প্রথম আলো ট্রাস্টের অনলাইন আয়োজন ‘অদ্বিতীয়ার গল্প'
‘আমার গ্রাম আমাকে এখন রোল মডেল হিসেবে নেয়’
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার তালুক-কানুপুর ইউনিয়নের প্রত্যন্ত একটি গ্রাম নোদাপুর। এই গ্রামের নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে মোছা. শাপলা খাতুন। এই গ্রামের বেশির ভাগ মেয়েদের অল্প বয়সে বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়। শাপলার জীবনেও তা হানা দিয়েছিল। তিনি যখন সপ্তম শ্রেণিতে পড়েন তখন তাঁকে বিয়ে দেওয়ার জন্য চাপ আসে। কিন্তু তাঁর পড়াশোনার অদম্য ইচ্ছা ও মায়ের সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হয়নি তাঁকে। শত বাধা পেরিয়ে অদম্য ইচ্ছা নিয়ে পড়াশোনা করে স্নাতক (সম্মান) শেষ করেন তিনি। সেই শাপলা এখন কাজ করছেন ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবীইং বাংলাদেশ নামক প্রতিষ্ঠানে সোশ্যাল মিডিয়া অ্যান্ড ইকোনমিক কনসালট্যান্ট হিসেবে।
শাপলা আক্তার ২০১৬ সালে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (এইউডব্লিউ) এবং প্রথম আলো ‘ফার্স্ট ফিমেল ইন দ্য ফ্যামিলি স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ পান। শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে অর্থনীতিতে স্নাতক শেষ করেন চট্টগ্রামে অবস্থিত এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন থেকে। শাপলা জানালেন, ‘তিনি তাঁর গ্রামের প্রথম গ্র্যাজুয়েট সম্পন্নকারী নারী।’ তাঁর পরিবার তথা গ্রামের প্রথম গ্র্যাজুয়েট হওয়া ও বর্তমান পরিস্থিতির যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো ‘অদ্বিতীয়ার গল্প’ নামক অনলাইন অনুষ্ঠানে। ২৭ জানুয়ারি ২০২২ (বৃহস্পতিবার), বিকেল ৪টা ৩০মিনিটে প্রথম আলো ট্রাস্ট এই অনলাইন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
গাইবান্ধার প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শাপলার উঠে আসার গল্প জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘ছোট থেকেই পড়াশোনার ঝোঁক ছিল। ছাত্রীও ভালো ছিলাম। শিক্ষকেরা অনেক সহায়তা করেছেন। পরে প্রাথমিকে জেনারেল গ্রেডে বৃত্তি পাই। স্কুল প্রতিষ্ঠার পর আমিই প্রথম বৃত্তি পাই। ফলে আমাকে অনেকে অন্যভাবে দেখা শুরু করে। একই ভাবে জেএসসিতে জেনারেল গ্রেডে বৃত্তি পাই। এই বৃত্তির টাকা ও টিউশনির টাকা দিয়ে পড়াশোনা চলতে থাকে। এভাবে মাধ্যমিক পরীক্ষায় গোল্ডেন জিপিএ-৫ পাই। আমি আরও নতুন করে সাহস সঞ্চার করি। কিন্তু ভালো একটা কলেজে কীভাবে পড়ব, তা নিয়ে শঙ্কায় পড়ে যাই।একলা একটা মেয়ে বাড়ির বাইরে গিয়ে কীভাবে পড়ব! খরচই বা কে দেবে? এত কিছুর মধ্যেও সাহস নিয়ে উপজেলায় গিয়ে ভর্তি হলাম। শুরু হলো নতুন যুদ্ধ। ক্লাস ও প্রাইভেটের ফাঁকে যেটুকু সময় পাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে টিউশনি করি। পরে একজনের পরামর্শে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের শিক্ষাবৃত্তির জন্য আবেদন করি। পরে সেটা পেয়েও যাই । আমার পথ আরেকটু সুগম হয়। এই বৃত্তির টাকা ও টিউশনির টাকা দিয়ে নিজের খরচ ও বাড়িতে বাবা-মাকে কিছু পাঠাই। কারণ, বাবার জমাজমি তেমন নেই। আবার অসুস্থ ছিলেন তিনি। তাই বড় সন্তান হিসেবে আমাকেই দায়িত্ব নিতে হয়। এভাবেই প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে উচ্চমাধ্যমিকে জিপিএ-৪.৭৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হই।’
উচ্চমাধ্যমিক তো উত্তীর্ণ হলা, এখন কি করব? সেই একই টেনশন। আমার গ্রামে এমন কেউ নেই যে পরামর্শ নেব। তারপর গ্রামীণ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা আমাকে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) কথা জানান।আমার মা প্রায় ১৫ বছর ধরে গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য হওয়ায় এই সুযোগটা পাই। তারপর ওই কর্মকর্তার পরামর্শ মতে আবেদন করি। পরীক্ষায় পাস করি, ভাইভায় উত্তীর্ণ হই। পরে পূর্ণ বৃত্তি নিয়ে ভর্তি হওয়ার সুযোগ পাই। ভর্তির সময় অদ্বিতীয়া বৃত্তির জন্য আবেদন করে রাখি। কিছুদিন পর জানাতে পারি, আমাকে অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তির জন্য নির্বাচন করা হয়েছে। এই বৃত্তিটা আমার শিক্ষা সরঞ্জাম ও ব্যক্তিগত বিভিন্ন খরচ মেটাতে দারুণভাবে সহযোগিতা করেছে। আমি তাঁদের কাছে কৃতজ্ঞ।’
এইউডব্লিউ'তে এসে নিজেকে কীভাবে খাপ-খাওয়ালেন জানাতে চাইলে শাপলা বলেন, ‘আসলে আমরা যারা বাংলা মিডিয়াম থেকে আসা তাদের একটু সমস্যা হয় প্রথম দিকে। তবে কঠোর পরিশ্রম করে তা আয়ত্ত করে নিয়ছি। এইউডব্লিউতে একটা বিষয় হলো-প্রথম বছর আমাদের ফাউন্ডেশন কোর্স করতে হয়েছে। যার মাধ্যমে টিচারদের সঙ্গে ক্লোজ ইন্টারেক্ট করেছি, আমাদের বিভিন্ন গ্রুপ ওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করেছি। অনেক সাপোর্ট পেয়েছি শিক্ষকদের কাছ থেকে। সবচেয়ে বেশি শিখেছি..লিডারশীপ কীভাবে গ্রো করতে হয়, টিম ম্যানেজমেন্ট কীভাবে করতে হয় ইত্যাদি। এগুলোর মাধ্যমে ট্রেইনড হয়েছি, লিডারশিপ স্কিল তৈরি করেছি। তা ছাড়া ১৯টি দেশের মেয়েদের সঙ্গে সব সময় কমিউনিকেশন করা, থাকা, খাওয়া, গ্রুপ ওয়ার্ক করার কারণে অনেক স্কিল ডেভেলপ করেছি। এটা চাকরি ক্ষেত্রে অনেক কাজে দিচ্ছে।’
বাবা-মার অনুভূতি কি শাপলাকে নিয়ে? এর উত্তরে তিনি জানান, ‘আমার বাবা-মা এখন অনেক গর্বিত আমাকে নিয়ে। শুধু ছেলেরা নয়, মেয়েরাও পরিবারের অনেক সাপোর্ট করতে পারে-এই মতাদর্শ তাদের তৈরি হয়েছে। তখন খুব ভালো লাগে আমার।’
বর্তমানে যারা পড়ছে এবং নতুন অদ্বিতীয়াদের জন্য পরামর্শ কি হবে জানতে চাইলে শাপলা বলেন, ‘ বলার বিষয় একটাই, যে উদ্দেশ্যে আমরা এখনে এসেছি সেটা যেন সফল হয়। আমার বাবা-মা যেমন বিশ্বাস করেছে যে- শুধু ছেলেরা নয়, মেয়েদের ওপর নির্ভর করা যায়। তাই বলব,নিজের স্বপ্ন পূরণে চেষ্টা থাকতে হবে, নিজের পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে তৈরি করতে হবে। আমাকে যেমন আমার সমাজে এখন রোল মডেল হিসেবে নেয়। আমার গ্রামের অনেকেই এখন আমার মতো হতে চায়। এটা আমার অনেক বড় পাওয়া।’
উল্লেখ্য, নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ২০১২ সাল থেকে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এবং প্রথম আলো ‘ফার্স্ট ফিমেল ইন দা ফ্যামিলি স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ নামে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান শুরু করে। প্রতিবছর পরিবারের প্রথম নারী অথচ অসচ্ছল, যিনি উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজ গঠনে আগ্রহী, এ রকম ১০ জনকে ট্রান্সকম গ্রুপের সহায়তায় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে এ শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া শুরু করে প্রথম আলো ট্রাস্ট। ট্রান্সকমের সহায়তায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪২ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন।
২০১৭ সাল থেকে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড এই শিক্ষাবৃত্তির দায়িত্ব নেয়। নতুনভাবে নামকরণ করা হয় ‘অদ্বিতীয়া’ নামে। আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সহায়তায় ৪৬ জনসহ এ পর্যন্ত মোট ৮৮ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন (২০২১ পর্যন্ত)। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনও তাঁদের আবাসন, টিউশন ফি সুবিধাসহ নানা সুযোগ দেয়।
অনুষ্ঠানটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।