বিদেশে উচ্চশিক্ষা নিয়ে নারী স্বাস্থ্যে ওপর কাজ করার স্বপ্ন আজিমার
দিনাজপুরের মেয়ে আজিমা খাতুন। বাবা কৃষি কাজ করে সংসার চালান। কিন্তু তাঁর মা-বাবা সব সময় সাহস জোগাতেন। বাবা-মার উৎসাহ এবং নিজের প্রচেষ্টায় এসএসসি ও এইচএসসি দুটোতেই আজিমা পান জিপিএ-৫। টিউশনি করে নিজের খরচ চালাতেন। তাই এইউডব্লিউতে সুযোগ পাওয়ার পরও দুশ্চিন্তায় ছিলেন এই ভেবে—‘গ্রামে তো টিউশনি করেছি। এখানে টিউশনি কোথায় পাব?’ তাঁর সেই দুশ্চিন্তা দূর করেছে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদ্বিতীয়া বৃত্তি। সম্প্রতি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন থেকে জনস্বাস্থ্য বিভাগে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন।
প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন ‘অদ্বিতীয়ার গল্প' অনুষ্ঠানে এ পর্বের অতিথি ছিলেন আজিমা খাতুন। স্বপ্ন তাঁর দেশের বাইরে থেকে উচ্চশিক্ষা নেওয়া। এ ছাড়া নারী স্বাস্থ্য ও নিজ কমিউনিটিতে কাজ করতে চানা। মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখার কথাও ভাবেন। তাঁর এই স্বপ্নগুলোর গল্প ওঠে এল ৩০ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, বিকেল ৫টায় 'অদ্বিতীয়ার গল্প' অনুষ্ঠানে।
ছোটবেলার গল্প দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু। দিনাজপুরের মেয়ে তিনি। আজিমা বললেন, ‘ছোট থেকেই মেধাবী ছিলাম। বড় বোনের সঙ্গে স্কুলে চলে যেতাম। মা পড়াতেন। প্রথম ভর্তি হলাম সানলাইট স্কুলে। সব সময় ভালো ফল করতাম। ভালো ফল করলে মা অনেক খুশি হতেন। অ্যাসোসিয়েশনের বৃত্তি পেয়েছি। আমার এই জার্নিতে আমার এক ম্যাডামের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। তিনি আমার বাবা-মাকে মোটিভেট করছেন আমাকে পড়ানোর জন্য। তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
ষষ্ঠ শ্রেণিতে সৈয়দপুরে ভর্তি হই। কিন্তু বাড়ি থেকে সৈয়দপুরের যাওয়া কঠিন ছিল। পরে নবম শ্রেণিতে আবার সানলাইন স্কুলে চলে আসি। এই স্কুল থেকেই জিপিএ-৫ পেয়ে এসএসসি পাস করি। এইচএসসি ভর্তি হই সৈয়দপুর মহিলা কলেজে। এই কলেজ থেকে একমাত্র আমি জিপিএ-৫ পেয়েছি। এরপর ভর্তিযুদ্ধের শুরু। দিনাজপুরে গিয়ে কোচিং শুরু করি। সে সময় আমি টাইফয়েডে আক্রান্ত হই। কোচিং বন্ধ করে দিই। তারপরও ভর্তি পরীক্ষা দিই। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ হলো না। এখন কী করব, ভেবে পাচ্ছিলাম না। এদিকে আমার বড় বোনের বিয়ে হয়েছে এসএসসির পর। তবে আমার জন্য বাবা-মা সেরাটা দেওয়া চেষ্টা করেছেন।’
এইউডব্লিউতে কিভাবে এলেন? এর উত্তরে আজিমা জানান, ‘মা গ্রামীণ ব্যাংকের সদস্য ছিলেন। ওখান থেকে ফোন দিয়ে নার্সিংয়ে পড়ার কথা বলেন। তবে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে চাই জানালে ব্যাংক ম্যানেজার এইউডব্লিউ ও বৃত্তির কথা জানান। আমি সকল কাগজপত্র দিয়ে আসি। তারাই আবেদন করে দেন। পরে ঢাকায় গিয়ে পরীক্ষা দিয়ে টিকে যাই। ভাইভা দেই, সুমন চ্যাটার্জি স্যার আমার ভাইভা নেন এবং বৃত্তির অফার লেটার দেন। সেই সময়টা আমার কী যে আনন্দ লেগেছে বোঝাতে পারব না। তারপর ভর্তি হয়ে ক্যাম্পাসে যাই।’
এইউডব্লিউতে গিয়ে কেমন অনুভূতি হলো? আজিমা জানান, ‘১৯ দেশের মেয়েরা এখানে পড়াশোনা করে। সুতরাং পরিবেশটা বহুজাতিক। আমি বাংলা মাধ্যমে পড়াশোনা করা মেয়ে। প্রথমে সমস্যা হয়েছে। তবে তাদের সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলতে চেষ্টা করে গেছি। প্রথম দিন যখন ক্যাম্পাসে যাই, সিনিয়ররা আমার লাগেজ হাতে নিয়ে রুমে নিয়ে যায়। সবকিছু বুঝিয়ে দেন। তখনই একটা ভালোলাগা তৈরি হয়ে যায়। এইউডব্লিউ হলো বাংলাদেশের মধ্যে ছোট্ট একটা বিদেশ। এটা আমার কাছে ভালো লেগেছে।’
এইউডব্লিউর প্রথম দিনকার আজিমা আর আজকের আজিমার আত্মবিশ্বাসের রেটিং কত হবে? এক মুহূর্ত চিন্তা না করে আজিমার সাবলীল উত্তর—১০ এর মধ্যে ৯। ভেবে দেখুন, কতটুকু আত্মবিশ্বাস থাকলে এটা বলা যায়!
এইউডব্লিউতে অনেক ক্লাব আছে, ক্লাসের ফাঁকে অনেক এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি হয়। সবাই যুক্ত থাকে। আপনি কীভাবে ম্যানেজ করলেন? জবাবে আজিমা জানান, ‘এইউডব্লিউর প্রথম দিন থেকে সময় ব্যবস্থাপনার বিষয়ে ধারণা তৈরি হয়ে যায় আমার। সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়—আমিও তাই করেছি। রুটিন মাফিক, শিডিউল ধরে কাজ করেছি। ওই সময়টা আমাদের জন্য অনেক শিক্ষণীয় ছিল। আমাদের মাল্টিটাস্কার হতে হয়। আমি আজ আত্মবিশ্বাসী এক নারী হতে পেরেছি।’
এইউডব্লিউর প্রথম দিনকার আজিমা আর আজকের আজিমার আত্মবিশ্বাসের রেটিং কত হবে? এক মুহূর্ত চিন্তা না করে আজিমার সাবলীল উত্তর—১০ এর মধ্যে ৯। ভেবে দেখুন, কতটুকু আত্মবিশ্বাস থাকলে এটা বলা যায়!
বাবা-মায়ের অনুভূতি এখন কেমন? আজিমা জানালেন, ‘তাদের অনেক স্বপ্ন আমাকে নিয়ে। আমি এই পরিবারের প্রথম স্নাতককারী মেয়ে। এখন আমি জানি, কীভাবে নিজেকে প্রকাশ করতে হয়। আমার এই জার্নিতে অনেকেই সহযোগিতা করেছেন। আমার এই জার্নিতে মায়ের ভূমিকা বেশি। সে জন্য-আমি জিতে গেলে, জিতে যান মা।’
আজিমা তাঁর স্বপ্নের কথা জানালেন। তিনি বলেন, মাত্র স্নাতক শেষ করলাম। এখন ইচ্ছা হলো দেশের বাইরে থেকে উচ্চশিক্ষা নেওয়া। নিজ কমিউনিটিতে কাজ করব। নারী স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করব। তা ছাড়া আমাকে অদ্বিতীয়া হতে প্রথম আলোর অবদান অনেক। আমি ভবিষ্যৎ অদ্বিতীয়াদের সাহায্য করব, সমাজের পাশে দাঁড়াব। নারীর স্বাস্থ্য ও পুষ্টি নিয়ে গবেষণা করব।’
সবচেয়ে বড় পাওয়া—আপনারা আমার পাশে ছিলেন। আজকের দিনটা যখন আমি স্নাতক শেষ করে বাড়ি ফিরছি। আমি খুব কৃতজ্ঞ প্রথম আলো ও এইউডব্লিউর প্রতি আমার স্বপ্নের পাশে দাঁড়ানোর জন্য।’
অনুষ্ঠানটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।