সাক্ষাৎকার

নিজ সমাজ ও দেশের জনস্বাস্থ্য খাতে কাজ করার স্বপ্ন উম‍্যেচিং মারমার

প্রথম আলো ট্রাস্টের একটি নিয়মিত আয়োজন হলো ‘অদ্বিতীয়ার গল্প’। এ আয়োজনে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া একজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনলাইন এই আয়োজনে ২০২৫ সালের ২৮ আগস্ট বিকেলে ৫টায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল খাগড়াছড়ি মেয়ে উম্যেচিং মারমাকে। তিনি তাঁর পরিবারের প্রথম কোনো সদস্য যিনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছেন। তিনি চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকে সদ্য স্নাতক (সম্মান) শেষ করেছেন। পরিবারের প্রথম নারী হিসেবে স্নাতক পর্যায়ে যাওয়া এবং তাঁর স্বপ্নের কথাগুলো ওঠে এসেছে এ অনুষ্ঠানে। আয়োজনটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সভাটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা। প্রশ্ন উত্তর আলোকে অনুষ্ঠানের চুম্বক অংশ নিয়ে লিখেছেন মো. নাজিম উদ্দিন।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

অনুষ্ঠানে স্বাগত আপনাকে, কেমন আছেন?

উম্যেচিং মারমা: ভালো আছি আপু। আপনি কেমন আছেন?

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

ভালো আছি। অভিনন্দন প্রথমেই গ্র্যাজুয়েশন শেষ হলো। আমরা স্বপ্নের কথা শুনব। আমরা সংগ্রামের কথা শুনব। ছোটবেলাটা কেমন ছিল?

উম্যেচিং মারমা: সবাইকে নমস্কার। ছোটবেলাটা বলতে গেলে অনেক ভালোই ছিল আমার। কারণ আমি হচ্ছি আমার দাদি-নানিদের সঙ্গে থাকতাম এক সাথে। তখন তো আমাদের কাছে ফোন ছিল না। এ রকম কিছু ছিল না। ফ্রেন্ডের সঙ্গে খেলাধুলা করতাম। এভাবে আমাদের সময়টা চলে যেত। তারপরে আমার আব্বু সিদ্ধান্ত নেন যে আমরা আলাদা সংসার করব। তখন দাদা-দাদি, নানা-নানির সঙ্গে যে একসঙ্গে থাকাটা হয়নি। তখন কিছুটা কষ্ট হয়েছিল। তবে আমার বাবা-মা কখনো আমাদের কাছে কষ্টের বিষয়গুলো তুলে ধরেনি। বাবা কৃষক ছিলেন। পাহাড়ে কৃষি কাজ কতইবা আয় করা যায়। সেটা দিয়েই আমার চলি।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

এইউডব্লিউর খবরটা পেলেন কি করে? তার আগে আরেকটা প্রশ্ন করে নেই সেটা হলো, আপনি তো খাগড়াছড়ির মেয়ে। খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রামে পড়তে আসা বাবা-মা পারমিশন দিলেন? কিংবা আত্মীয়-স্বজন কিংবা পাড়া-প্রতিবেশী আমাদের আশপাশে যারা থাকেন তারা বিষয়টা খুব সহজে মেনে নিলেন যে আমাদের মেয়ে খাগড়াছড়ি থেকে চট্টগ্রামে গিয়ে পড়াশোনা করবে?

উম্যেচিং মারমা: আসলে আমার স্বপ্ন তো এ রকমই ছিল। আমি কোনো একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব বা আমার পড়াশোনা শেষ করে একটা সরকারি চাকরিতে চলে যাব। এ রকমই একটা ছোট স্বপ্ন ছিল সব সময়। তবে প্রতিবেশীরা বলত, মেয়েদের এত কিছু করার দরকার নেই। কারণ মেয়েরা তো অন্য সংসারেই চলে যাবে। কিন্তু আমার মা-বাবা কখনো এ রকম বলেনি। তারা বলত, তুমি যা করার করো। আর চট্টগ্রামে আসাটা বলি, একচুয়ালি আমি যখন ছোট ছিলাম তখন আমরা চট্টগ্রাম বা ঢাকাকে বিদেশি ভাবতাম। আমরা বলতাম যে, ও বিদেশে যাচ্ছে। যেমন আমার কাজিন যখন ঢাকায় প্রথমে পড়তে যায়। আমরা তখন বলি, বিদেশে যাচ্ছে সে। আমাদের রিলেটিভরা বলত বিদেশ থেকে কখন আসছ—এ রকমই ছিল। সুতরাং আমি যখন জানতে পারি যে, আমি চট্টগ্রামে পড়ব। তখন এটা কাইন্ড অফ আমার জন্য বিদেশ-ই ছিল। চট্টগ্রামে এসেই না জানলাম যে, চট্টগ্রামের বাইরে আরও বিদেশ আছে।

আমার এক মামা ছিলেন, উনি আমার আম্মুকে এসে বললেন যে, "কেন পড়বে চট্টগ্রামে গিয়ে? ওকে নার্সিং পড়াও বা কিছু একটা পড়াও যেন চাকরি হয়ে যায় তাড়াতাড়ি।’ কিন্তু আমার বাবার কিছু স্বপ্ন ছিল আমাকে নিয়ে। কিন্তু আমি যখন এখানে ভর্তির সুযোগ পাই, তাঁরা অনেক খুশি ছিলেন। কারণ এটা ছিল ফুল ফ্রিতে। এবং আমি ইন্টারন্যাশনালে পড়ব, বিদেশিদের  সঙ্গে। এটা একটা অনেক বড় অপারচুনিটি ছিল আমার জন্য। তবে আমি এই ইউনিভার্সিটি সম্পর্কে আগে কখনো জানতাম না। আমাদের মং রাজা স্ত্রী উনি এই ইউনিভার্সিটি থেকেই পড়ে বের হয়েছেন। ওনার কাছ থেকে জেনে এবং ইন্সপায়ার হয়ে এই এইউডব্লিউ সম্পর্কে জানা এবং পড়তে আসা বলতে গেলে।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

আপনি বলছিলেন যে আপনার ছোটবেলা থেকেই পড়াশোনাটা চালিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল, স্বপ্ন ছিল। এই বাস্তবতা নিয়ে আসা উম্যেচিং মারমা এখন কী স্বপ্ন দেখে?

উম্যেচিং মারমা: আমি সব সময় বলতাম বিদেশে যেতে চাই, যেমন ঢাকা, চট্টগ্রামে যাইতে চাই। তো এখন এখানে এসে আসলেই আমি বিদেশে যাইতে চাই। সত্যি কথা, বিদেশে যাইতে চাই। কারণ অবশ্যই ওখানে আমাদের বাংলাদেশের থেকে আরও বেশি কিছু শিখতে পারব, অনেক কিছু জানতে পারব। তো ওইটা নিয়ে হচ্ছে আমি এসে এখানে কিছু করতে পারব, এটা ভাবলে অনেক ভালো লাগে। কারণ ওদের থেকে তো অনেক কিছুই শিখে আসব আমি। তারপর আমি অনেক কিছু করতে পারব আমাদের দেশের জন্য, সমাজের জন্য।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

নিশ্চয়ই। আর এখন যে আপনি সত্যি সত্যি বিদেশ যেতে চান উচ্চশিক্ষার জন্য, মাস্টার্সের জন্য নিশ্চয়ই দেশের বাইরে যেতে চান। বাবা-মা এখন কি বলেন?

উম্যেচিং মারমা: আমার বাবা-মা তো এখানে যখন থেকে পড়া শুরু করছি, তখন থেকে ওদের স্বপ্ন আমি বিদেশে যাব। তারা আমাকে বিদেশে দেখবে। তারপর আমার আম্মুর খুব বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা। লাইক উনি বাইরের দেশ ঘুরবে, দেখবে। ওনার হচ্ছে অনেক বাগান বা ফুল পছন্দ। উনি চায় অনেক রকমের ফুল দেখবে বিদেশে গিয়ে। সো আমার আমার ইচ্ছা এটাই যে আমি যাব এবং আমি আমার প্যারেন্টসকে নিয়ে যেতে পারব আমার সঙ্গে কোনো একদিন।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

নিশ্চয়। এবং আপনার সেই উচ্চ শিক্ষার যে স্বপ্নটা সেটা পূরণ হোক এবং আপনি ফিরে এসে সত্যি সত্যি জনস্বাস্থ্য নিয়ে যেহেতু পড়াশোনা করেছেন, দেশের জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করবেন, আমাদের সেই শুভকামনা থাকবে। আবারও একটু গল্পটাতে ফিরে যাই। বাংলা মিডিয়াম থেকে আমরা সবাই পড়াশোনা করে বেরিয়েছি। আপনি নিশ্চয়ই তার ব্যতিক্রম নন। এখানে এসে যখন দেখলেন সবকিছু ইংরেজিতে, তখন কি মনে হয়েছে যে কোথায় আসলাম? কেন আসলাম?

উম্যেচিং মারমা: আমাদের ক্লাস ছিল অনলাইনে, তখন করোনা টাইমে ছিল। ফার্স্ট ক্লাস যখন করি, মানে অনেক কষ্ট হয়েছিল বুঝতে যে তাঁরা কি বলতেছেন। কারণ অনেক ফরেনার ছিল ক্লাসরুমে। ওরা সবাই কমিউনিকেট করছিল, প্রফেসরের সঙ্গে কথা বলতেছিল। আর আমি এমন জায়গা থেকে বড় হয়েছি যেখানে হচ্ছে আমরা কখনো স্যার জিজ্ঞেস করি না গিয়ে। আর বাংলায় করি নাই, ইংলিশে তো অনেক টাফ। সো ওখানে গিয়ে আমার মনে হলো আমি কি করছি? মানে আমি কি ক্লাসে আছি? একজন প্রফেসর ছিল। উনি আমাকে অনেক সাপোর্ট করছেন। উনি ক্লাসে আমাকে ডেকে ডেকে পড়া জিজ্ঞেস করতেন। তো আমার মনে হয়েছে যে, এ রকম প্রফেসর যদি আমাদের লাইফে থাকে, আমরা যে এখানেই যাই, যেটা ইংলিশ হোক বা অন্য ল্যাঙ্গুয়েজ হোক, আমার মনে হয় আমরা অতিক্রম করতে পারব।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

তাহলে যদি কনফিডেন্স মিটারে আসি তাহলে এইউডব্লিউতে আসার সময় উম্যেচিংয়ের কনফিডেন্স কত ছিল? আর আজকে যখন গ্র্যাজুয়েশন করে বাড়িতে যাচ্ছেন, তখন আপনার কনফিডেন্স লেভেল কত? ১০-এ কত নম্বর দেবেন উম্যেচিং নিজেকে?

উম্যেচিং মারমা: আমার মনে হয় আমি যখন আসছি আমার কনফিডেন্স ছিল মাইনাস জিরো। আর এখন অবশ্যই ১০। আর আসলে এইউডব্লিউ আমাদের অনেক কিছুই শিখিয়েছে। এটার জন্য অনেক কৃতজ্ঞ। যেমন সব বাংলাদেশিদের বিদেশি শিক্ষার্থীদের সঙ্গে রাখেন। যেন আমরা ওদের সঙ্গে কথা বলতে পারি, ওদেরকে জানতে পারি। তো আর এদিক থেকে আমি অনেক লাকি ছিলাম। আমি যখন থেকে আসছি আমার রুমমেটগুলো খুব ভালো ছিল, খুব মিশুক ছিল। আর আমার মনে হয় আমি কাইন্ড অফ ফ্রেন্ডলি একটা মানুষ। এ জন্য হচ্ছে আমি খাপ খাওয়াতে পেরেছি। যারা আমার রুমমেট ছিল, অনেকেই গ্র্যাজুয়েট হয়ে চলে গেছে। তারপরও ওদের সঙ্গে এখনো কথা হয়। ওরা অনেক কিছু শেয়ার করে। ওরা কেউ কেউ ইন্টার্নশিপ করছে হংকংয়ে, কেউ কেউ থাইল্যান্ড। ওরা অনেক কিছু শেয়ার করে। আমাদের মোটিভেশন দেয়।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

এখন যারা অদ্বিতীয়া আছে তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কি?

উম্যেচিং মারমা: আমার মনে হয় এইউডব্লিউতে যারা আসে, যে মেয়েগুলো আসে, ওরা অনেক স্ট্রং হয়। আমি হয়তো স্ট্রং ছিলাম না এনাফ, বাট আমি দেখেছি যারা আসে বা আছে, ওরা অনেক স্ট্রং। মেন্টালি ওরা অনেক স্ট্রং। আর এইউডব্লিউর কমিউনিটি এমন যে ওরা মেন্টালি স্ট্রং করে। করে দেয় অলরেডি। আমার তো ওদের প্রতি কিছু বলার নাই। কিন্তু যদি কিছু বলার থাকে, এইটুকু বলব যে, নেভার গিভ আপ। আমরা কখনোই থেমে থাকব না। যেমন, মেয়ে হিসেবে আমরা অনেক কিছু থেকে পিছিয়ে থাকি বা রাখা হয়। এইউডব্লিউ আমাদের এমন সুযোগ করে দিয়েছে যে আমরা কিছু একটা করতে পারি নিজ থেকে। আমাদের উচিত ওই সুযোগটা পুরোপুরিভাবে ব্যবহার করা এবং আমরা কখনোই হেরে যাব না। আমরা দেখিয়ে দেব আমরা মেয়েরা অনেক কিছু করতে পারি। এবং অবশ্য ওদের যদি কোনো হেল্প লাগে, এজ এ সিনিয়র আমি তো আছি। আমি চাই ওরা আমার সঙ্গে এসে কথা বলুক, আমার সঙ্গে শেয়ার করুক।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

একদম শেষ প্রশ্ন, সেটি হলো যে এত চাপের মধ্যে মাঝেমধ্যে মনে হয় কিনা যে এত প্রেশার, আমি সামলে নিতে পারছি না। তো সেই সময়টাতে নিজেকে সাহস দেওয়ার বা ভেঙে না পড়ার বা একটু আগে আপনি বলছিলেন 'নেভার গিভ আপ', অনেক প্রেশারের মধ্যেও আমি নিজেকে কিভাবে এই মেসেজটা দিতে পারি 'নেভার গিভ আপ'।

উম্যেচিং মারমা: এই যে প্রথমে আমি বলেছি, এইউডব্লিউর কমিউনিটি যেটা আছে, ওরা কিন্তু অনেক স্ট্রং। আর সেকেন্ড থিং, আমার কখনো এ রকম ফিল হয় নাই। কারণ আমার রুমমেট বা ফ্রেন্ডস, ওরা সব সময় আমাকে হেল্প করেছে। আমি যদি কিছু চাই, আমি আমার সিনিয়রদের কাছে যাই, সাজেশন নিই। তারা সব সময় আমাকে মোটিভেশন দেয় যে, "পারবা তুমি। " আমি এমনও দেখেছি এইউডব্লিউতে ওরা এক সাথে দুই-তিনটা পরীক্ষা দিচ্ছে। তারপরেও ফ্রি টাইমে ওরা আরও অন্য কিছু করছে। ওরা যে সারা দিন ফোন ইউজ করে, এমন না। ওরা ফ্রি টাইমটাও কাজে লাগাচ্ছে। তাঁদের দেখেই মোটিভেশনটা চলে আসে যে, আমার গিভ আপ করা যাবে না।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

যখন কোনো সাহায্য প্রয়োজন হয়, তখন কারও কাছে সাহায্য চাওয়া, সহযোগিতা চাওয়া, এতে করে সমাধানের একটা পথ খুঁজে পাওয়া যায়। হাল ছেড়ে না দিয়ে, হেরে না যেয়ে কারও কাছে সহযোগিতা চাওয়া, সেটা অনেক বুদ্ধিমানের কাজ। সেটা বোধয় এইউডব্লিউ চর্চার মধ্যে তার শিক্ষার্থীদের শিখিয়ে দেয়। অনেক শুভেচ্ছা উম্যেচিং আপনাকে আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য। আপনি আজকে বাড়িতে যাচ্ছেন স্নাতক শেষ করার পরে প্রথমবারের মতো বাড়িতে যাচ্ছেন। আপনার জন্য শুভকামনা এবং আমাদের পক্ষ থেকে আপনার বাবা-মাকে শুভেচ্ছা জানাবেন। এবং আপনার সমস্ত সুন্দর স্বপ্ন পূরণ হোক এই শুভকামনা।

উম্যেচিং মারমা: আপনাদেরকেও অনেক ধন্যবাদ এমন একটা সুযোগ করে দেওয়ার জন্য যেখানে আমরা আমাদের গল্পটা বলতে পারি।