মৌলভীবাজারের লংলা চা-বাগান শ্রমিকের মেয়ে বৃষ্টি অধিকারী। মা-বাবার স্বল্প আয়ে ছয়জনের পরিবার চালানো যে বেশ কঠিন, সেটা ছোটবেলা থেকেই বুঝতেন বৃষ্টি। তাই ছোট থেকেই পরিবারের কাজে সহায়তা করতেন। মা কাজে গেলে ঘরের সব কাজ করতেন এক হাতে। ঘরের সব কাজ শেষ করে পড়ালেখাও করেছেন মন দিয়ে। যখন ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠেন, তখন বৃত্তিসহ গ্রামের ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন স্কুলে পড়ার সুযোগ পেয়ে যান। স্কুলে গণ্ডি পেরিয়ে যখন কলেজে পা দিলেন, তখন পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া কঠিন হয়ে পড়ছিল। হাল না ছেড়ে টিউশনি শুরু করলেন। এভাবে অনেক কষ্টে এইচএসসি পেরোনোর পর যখন ভর্তি কোচিং করতে পারলেন না, তখন মনে হয়েছিল পড়ালেখা বোধ হয় আর করা হবে না। কিন্তু না! তাঁর মনে যে স্বপ্ন ছিল, একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বেন। সেই স্বপ্ন পূরণ হয়েছে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে (এইউডব্লিউ) ভর্তি হয়ে। এই স্বপ্ন পূরণে সহায়তা করছে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের 'অদ্বিতীয়া' শিক্ষাবৃত্তি।
প্রথম আলো ট্রাস্টের আয়োজন ‘অদ্বিতীয়ার গল্প’ অনুষ্ঠানে এ পর্বের অতিথি হয়ে এসেছিলেন বৃষ্টি অধিকারী। তিনি বর্তমানে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে বায়ো-ইনফরমেটিক্স ও পাবলিক হেলথ বিভাগে স্নাতক শেষ বর্ষে পড়াশোনা করছেন। বৃষ্টি স্বপ্ন দেখেন গবেষক হওয়ার। সেই স্বপ্ন পূরণের প্রচেষ্টায় চালিয়ে যাওয়ার নানা গল্প ওঠে এল ৩১ আগস্ট ২০২৪, শনিবার, বেলা ৩টা ৩০ মিনিট ‘অদ্বিতীয়ার গল্প’ নামক অনলাইন অনুষ্ঠানে।
অনুষ্ঠানের শুরুতে বললেন, ‘চা-বাগান থেকে আমিই প্রথম বায়ো-ইনফরমেটিক্স নিয়ে পড়াশোনা করছি। তারপর আবার ডাবল মেজর। কারণ বিজ্ঞান বিষয়ে বেশি আগ্রহী আমি। আমার এক শিক্ষক আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন। ডাবল মেজর নিয়েও আমিই প্রথম চা-বাগানের।’
ছোট বেলার গল্প বলতে গিয়ে বৃষ্টি বলেন, ‘ছোট থেকেই আমার বিজ্ঞানের প্রতি একটা ভালো লাগা কাজ করত। আমার পরিবারের মা, বড় ভাই, ছোট দুই ভাই ও আমি আছি। মা চা বাগানের নার্সারিতে (চা গাছের চারা যেখানে তৈরি হয়) কাজ করে পরিবারের খরচ চালাতেন। সকালে ওঠে তিনি কাজে যেতেন। যার কারণে আমাকেই ঘরের সব কাজ করতে হতো। দুপুরের খাবার রান্না করে স্কুলে যেতাম। মা ও দাদা এসে খাবে, সেটা চিন্তা করতে হতো।’
আমি নিজেকে ১০ এ ১০-ই দেব। পারলে আরও বেশি দিতে চাই। কারণ এইউডব্লিউ আমাকে অন্যভাবে তৈরি করেছে— বললেন বৃষ্টি অধিকারী।
বৃষ্টি ব্র্যাক স্কুলের সহযোগিতায় বিনা বেতনে ক্লাস ওয়ান থেকে লেখাপড়া শুরু করেন ছোট থেকেই পরিশ্রম এবং সংগ্রামের করে পড়াশোনা করেছেন তিনি। এই কষ্টের মধ্যেও যোগদান দিতেন পাঠ্যক্রম বহির্ভূত কার্যক্রমে। শিখতেন নাচ, গান ও ছবি আঁকা।
এভাবে এসএসসি ও এইচএসসির পর স্নাতকে ভর্তির সময় আসে। কি করবেন বুঝতে পারছিলেন না। কিন্তু বৃষ্টি তো হাল ছাড়ার পাত্র না। কঠোর মনোবল নিয়ে এগিয়ে গেলেন। ভর্তি হলেনর এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে। বৃষ্টি জানালেন, ‘ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১২টি চা-বাগানের শিক্ষার্থীদের জন্য বিনা মূল্যে একটা স্কুলের হোস্টেলে ছিলাম। এইউডব্লিউতে যাওয়ার ক্ষেত্রে এই স্কুলের একটা বড় অবদান আছে। পরে কলেজ শেষ করে মৌলভীবাজার সরকারি কলেজে বোটানি বিভাগে ভর্তি হই এবং পড়তে থাকি। ওখানে আমার এক বান্ধবী সূচনা কৈরির কাছ থেকে এইউডব্লিউর বিষয়ে জানতে পারি। এখানে চা-বাগানের মেয়েদের জন্য শতভাগ বৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ আছে—এটা জানাতে পারি। এটা ২০১৯ সালে, করোনার সময়টাতে অনলাইনে সব করতে হয়। এভাবে আবেদন করি, অনলাইনে পরীক্ষা দিই, ভর্তির সুযোগও পেয়ে যাই। আমি যেন হাতের মুঠোয় আকাশটাকে পেয়ে যাই।’
অনলাইনে ক্লাস পরীক্ষার অভিজ্ঞতা নিয়ে বৃষ্টি বলেন, ‘প্রথমদিকে তেমন কিছুই জানতাম না, বুঝতাম না। এক বড় ভাইয়ের বাড়িতে গিয়ে ক্লাস করতাম। এই সময়টাতে আমাদের ইনস্ট্রাক্টর অনেক সহযোগিতা করেছেন, অনেক সুযোগ দিয়েছেন। করোনার পরে যখন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্যাম্পাসে যেতে বলা হলো, তখন খুবই এক্সসাইটেড ছিলাম। আবার ভয়ও ছিল। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ। তবে আস্তে আস্তে সব ওভারকাম করেছি।’
আপনি এখন শেষ বর্ষে আছেন। চা বাগানের বৃষ্টি ও এখনকার বৃষ্টিকে ১০ নম্বরে কাউন্ট করতে বললে আপনাকে কত দেবেন? এর উত্তরে বৃষ্টির সাবলীল উত্তর, ‘আমি নিজেকে ১০ এ ১০-ই দেব। পারলে আরও বেশি দিতে চাই। কারণ এইউডব্লিউ আমাকে অন্যভাবে তৈরি করেছে।’
এত সংগ্রাম করে পড়াশোনা করে এখন তো স্নাতক প্রায় শেষ, ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ভাবছেন? ‘আমি গবেষক হতে চাই। আমার থিসিস পেপার করার সময়ে গবেষণা করার আনন্দটা বুঝতে পারি এবং চাই এইটা নিয়ে আগাতে। তবে যেই পেশাতেই যাই না কেন আমি ফিরে যাব চা বাগানে। ওখানে আমি একটি হাসপাতাল করতে চাই, যা চা বাগানের লোকদের বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা দেবে।’