মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার ভাড়াউড়া চা-বাগানের মেয়ে প্রিয়াংকা গোয়ালা। পরিবারের আর্থিক অসচ্ছলতা তাঁর পড়াশোনায় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। আত্মীয়স্বজনের কথা শুনে মা-বাবা বিয়ে দিতে রাজি হয়। কিন্তু প্রিয়াংকা রাজি হয়নি। বিরুদ্ধে এগিয়ে গিয়ে বিয়ে ভেঙে দিয়েছেন। এই কারনে পুরো পরিবারকে ওরা বাড়ির চারপাশে পেট্রল ছিটিয়ে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে চেয়েছিল। তারপরও থেকে থাকেননি প্রিয়াংকা, পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। নিজের ও তাঁর মায়ের চেষ্টায় স্নাতক পর্যন্ত যেতে পেরেছেন। তিনি ২০২০ সালে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি পান। শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) জনস্বাস্থ্য বিভাগে শেষ বর্ষে পড়াশোনা করছেন তিনি।
মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের প্রভাব নিয়ে গবেষণা করছেন তিনি। স্বপ্ন দেখেন দেশের বাইরে যাবেন, উচ্চশিক্ষা নিয়ে গবেষণা করবেন। সেই চেষ্টায় এগিয়েও যাচ্ছেন। পরিবারের প্রথম নারী হিসেবে স্নাতক পর্যায়ে যেতে পারার নানা বিষয় ওঠে এসেছে ৩১ অক্টোবর ২০২৪, বৃহস্পতিবার, বিকেল ৫টায় প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়ার গল্প’ অনলাইন অনুষ্ঠানে।
শ্রীমঙ্গল থেকে এইউডব্লিউতে যাওয়ার গল্প বলতে গিয়ে প্রিয়াংকা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই আমার জীবনে শুধু স্ট্রাগল আর স্ট্রাগল। আপনারা হয়ত জানেন, বাগানের মানুষের সব ধরনের সুযোগ থাকে না। আমার বাবা একজন চা-শ্রমিক। ফলে পড়াশোনার জন্য আমাকে স্ট্রাগল করতে হয়েছে। নবম শ্রেণিতে থাকতে টিউশনি শুরু করি। ১২০ টাকা মজুরিতে (এখন ১৭০ টাকা হয়েছে) ৩ ভাইবোনের পড়াশোনা, সংসার চালানো খুবই কঠিন। আমি সবার বড় হওয়ায় আমাকে সবকিছুই করতে হয়েছে। পড়াশোনা, সংসারের কাজ, টিউশনি সব। মা বলতেন, মেয়েদের সবদিক থেকে পারফেক্ট থাকতে হয়। বাবা চা-শ্রমিক হলেও আমাদের পড়াশোনা করাবেন না, এমনটা কখনো বলেননি। বরং বাবা তাঁর নাশতার ৬০ টাকা বাঁচিয়ে আমাদের দিয়েছেন। আমার স্কুলের শিক্ষকগণ অনেক সহায়তা করেছেন। এভাবে এগিয়েছি।’
পরক্ষণেই প্রিয়াংকা জানালেন, ‘এইউডব্লিউতে আসার গল্পটা অন্যরকম। এইচএসসি পাসের পর আমার বিয়ে ঠিক করা হয়। কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। এইউডব্লিউর বিষয়ে আগেই জানতাম। চা-বাগানের কোটা আছে আমাদের। পরে কাউকে না জানিয়ে এইউডব্লিউতে ফরম পূরণ করি, পরীক্ষা দিই এবং চা-বাগানের কোটায় টিকে যাই। যখন বৃত্তিসহ টিকে গেছি তখন নিজের মধ্যে এক ধরনের শক্তির সঞ্চয় হয়। তখন সাহস নিয়ে বলে দিই-আমি বিয়ে করব না। আমাকে বোঝানোর চেষ্টা করা হলেও শেষ পর্যন্ত মা আমার পাশে দাঁড়ায়। বিয়েটা ভেঙে দিই। বিয়ে থেকে পালাতে গিয়ে আমার এইউডব্লিউতে আসা।
এখন আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছানোর দৌড়ে আছি। লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাবা-মা সাপোর্ট করছে। আমার পাশে আছেন। এখন আমি স্বপ্নপূরণের জন্য এগিয়ে যাচ্ছি।
চা-বাগানের রীতি হলো-কেউ কাউকে দেখতে আসলে তার সঙ্গেই বিয়ে হয়। আমাকে দেখে যাওয়ার পর আমি না বলায় আমাদের বাসায় আগুন দিয়েছিল। তারপর করোনার সময় আমরা ভর্তি হয়েছি। ওই সময়টা অনেক চ্যালেঞ্জিং ছিল। আমার মোবাইল ফোন ছিল না। আমার এক দাদা ফোন দিয়ে আমাকে সহযোগিতা করেছিল। বিয়ে ভেঙে দিয়েছি সে জন্য অনেক কথাবার্তা হতো। মা আমাকে সাপোর্ট দিয়েছে।’
ক্যাম্পাসে গিয়ে কি অনুভূতি হলো আপনার? এর উত্তরে প্রিয়াংকা জানান, ‘আমি বাংলা মাধ্যমের কিন্তু ওখানে সব ইংরেজিতে বলতে হয়। যদিও আমি ইংরেজিতে একটু ভালো ছিলাম। সে জন্য তেমন সমস্যা হয়নি। তা ছাড়া, ক্লাব ওয়ার্ক, এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি করে কাটিয়ে উঠেছি। সে জন্যই সবকিছু ম্যানেজ করে চলতে পারছি।’
প্রিয়াংকা তাঁর স্বপ্নের কথা জানালেন। তিনি বলেন, ‘মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করতে চাই। বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর যে প্রভাব ফেলে তা নিয়ে গবেষণা করতে চাই। বর্তমানে চা-বাগানবাসীদের ওপর এর প্রভাব নিয়ে থিসিস করছি। ভবিষ্যতে শুধু বাগান নয়, বিশ্বব্যাপী এর প্রভাব কী, তার ওপর উচ্চতর পড়াশোনা করতে চাই।
নিজ কমিউনিটি নিয়ে নিজের ভাবনাও জানালেন প্রিয়াংকা। তিনি বলেন, ‘আমি পাবলিক হেলথ বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে চা-বাগানের মেয়ে ও মায়েদের মাসিককালীন নানা জটিলতা নিয়ে কাজ করব। দেশের বাইরে থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে নিজ কমিউনিটিতে কাজ করার ইচ্ছা আমার।
মা-বাবার অনুভূতি কেমন জানতে চাইলে প্রিয়াংকা বলেন, ‘মা-বাবা খুশি এখন। অনেক আত্মীয়স্বজন বলে, মেয়ের বয়স হয়েছে, বিয়ে দাও না কেন? তবে এ সব আমরা ইগনোর করি। এখন আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছানোর দৌড়ে আছি। লক্ষ্য অর্জনের জন্য বাবা-মা সাপোর্ট করছে। আমার পাশে আছেন। এখন আমি স্বপ্নপূরণের জন্য এগিয়ে যাচ্ছি।
অনুষ্ঠানটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।