ফারজানা আক্তার রিপা, পরিবারের সঙ্গে ভাড়া বাসায় থাকেন রাজধানীর মিরপুরে। বাবার একার আয়ে সংসার চলানো কঠিন হয়ে পড়ে। তার উপর দুই বছর কোনো বেতন পাননি। এমতাবস্থায় মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নেওয়াটা তাঁর পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। তখন স্থপতি ইকবাল হাবীবের সহযোগিতায় ফারজানার পড়াশোনা অব্যাহত থাকে। সেই ফারজানা এখন স্বপ্ন দেখেন পোশাক খাতে নিজের একটা ব্র্যান্ড তৈরির।
‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্ত ফারজানা তাঁর পরিবারের প্রথম গ্র্যাজুয়েট সম্পন্নকারী নারী। তাঁর পরিবার প্রথম গ্র্যাজুয়েট হওয়া, স্বপ্ন ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পণার গল্প ওঠে আসল ৩১ ডিসেম্বর ২০২২, শনিবার, বেলা ৩টায় ‘অদ্বিতীয়ার গল্প’ নামক অনলাইন অনুষ্ঠানে। প্রথম আলো ট্রাস্ট এই অনলাইন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
শুরুতেই ফারজানা বলেন, ‘এ রকম একটা অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য ধন্যবাদ। মেয়েদের অনেক বাধা থাকে। প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত বাবা তাঁর অর্থনৈতিক অবস্থা বুঝতে দেয়নি। বাবা একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। কিন্তু ২ বছর কোনো বেতন দেয়নি। তখন আমি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ি। পরিবারের অবস্থা এমন হয়—খাব নাকি পড়ব! ঠিক সেই সময়টাতে পাশে দাঁড়ান প্রতিবেশী স্থপতি ইকবাল হাবীব। পড়াশোনার আগ্রহের কথা জানতে পেরে তিনি এগিয়ে আসেন। পড়াশোনার দায়িত্ব নেন। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনার খরচ বহন করেন তিনি।’
এইচএসসি পাসের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা দেন ফারজানা কিন্তু হয়নি। তখন অনেকটা হতাশ হয়ে পড়েন। ঠিক সেই সময়টাতে এইউডব্লিউর বিষয়ে জানেন। কিন্তু সেখানে পড়তে প্রায় ৭৫ লাখ টাকার প্রয়োজন। সেটা তার পরিবারের পক্ষে অকল্পনীয়। তারপরও বৃত্তির পাওয়ার ভরসায় পরীক্ষা দেন। টিকেও যান। একই সঙ্গে পেয়ে যান অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তিও। তখন অনেকটা সহজ হয়ে যায়। তখন মনে হয়েছে, আমার জন্য ভালো কিছু ছিল বলেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়নি—জানালেন ফারজানা।
‘এইউডব্লিউ যাওয়ার পর স্বপ্নটা বড় হতে থাকল। মনে হতে থাকল—এমপ্লয়ি কেন,সিইও কেন নয়! এখানের পরিবেশ তাই শিখায়।’
স্নাতকে পর্যায়ে চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে (এইউডব্লিউ) ভর্তির সুযোগ পান ফারজানা। একই সঙ্গে আবেদন করেন আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্ট ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তির জন্য। পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে ২০১৭ সালে পেয়ে যান ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি। এই শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে এই বছর অর্থনীতিতে স্নাতক পর্যায় শেষ করেন।
বিশ্ববিদ্যালয় শুরুর দিকের কথা বলতে গিয়ে জানান, ‘যখন এইউডব্লিউ যাই তখন মনে হয়েছে—এটা কই আসলাম! কলেজে ইংরেজিতে ভয় ছিল। ওটাই পেয়ে বসল। তবে সিনিয়র আপুরা অনেক সহযোগিতা করেছে। সব চেয়ে ভালো দিক হলো, এখানে কোনো র্যাগিং নাই।’
যখন ক্লাস শুরু হলো, সব জড়তা পার করে কি হতে চাইলেন? এর উত্তরে ফারজানা জানান, ‘এইউডব্লিউ যাওয়ার পর স্বপ্নটা বড় হতে থাকল। মনে হতে থাকল—এমপ্লয়ি কেন,সিইও কেন নয়! এখানের পরিবেশ তাই শিখায়। এখন আমি বলতে পারি, আমাকে যেখানেই ফেলে দেওয়া হোক না কেন, পথ বের করে ফিরে আসতে পারব আমি।’
গল্পের এক পর্যায়ে আরেকটা বিষয় শেয়ার করলেন ফারজানা। তাঁর কথায় ‘করোনার সময় ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তির টাকা জমিয়ে একটা অনলাইন ব্যবসা শুরু করি। থ্রি-পিচ বিক্রি শুরু করি। এভাবে ১ বছর চলার পর মনে হয়েছে, অন্যজনের কাছ থেকে পোশাক না কিনে নিজে তৈরি করব। নিজের একটা ব্র্যান্ড তৈরির ইচ্ছাটা তৈরি হয়।’
এখন যারা অদ্বিতীয়া আছে তাদের উদ্দেশে তিনি জানালেন, ‘আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। সবার আগে নিজেকে বিশ্বাস করতে হবে। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। মুখস্থ বিদ্যায় নয়, নিজের ক্রিয়েটিভিটি তৈরি করতে হবে।’
২০১৭ সাল আর আজকের রিপার প্রার্থক্য কি? এর উত্তরে ফারজানা বলেন, ‘আজকের আমি তৈরিতে এইউডব্লিউর অবদান অনেক। আগে কথা বলতে পারতাম না, এখন আমি পারি। নিজেকে আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছি। এ ক্ষেত্রে কয়েকজনকে ধন্যবাদ দিতে চাই। যেমন স্থপতি ইকবাল হাবীব স্যার, মা-বাবা। কারণ দাদি আমাকে বিয়ে দিতে বলেছিলেন। মা-বাবা ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছেন তখন। আর সব শেষে প্রথম আলো ট্রাস্ট ও আইডিএলসিকে, যাদের জন্য আমার পড়াশোনার পথটা অনেক সহজ হয়েছে।’
উল্লেখ্য, নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ২০১২ সাল থেকে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এবং প্রথম আলো ‘ফার্স্ট ফিমেল ইন দা ফ্যামিলি স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ নামে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান শুরু করে। পরিবারের প্রথম নারী অথচ অসচ্ছল, যিনি উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজ গঠনে আগ্রহী, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের এ রকম ১০ জনকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। ট্রান্সকম গ্রুপের সহায়তায় প্রথম আলো ট্রাস্ট এই বৃত্তির ব্যবস্থা করে। ট্রান্সকম গ্রুপের সহায়তায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪২ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন।
২০১৭ সাল থেকে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড এই শিক্ষাবৃত্তির দায়িত্ব নেয়। নতুনভাবে নামকরণ করা হয় ‘অদ্বিতীয়া’ নামে। আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সহায়তায় ৪৬ জনসহ ২০২১ পর্যন্ত মোট ৮৮ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনও তাঁদের আবাসন, টিউশন ফি সুবিধাসহ নানা সুযোগ দেয়।
অনুষ্ঠানটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।