সাক্ষাৎকার

নারীর কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নে কাজ করার স্বপ্ন তাসনিমের

প্রথম আলো ট্রাস্টের একটি নিয়মিত আয়োজন হলো ‘অদ্বিতীয়ার গল্প’। এ আয়োজনে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া একজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনলাইন এই আয়োজনে ২০২৫ সালের ৩০ অক্টোবর বিকেল ৫টায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ২০১৮ সালে এই বৃত্তি পাওয়া দিনাজপুরের মেয়ে তাসনিম আক্তারকে। তিনি তাঁর পরিবারের প্রথম কোনো সদস্য যিনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছেন। তিনি চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন (এইউডব্লিউ) থেকে স্নাতক (সম্মান) শেষ করে ঢাকায় উর্মি গ্রুপে এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে কর্মরত। পরিবারের প্রথম নারী হিসেবে স্নাতক পর্যায়ে যাওয়া এবং তাঁর স্বপ্নের কথাগুলো ওঠে এসেছে এ অনুষ্ঠানে। আয়োজনটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সভাটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা। প্রশ্ন উত্তর আলোকে অনুষ্ঠানের চুম্বক অংশ নিয়ে লিখেছেন মো. নাজিম উদ্দিন।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

তাসনিম আক্তার, কেমন আছেন?

তাসনিম আক্তার: আলহামদুলিল্লাহ, ভালো আছি।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

আমরা সরাসরি গল্পে চলে যাই। ছোটবেলা কেমন ছিল আপনার? বিশেষ করে প্রথম কন্যা সন্তান হিসেবে বেড়ে ওঠার অভিজ্ঞতা কেমন?

তাসনিম আক্তার: ছোটবেলা বলতে, আমি যেহেতু পরিবারের প্রথম কন্যা, আমি আমার বাবা-মায়ের আদর্শ মেনে বড় হয়েছি। আমার বাবা-মা যথেষ্ট চেষ্টা করেছেন আমাকে একটা প্রিন্সিপালের মধ্যে তৈরি করার। কিন্তু আমার একটা বড় ভাই ছিল। সবাই ভাবত যে ছেলেরা বড় হয়ে বাবা-মাকে দেখবে। ওই জায়গাটা তৈরি করার জন্য ছোটবেলা থেকেই একটা জিদ ছিল যে, যেটা আমার ভাই পায়, কোনো প্রশ্ন ছাড়াই আমি যেন ওই জিনিসটা পাই, ওই রেসপেক্টটা পাই।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

দিনাজপুর থেকে চট্টগ্রাম এসে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে (এইউডব্লিউ) পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত, বাবা-মাকে ছাড়া থাকা, পুরো বিষয়টা সহজ ছিল আপনার জন্য?

তাসনিম আক্তার: বিষয়টা সহজ ছিল না। সবচেয়ে বেশি আমাকে যে সাপোর্ট করেছে, সে হচ্ছে আমার নানি। আমার নানি আমাকে প্রচুর সাপোর্ট করতেন। তিনি বারবার বলতেন যে, হ্যাঁ তোমার মধ্যে ওই ট্যালেন্টটা আছে যেখানে তুমি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। আমার মা একটা সমিতির সদস্য ছিলেন। ওই সমিতি থেকে এইউডব্লিউর এই সুযোগের কথা জানানো হয়। তখন আমার নানি বললেন—‘গো ফর ইট’। পরে নিয়ম মেনে আবেদন করা, পরীক্ষা দেওয়া এবং টিকে যাওয়া। যখন আমি শুনলাম চিটাগাং যেতে লাগবে, আমার মা দ্বিধার মধ্যে ছিলেন। কারণ তিনি ভাবতেই পারেননি তার মেয়ে কোনো দিন দিনাজপুর ছেড়ে বাইরে যাবে। আমি গুগল করে ইউনিভার্সিটির রীতিনীতি কেমন, কী শিখায়—সব মাকে বললাম। আমরা তিনজন চিটাগাং গেলাম। অ্যাডমিশনের সময় আম্মু ওয়েটিং রুমে বসে দেখছেন যে অনেকগুলো বিদেশি মেয়ে আছে। আম্মু তখনই বললেন, ‘চলো যাই, এখানে থাকা যাবে না, এখানে থাকতে পারবে না তুমি।’

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

তারপরও আপনি ভর্তি হলেন। হোস্টেলে উঠলেন। সেই প্রথম অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

 তাসনিম আক্তার: যখন আমি হোস্টেলে উঠলাম, ফার্স্ট টাইম মনে হলো, ‘ওকে, দিস ইজ সাম হোয়্যার আই বিলং।’ মানে ফাইনালি কোথাও একটা বিলঙ্গিং জায়গা আছে, একটা কমপ্লিটলি নিজের জায়গা। যখন ওই বেডটা দেখলাম—এটা সম্পূর্ণ আমার। যখন আমি এইউডব্লিউতে যাই, আমার যে একটা নিজস্ব সত্তা আছে, ওই জিনিসটা আমি একচুয়ালি রিয়ালাইজ করতে পারি যে হ্যাঁ, আমার বলে কিছু আছে এই দুনিয়াতে। ওখান থেকে নিজের আইডেনটিটি সার্চ করা বলেন বা আইডেনটিটি ডেভেলপ করা বলেন, দুইটাই আমি এইউডব্লিউ থেকে পেয়েছি।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

অন্তর্মুখিতা জয় করে পাবলিক স্পিকিংয়ে ভালো হওয়া, ক্লাসের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়া—এই যুদ্ধটা পার করলেন কেমন করে?

তাসনিম আক্তার: আমি শুরুতে চেয়েছিলাম আমার রুমমেট যেন না আসে, কারণ আমি কোয়াইট ইনট্রোভার্ট। কিন্তু আমার প্রথম রুমমেট সিমা রাহা আফগানিস্তান থেকে এসেছিল। ও আমার মতনই চুপচাপ, শান্ত ছিল। আমরা দুজনেই প্র্যাকটিস করতাম, কথা বলতাম। ক্লাসে ১১টা দেশের আলাদা আলাদা স্টুডেন্ট ছিল। প্রথম প্রথম অনেক ভয় লাগছিল। খালি মনে হতো হয়তো বাড়ি ফিরে যেতে লাগবে। কিন্তু ওই নিজস্ব সত্তা পেয়েছি, আমি ওটাকে ছাড়তে চাইতাম না। তাই আমি হয় সিমার সঙ্গে, না হলে হোস্টেলে একটা বড় মিরর ছিল, আমি মিররের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করলাম। ওই যে একটা কথা আছে না—    "Fake it till you make it"-আমি ততক্ষণ পর্যন্ত ফেক করব যতক্ষণ পর্যন্ত আমি নিজেকে নিজের মতো তৈরি করতে না পারি। প্রি-অ্যাকসেস শেষ করার পর আমি নিজেকে কমপ্লিটলি ডিফারেন্ট ফর্মে পাইছি। আমি জানছি যে আমি ক্রিয়েটিভ, আমি কথা বলতে অনেক পছন্দ করি, আমি শুনতে পছন্দ করি।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

এখন গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে উর্মি গ্রুপে যখন কাজ করছেন, মায়ের অনুভূতি কী?

তাসনিম আক্তার: আমার মা এখন পুরোপুরি চেঞ্জ হয়ে গেছেন। আগে আমার মা সাপোর্টিভ ছিল না, কিন্তু বর্তমানে আমার মায়ের মতো সাপোর্টিভ আর কেউ নাই। যদি কেউ বলতে আসে, আমার মা হচ্ছে প্রথম মানুষ যে ডিফেন্ড করবে আমাকে। যেদিন আমি প্রথম উর্মি-তে জয়েন করছি, সেদিন আমার মায়ের স্ট্রোক হয়েছিল। আমার জন্য অনেক বেশি শকিং ছিল। আমি ভাবছিলাম যে, আমি কনটিনিউ করব না, আম্মুর সঙ্গে থাকব। কিন্তু আম্মু নিজে আমাকে সাহস জুগিয়ে বলছেন যে, ‘না, তুমি যাও, আমি জানি তুমি সব সামলে নিতে পারবে। " সেই মায়ের মনোবল নিয়ে আমার উর্মি-তে জয়েন করা। এখন তিনি আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছেন।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

এখন যারা অদ্বিতীয়া আছে, কিংবা এখন যারা এইউডব্লিউর স্টুডেন্ট আছে, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী থাকবে?

তাসনিম আক্তার: আমার পরামর্শ থাকবে একটাই, সেটা হচ্ছে ক্লাসে ফুল কনসেন্ট্রেট করা। বিশ্বাস করেন, আমি ক্লাসের বাইরে খুব কম পড়ালেখা করতাম। ক্লাসের মধ্যে যদি আপনি ফুল্লি ফোকাস থাকেন, আমি মনে করি না যে আপনার ক্লাসের বাইরে কোনো পড়ালেখা থাকতে পারে। পাবলিক স্পিকিং, প্রেজেন্টেশন—এই সফট স্কিলগুলো আপনি ক্লাসে বসেই শিখে যাবেন। ক্লাসে ইন্টারেক্ট করে শিখছি। টিচারদের কাছে দ্বিতীয়বার আসতে হেজিটেট করবেন না। আমার ক্লাসমেটরা যখন টিচারদের অ্যাপ্রোচ করত, তখন আমি বুঝলাম যে, আমাকেও যেতে হবে।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

একদম শেষ পর্যায়ে, আপনার স্বপ্ন কী? আজ থেকে পাঁচ বছর পরে তাসনিম নিজেকে কোথায় দেখতে চায়?

তাসনিম আক্তার: আমার আসলে দুইটা স্বপ্ন আছে। একটা স্বপ্ন কোয়াইট পার্সোনাল—আমি চাই যে আমি নিজস্ব একটা বাড়ি করি, যেখানে আমি আমার আম্মু-আব্বুকে একটা ভালো পরিবেশ দিতে পারব। আর সেকেন্ড যে স্বপ্নটা আছে, সেটা হচ্ছে অন্য নারীদের নিয়ে। গার্মেন্টসে নারীদের কর্মসংস্থানের অনেকগুলো অপরচুনিটি থাকলেও, ওপরের সেক্টরে যারা আছে, ম্যানেজার লেভেলে, এক্সিকিউটিভ লেভেলে—এখানে নারীরা খুবই কম। বর্তমানে আমি যে প্রতিষ্ঠানে আছি, সেখানে এক্সিকিউটিভ পদে আমি একমাত্র নারী। আমার ইচ্ছা যে, আমি এমন একটা পজিশনে যাব, যেখানে আমি অন্য নারীদের বড় বড় পজিশনে একটা কর্মসংস্থান করে দিতে পারি। নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করতে পারি। যেখানে শুধু আমার একটা ফ্যাক্টরি হবে, যেখানে জাস্ট ওমেনরা কাজ করবে—নট জাস্ট অ্যাট দ্য ওয়ার্কার লেভেল, এক্সিকিউটিভ লেভেল, ম্যানেজার লেভেল, সিইও লেভেল, ইভেন এমডি লেভেলে। এটাই বর্তমানে আমার স্বপ্ন।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

আপনার সুন্দর স্বপ্নগুলো পূরণ হোক, এই প্রত্যাশা আমাদের। অনেক অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

তাসনিম আক্তার: আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ।