প্রতিকূলতা পেরিয়েছেন অনেকটা, এখন লক্ষ্য স্বাস্থ্য খাতে অবদান রাখা
'অদ্বিতীয়ার গল্প' অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার ইমাদপুর গ্রামের মেয়ে মোছা. দোলেনা আক্তার। তাঁর বাবা দিলদার মিয়া কৃষি কাজ ও দিনমজুরি করে সংসার চালান। মা সালেহা বেগম গৃহিণী। তিন বোনের মধ্যে বড় দোলেনা। নিজেকে একজন স্বাবলম্বী নারী হিসেবে দেখতে চান তিনি।
দোলেনা ২০১৯ সালে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তি পান। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) জনস্বাস্থ্য বিভাগের স্নাতক তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনিই তাঁর পরিবারের প্রথম কোনো নারী যিনি স্নাতক পর্যন্ত যেতে পেরেছেন। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে কীভাবে আজকের এই জায়গায় পৌঁছালেন, সেই গল্প ওঠে এল ৩০ জুন ২০২৪, রোববার, বিকেল ৫টায় 'অদ্বিতীয়ার গল্প' অনুষ্ঠান।
অনুষ্ঠানের শুরুতে পরিচয় পর্ব হলো। পরে রংপুরের মেয়ে চট্টগ্রামে কীভাবে পড়তে গেলেন, বাবা-মা যেতে দিল কিনা—এসব নিয়ে কথা হলো। দোলেনা জানানেল, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিলাম। বাবা-মা অক্ষরজ্ঞানহীন থাকলেও আমার পড়াশোনার আগ্রহ দেখে পড়াশোনা করতে দেন। ছোটবেলায় আমি একাই স্কুলে গিয়ে ভর্তি হয়েছি। প্রথম এক বছর এমনিতেই স্কুলে যেতাম। পরের বছর ভর্তি নেয়। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করতমা। শিক্ষকদের মতো হইতে চাইতাম। প্রথম শ্রেণি থেকে ১০ শ্রেণি পর্যন্ত আমার রোল ১ ছিল। পরিবারের অসচ্ছলতা ও পড়াশোনায় ভালো বলে শিক্ষকগণ সব ধরনের সহযোগিতা করেছেন। যার ফলে এসএসসিতে আমি জিপিএ-৫ পেয়ে উত্তীর্ণ হই এবং এই স্কুলের প্রথম আমিই জিপিএ-৫ পাই। যার ফলে শিক্ষকেরা অনেক খুশি হন। তারপর এইচএসসি ভর্তির পালা। তখন আমার গ্রামের অনেক বড় ভাই ও একটা সংগঠন আমাকে নানা তথ্য ও বৃত্তি দিয়ে এইচএসসি পড়ার ব্যবস্থা করে।’
পরক্ষণেই যুক্ত করে তিনি বললেন, ‘এভাবে এইচএসসির পর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার পালা। আবেদন করে একা একাই গিয়ে পরীক্ষায় অংশ নিই। খ-বিভাগে রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৫ তম হই। পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (লোক প্রশাসন) বিভাগে ভর্তি হই। এখানে ৬ মাস ক্লাস করার পর মাকে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ফোন দেয়। মা গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য ছিলেন। ব্যাংকের এরিয়া ম্যানেজার মাকে এইউডব্লিউ’র বিষয়ে বিস্তারিত জানায়। ফুল স্কলারশিপ নিয়ে পড়ার সুযোগ আছে বলে মা আমাকে আবেদন করে দেখতে বলেন। আমি আবেদন করি, ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষা দিই। পরীক্ষায় পাস করি, ভাইভার জন্য কল করেন। পরে বৃত্তি পেয়ে ভর্তির সুযোগও পেয়ে যাই। এখন প্রশ্ন হলো—পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেড়ে এইউডব্লিউতে যাব কিনা। দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে গেলাম। অনেকের সঙ্গে পরামর্শ করে জানলাম এইউডব্লিউ অনেক ভালো একটা বিশ্ববিদ্যালয়। তা ছাড়া পড়াশোনায় কোনো খরচ হবে না। পরে সিদ্ধান্ত নিয়ে ভর্তি হই এবং একাই চট্টগ্রামে উদ্দেশ্যে রওনা হই।’
এইউডব্লিউ’র ডাইভার্সিফাই পরিবেশে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার বিষয়ে দোলেনা জানালেন, আমি বাড়ির বাইরে থেকে পড়াশোনা করেছি। তাই হোম সিকনেস তেমন কাজ করেনি। তা ছাড়া আমার এলাকার মেয়ে আজিমা আমার রুমমেট ছিল, বিদেশি মেয়েরাও ছিল। অন্যদিকে বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থী হিসেবে শিক্ষকদের অনেক সহযোগিতা পেয়েছি। আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গেছে। এখন আমি যেকোনো দেশের যেকোনো বিষয়ে কমিউনিকেট করতে পারি, কোন ধরনের সমস্যা হয় না।’
এইউডব্লিউতে পড়াশোনার পাশাপাশি নানা ধরনের এক্সট্রা-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস আছে। দোলেনা বলেন, ‘আমি পড়াশোনা ও এক্সট্রা-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস পাশাপাশি রেখে এগিয়েছি। রুটিন মাফিক চর্চা করেছি। সবকিছু ম্যানেজ করে চলেছি।’
এইউডব্লিউ’র প্রথম দিনের দোলেনা আর আজকের দোলেনার মধ্যে নম্বর দিতে বললে কত দেবেন? এর উত্তরে দোলেনা নিজেকে ৯ দেবেন জানালেন। তিনি বলেন, প্রথম দিকে আমি কথাই বলতে পারতাম না। এখানে বিদেশিদের সঙ্গে সব সময় কমিউনিকেট করতে হয়। এখানে পরিবেশটাই এমন।’
দোলেনা তাঁর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে জানালেন এভাবে, ‘প্রথমে পড়াশোনা শেষ করব। যদিও ২০২০ সালে আমার বিয়ে হয়েছে। এরপর পড়াশোনা ও সংসার সামলিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। আমার স্বামী খুব সাপোর্টিভ। সে গাজীপুরে স্টেপ ফুটওয়ার কোম্পানিতে চাকরি করে। আমার শ্বশুরও অনেক সাপোর্ট করেন। সব সময় পড়াশোনা করতে বলেন। তারপরও বাধা তো থাকবেই। সেগুলো অতিক্রম করতে হবে। সব সময়ই করেছি। আমার স্বপ্ন হলো, জনস্বাস্থ্য বিভাগে জব করার। সমাজের, পরিবারের এবং নিজের জন্য কিছু করতে চাই। স্বাস্থ্য খাতে সরকারি চাকরি করে নিজেকে একজন স্বাবলম্বী নারী হিসেবে তৈরি করতে চাই। সেই ভাবেই নিজেকে প্রস্তুত করছি।’
অনুষ্ঠানটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবাসুলতানা।