সাক্ষাৎকার

রুনা আক্তারের স্বপ্ন ও সংগ্রামের গল্প

প্রথম আলো ট্রাস্টের একটি নিয়মিত আয়োজন হলো ‘অদ্বিতীয়ার গল্প’। এ আয়োজনে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া একজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনলাইন এই আয়োজনে ২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর বিকেলে ৫টায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল ২০২১ সালে এই বৃত্তি পাওয়া রুনা আক্তারকে। তিনি তাঁর পরিবারের প্রথম কোনো সদস্য যিনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছেন। তিনি চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) জনস্বাস্থ্য বিভাগের স্নাতক (সম্মান) শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। পরিবারের প্রথম নারী হিসেবে স্নাতক পর্যায়ে যাওয়া এবং তাঁর স্বপ্নের কথাগুলো ওঠে এসেছে এ অনুষ্ঠানে। আয়োজনটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সভাটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা। প্রশ্ন উত্তর আলোকে অনুষ্ঠানের চুম্বক অংশ নিয়ে লিখেছেন মো. নাজিম উদ্দিন।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

স্বাগত আপনাকে, কেমন আছেন?

রুনা আক্তার: থ্যাংক ইউ আপু। আমি ভালো আছি। আর আজকে বিশেষভাবে আমার বেশি ভালো লাগছে। কারণ যে স্কলারশিপের মাধ্যমে পড়াশোনা করেছি এবং শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি, সেই প্ল্যাটফর্মে কথা বলার সুযোগ পেয়ে আমি সত্যি খুব আনন্দিত।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

আমরা ভীষণ আনন্দিত যে আমরা আপনার সঙ্গে কথা বলছি। ছোট রুনা থেকে অনার্স শেষ করতে যাওয়া রুনার পুরো গল্পটা একটু শুনি, কেমন ছিল গল্পটা?

রুনা আক্তার: আসলে গল্পটা এখন বলতে ভালো লাগে, কারণ এখন আমি অনেক দূর এসেছি। আল্লাহ আমাকে সাফল্যের পথে নিয়ে এসেছেন। কিন্তু পথটা আসলে এত সহজ ছিল না। ছোটবেলা থেকে যেহেতু বাবা-মা ছিলেন না, আমার জন্য পড়াশোনা করাটা একটা শৌখিনতা ছিল। কিন্তু আমি থেমে যাব না, এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। আমাকে যেভাবেই হোক পড়াশোনা করতে হবে এবং পড়াশোনা আমার আলো হিসেবে কাজ করবে। আমাকে অন্যের বাসাতে থেকে কাজ করে তারপর পড়াশোনা করতে হয়েছে। আমি যখন ঢাকায় আসি, আমি হারিয়ে যাই, এবং পরে একটি এনজিও-তে আমার স্থান হয়। সেখান থেকে আমাকে কনটিনিউ করতে হয়েছে। পরে আমি প্রথম আলো থেকে স্কলারশিপ পেয়েছি।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

আপনার সেই লাল গাড়ির স্বপ্নের কথাটা একটু শুনতে চাই। লাল রঙের গাড়ি কেন?

রুনা আক্তার: আমার বাবা ছোটবেলা থেকে অনেক গল্প বলতেন। বাবা বলতেন, ‘তুমি বড় হবা এবং লাল রঙের একটা গাড়ি নিয়ে তুমি ঢাকা থেকে গ্রামে আসবা। সবাই দেখবে যে, রুনার একটা গাড়ি আছে।’ আমি মনে করি, বাবা হয়তো আমার ভেতরে ছোট থেকেই এই স্বপ্নটা ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে আমাকে স্বশিক্ষিত হতে হবে এবং দারিদ্র্য থেকে বের হতে হবে। সেখান থেকেই আসলে আমার সেই ইচ্ছাটা যে, হ্যাঁ, আমার অনেকগুলো গাড়ি হোক এবং তার মধ্যে একটা লাল রঙের গাড়ি থাকুক।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

ডিপ্লোমা শেষ করে ইঞ্জিনিয়ারিং প্রফেশনে না গিয়ে আপনি অনার্স শুরু করলেন, ফিউচার প্ল্যানটা কি ছিল?

রুনা আক্তার: যখন ডিপ্লোমা শেষ করি, তখন কোভিড শুরু হয়। আমি ছোটখাটো একটা এনজিওতে জব করতাম। আমার আসলে ছোটবেলা থেকেই মনে হয়েছে, নারীর ক্ষমতায়ন বা নারীর শিক্ষার জন্য বা সমাজের জন্য আমার কিছু দায়বদ্ধতা আছে। আমি মনে করি, আমি মানুষের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পছন্দ করি এবং তাদের গল্পটা শুনতে পছন্দ করি। তাই এনজিও একটা মাধ্যম, যার মাধ্যমে আমি মানুষের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক বজায় রেখে কাজ করতে পারব। প্রথম আলোতে স্কলারশিপের সন্ধানটা দেখে আমার মনে হলো যে, আমার যেহেতু একটা চান্স এসেছে, সেটা কাজে লাগানো উচিত।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

আপনি যখন এইউডব্লিউ-তে ভর্তি হলেন, একদম অন্যরকম পরিবেশ। রুমমেটরা ফরেনার, প্রফেসররা ফরেনার। কিভাবে সামাল দিতেন? এখন কতটা কনফিডেন্স ফিল করেন?

রুনা আক্তার: যখন ইউনিভার্সিটিতে আসি, টোটালি একটা ডিফারেন্ট এনভায়রনমেন্ট, অনেক কালচারের মেয়েরা এখানে। আমি বুঝতে পারছিলাম না আমি আসলে স্বপ্নের মধ্যে আছি না কিসের মধ্যে আছি। আমাদের ফাউন্ডেশন কোর্স থাকে, যেখানে স্পিকিং, রাইটিং এবং রিডিংয়ের ওপর জোর দেওয়া হয়। সেই কোর্স গুলোই আমাকে কনফিডেন্স দিয়েছে। এখানে অনেক বেশি পরিশ্রমী হতে হয়। এইউডব্লিউ শুধু পড়াশোনা শেখাচ্ছে না, আমাদের শেখাচ্ছে কিভাবে লিডারশিপ নিতে হবে। পেপার লেখা, প্রেজেন্টেশন মেকিং, রিপোর্ট লিখে-এগুলোর দিকে আমাদের জোর বেশি দেওয়া হয়। এমনভাবে প্রেশার দেয় যেন আমাদের কনফিডেন্স লেভেল যার থাকবে না, সেই মানুষটাও এখানে এসে বুঝতে পারে যে, না আমি পারব।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

আপনি জনস্বাস্থ্য বিভাগে পড়ছেন। আপনার প্রফেশনাল ড্রিমটা কি?

রুনা আক্তার: আমি চাই, প্রত্যন্ত এলাকাতে যেখানে মানুষ যেয়ে কাজ করতে চায় না, আমি সেখানে কাজ করতে যেতে চাই। আমাদের গ্রামে এখনো প্রত্যন্ত এলাকাতে দেখা যায়, মেয়েরা ম্যাটারনাল হেলথটা কী, সেটা জানে না। আমি চাই, এডোলেসেন্স ছেলে-মেয়ে এবং ম্যাটারনাল হেলথের দিকে কাজ করতে। এই রিলেটেড এনজিওতে আমি কাজ করতে চাই।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

পাশাপাশি আপনি উদ্যোক্তা হতে চান, আপনার উদ্যোগটা কিসের?

রুনা আক্তার: আমাকে আপনারা যে বৃত্তিটা দিয়েছেন, সেটা থেকে কিছু টাকা জমিয়ে আমি ছোটখাটো একটা ব্যবসা শুরু করেছি-ফার্মিং সাইডে। আমি দেখেছি, আমাদের গ্রামের যারা কৃষক, তারা যদি আধুনিক পদ্ধতিতে কৃষি কাজ করেন, তাহলে বেশি লাভবান হতে পারবেন। আমি সেটা করি এবং ১০ জনকে দেখাই যে, এভাবে কাজ করলে ভালো হবে। আমি ইতিমধ্যে দুটি গরু দিয়ে শুরু করেছি এবং ছাগলের ফার্ম দেওয়ারও ইচ্ছা আছে। আমি চাই আমার গ্রামে যেন বেকারত্ব না থাকে।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

নতুন অদ্বিতীয়াদের আপনার কী পরামর্শ?

রুনা আক্তার: সারভাইভ করা শেখো। ভেতরে যে একটা শক্তি আছে আমাদের, সেটা নিয়ে কাজে নামতে হবে এবং কখনো মনে করা যাবে না যে আমি পারব না। আমি যখন পারব, এটা ভেবে আগাতে থাকব, তখন সামনে অনেকগুলো রাস্তা পেয়ে যাব। একটু এগোলেই কোনো না কোনো সমাধান পেয়ে যাবেন। সাহস রাখতে হবে, স্বপ্ন দেখতে হবে, স্বপ্ন দেখা বন্ধ করা যাবে না। আপনি যে পরিস্থিতিতে আছেন না কেন, আপনার থেকে অনেক খারাপ পরিস্থিতিতে মানুষ আছে, সেটা চিন্তা করে এগিয়ে যান।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

অনেক ধন্যবাদ রুনা। আপনার সব স্বপ্ন পূরণ হোক, এবং লাল গাড়ির স্বপ্নটা অবশ্যই পূরণ হোক। আপনি অনেক ভালো থাকবেন।

রুনা আক্তার: থ্যাংক ইউ আপু। আপনাদেরকে অনেক ধন্যবাদ এবং প্রথম আলোকে বিশেষ করে অনেক অনেক ধন্যবাদ। আমাকে আজকের রুনা হতে সাহায্য করেছে, সেটা আসলে আমার জন্য অনেক বড় আশীর্বাদ।