরাসি ভাষা। এক বছর এই কাজ করে যে তাঁর উপকার ছাড়া ক্ষতি কিছু হয়নি, তা এখন তিনি বুঝতে পারছেন। প্যারিসে থাকাকালীন সময়েই মাস্টার্সের জন্য আবেদন করতে থাকেন তিনি বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। এইবারও ভাগ্যদেবী সদয় হলেন। আবারও সম্পূর্ণ শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে মাস্টার্স পড়ার সুযোগ পেলেন তিনি।

পড়াশোনা শেষ করে প্যারিসের দ্য ইউনিয়ন অব বিজনেস ইনকিউবেটরস নামক প্রতিষ্ঠানে বিজনেস ডেভেলপমেন্ট অফিসার হিসেবে কাজ করছেন। এই প্রতিষ্ঠানটি তরুণদের নিয়ে কাজ করে। বিজনেস অফিসার হিসেবে বিভিন্ন দাতা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তাকে যোগাযোগ রাখতে হয়। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নীতিনির্ধারকদের সঙ্গেও যোগাযোগের কাজটা সিনথিয়াকেই করতে হয়। বোঝাই যাচ্ছে, এই যে ফ্রান্সে পড়াশোনা করার জন্য, ভাষা শেখার জন্য যে কষ্ট সিনথিয়া করেছেন তা বৃথা যায়নি। এইউডব্লিউতে পড়ার সুযোগ যখন তিনি পেয়েছিলেন, তখন অনেকেই বলেছিলেন রাজনীতি নিয়ে পড়াশোনা করে কি হবে? জীবনে কি করবে? একইভাবে দেশের বাইরে যখন পড়াশোনা করার সুযোগ পান, তখনো অনেকেই বলেছিলেন, একা মেয়ে দেশের বাইরে গিয়ে কীভাবে থাকবে? কি করবে? কে দেখে রাখবে? নানাজনের নানা কথা শুনেও দমে যাননি সিনথিয়া। সবাইকে দেখিয়েছেন যে, মনে সাহস থাকলে আর চেষ্টা করলে জীবনের সকল চড়াই উৎরাই পার হয়ে স্বপ্ন পূরণ করা যায়। সিনথিয়ার কাছে জানতে চেয়েছিলাম সফল হওয়ার বা স্বপ্ন পূরণের মূলমন্ত্র কি? হেসে তিনি বলেন, 'কখনো নিজের ওপর আস্থা হারানো যাবে না। সব বাঁধা-বিপত্তিতে সাহস রাখতে হবে। কৃতজ্ঞ থাকতে হবে। বড় হয়ে যেন অতীত না ভুলে যাই, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।'

অতীত ভুলেন নি সিনথিয়া। সুযোগ পেলে দেশে ফিরে এসে তরুন এবং নারীদের নিয়ে কাজ করতে চান সিনথিয়া। তিনি বিশ্বাস করেন একসঙ্গে কাজ করলে যেকোনো স্বপ্ন পূরণ করা সম্ভব। সিনথিয়ারা জানেন বাঁধা আসবে আর তা পেরিয়ে যেতে হবে। এভাবেই বাঁধা পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া সকল অদ্বিতীয়াদের আমাদের অভিবাদন!