নামের সঙ্গে ডক্টর যুক্ত হবে—এটা আমার স্বপ্ন: সোমা গোস্বামী

আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের 'অদ্বিতীয়া' শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া আলীনগর চা-বাগানের সোমা গোস্বামী।

মৌলভীবাজার জেলার আলীনগর চা-বাগান শ্রমিক পরিবারে জন্ম সোমা গোস্বামীর। তাঁর পরিবারের প্রথম কন্যা সন্তান হিসেবে স্নাতক পর্যন্ত যেতে পেরেছেন। বর্তমানে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের 'অদ্বিতীয়া' শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে (এইউডব্লিউ) জনস্বাস্থ্য বিভাগে পড়াশোনা করছেন। এরই মধ্যে তিনি জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে জয়েন্ট প্রোগ্রামে কোর্স করে ফিরেছেন।

প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন 'অদ্বিতীয়ার গল্প' অনুষ্ঠানের এ পর্বের অতিথি ছিলেন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনর তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সোমা গোস্বামী। তিনি ২০২০ সালে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি পান। মৌলভীবাজারের আলীনগর চা-বাগান থেকে এইউডব্লিউ’র পথ চলা, সেখান থেকে জাপানে যাওয়া ইত্যাকার নানা বিষয় ওঠে আসে ৩০ নভেম্বর ২০২৩, বৃহস্পতিবার, বিকেল ৫টায় প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়ার গল্প’ অনলাইন অনুষ্ঠানে।

অনুষ্ঠানের শুরুতে সোমা জানান, ‘আমাদের চা-বাগানের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে সবাই মনে করেন—মেয়েরা সংসার করবে, সন্তান লালনপালন করবে। এগুলো সেই জন্মের পর থেকে শুনছি। যা হোক নানা প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে, অনেক কষ্ট করে এইচএসসি শেষ করি। পরে বিয়ে দিতে চেয়েছে। কিন্তু আমি প্রটেক্ট করেছি। আমার ইচ্ছা ছিল আর্মিতে যাওয়ার, একবার চেষ্টাও করেছিলাম।’

কিছুটা থেমে আবার বললেন, ‘আমার কখনো মনে হয়নি উচ্চশিক্ষা নিতে পারব। তবে বাবা-মা অনেক সাপোর্ট করেছে। আমাদের এলাকার চা-বাগানের ছেলেমেয়েরা আশপাশে ভর্তি হতো। কিন্তু আমি একটা ভালো স্কুলে যেতে চাইতাম। ভালো স্কুল দূরে হওয়ায় যাতায়াত খরচ দিতে পারতেন না। তারপরও বাবা আমাকে ভর্তি করিয়েছিলেন, আমি হেঁটে যেতাম। আমাকে চা-বাগানের মেয়ে হিসেবে ট্রিট করা হতো। তবে কেউ কেউ পজেটিভলি ট্রিট করেছে যেটা আমাকে আরও সাহস জুগিয়েছে। অনেক শিক্ষক ফ্রিতে পরিয়েছেন। এই সুযোগটা আমি কাজে লাগিয়েছি।

২০১৮ সালে এইচএসসি পাস করার পর প্রথমে এলাকায় বাংলা বিভাগে ভর্তি হই। পরে বন্ধুদের কাছ থেকে এইউডব্লিউ সম্পর্কে জেনে আবেদন করি। লিখিত পরীক্ষায় টিকে যাই। তবে ভাইভাতে বাদ পড়ে যাই। দ্বিতীয়বার পরীক্ষা দিয়ে লিখিত পাস করিনি। তৃতীয়বার দেব কিনা, সেটা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম। এমনিতেই বলাবলি হচ্ছিল…কতজনের হলো তোর হলো না। কিন্তু আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, আমার হবেই। সে জন্য কাউকে না জানিয়ে তৃতীয়বারের মতো ফরম পূরণ করি। এবারও লিখিত পরীক্ষায় টিকে যাই। আগের ভাইভাগুলোর অভিজ্ঞতা থেকে নিজে নিজেই ভালো করে প্রস্তুতি নিই। করোনার কারণে অনলাইনে ভাইভা হলো। পরে আমার ফোন বন্ধ থাকায় বাবার ফোনে কল আসে—আমি নির্বাচিত হয়েছি এবং বৃত্তি পেয়েছি। এটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন বলে মনে করি।’

জয়েন্ট প্রোগ্রামের জাপানের টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোর্স করেছেন সোমা গোস্বামী।

এবার আসা যাক জাপান যাওয়ার গল্প। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় ও এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) যৌথ সামার প্রোগ্রামে এইউডব্লিউ থেকে ১০ জন এবং টোকিও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১০ জন মেয়ে অংশগ্রহণ করে। এইউডব্লিউ থেকে যে ১০ জন নির্বাচিত হয়েছেন তার মধ্যে সোমা গোস্বামী অন্যতম। জাপান যাওয়ার বিষয়ে সোমা জানান, ‘এই প্রোগ্রামে বাংলাদেশ থেকে আমরা ৩ জন ছিলাম। আমি আমার কমিউনিটি, চা-বাগানের বিষয়গুলো উপস্থাপন করেছি। আমি যেদিন প্রফেসরের কাছে জানতে পারলাম, সেদিন খুব খুশি হয়েছিলাম। সব ফর্মালিটি শেষকরে জাপান যাই। এটা আমার জীবনের দ্বিতীয় অর্জন। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এটাই ছিল আমার প্রথম যাত্রা। সব মিলিয়ে ১২ দিনের কোর্স ছিল। অনেক কিছু শিখেছি। জাপানের সংস্কৃতি, তাদের ভাষা জেনেছি। অনেক দর্শনীয় স্থানে ভ্রমণ করেছি। ইমিগ্রেশন, মাইগ্রেশন অ্যান্ড রিফিউজি সম্পর্কিত কোর্স করেছি সেখানে। এখন আমি ইউজি-৩ (শেষ বর্ষে) তে পড়ছি।’

পরের স্বপ্নটা কি, এ ব্যাপারে সোমা বলেন, ‘আমার কমিউনিটি ডেভেলপমেন্টের জন্য কাজ করব। যদিও ২০১৫ সাল থেকে এ ধরনের কাজে যুক্ত আছি। চা-বাগানের মেয়েদের নিয়ে কাজ করছি। চা-বাগানের কনভেনশনাল চিন্তা-চেতনা পরিবর্তনের জন্য কাজ করছি। আস্তে আস্তে পরিবর্তন হচ্ছে। আর একাডেমিক বিষয়ে যদি বলি. . বর্তমানে আমি আমার এলাকায় নন-সংক্রামক রোগ নিয়ে থিসিস করছি। স্নাতক শেষ করে দেশের বাইরে থেকে স্নাতকোত্তর করব, পিএইচডি করব। আমার নামে সঙ্গে ডক্টর যুক্ত থাকবে—এটা আমার স্বপ্ন। জনস্বাস্থ্য বিভাগের শিক্ষার্থী হিসেবে স্বাস্থ্যসম্পর্কিত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করব—এটাই আমার আশা।

উল্লেখ্য, নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ২০১২ সাল থেকে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এবং প্রথম আলো ‘ফার্স্ট ফিমেল ইন দা ফ্যামিলি স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ নামে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান শুরু করে। প্রতিবছর পরিবারের প্রথম নারী অথচ অসচ্ছল, যিনি উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজ গঠনে আগ্রহী, এ রকম ১০ জনকে ট্রান্সকম গ্রুপের সহায়তায় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে এ শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া শুরু করে প্রথম আলো ট্রাস্ট। ট্রান্সকমের সহায়তায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪২ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন।

২০১৭ সাল থেকে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড এই শিক্ষাবৃত্তির দায়িত্ব নেয়। নতুনভাবে নামকরণ করা হয় ‘অদ্বিতীয়া’ নামে। আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সহায়তায় ৬৬ জনসহ ২০২৩ পর্যন্ত মোট ১০৮ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্ত পেয়েছেন। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনও তাঁদের আবাসন, টিউশন ফি সুবিধাসহ নানা সুযোগ দেয়।

অনুষ্ঠানটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।