মিরপুরে একটা ভাড়া বাসায় থাকেন তানিয়ারা। আশপাশের অনেকেই তানিয়াদের চেনেন। বাবা সবজি বিক্রেতা। তাঁর সামান্য আয়ে চলে পুরো সংসার। মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে নেওয়াটা বাবার পক্ষে আর সম্ভব হচ্ছিল না। ষষ্ঠ শ্রেণিতে ওঠার পর তাঁর পড়াশোনা বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। নতুন স্কুলে ভর্তি হওয়ার স্বপ্নটা তছনছ হওয়ার উপক্রম দেখে ভেঙে পড়লেন তানিয়া আক্তার। প্রতিবেশী স্থপতি ইকবাল হাবীব তানিয়ার পড়াশোনার আগ্রহের কথা জানতে পেরে পাশে দাঁড়ান তিনি। পড়াশোনার দায়িত্ব নেন। উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনার খরচ বহন করেন ইকবাল হাবীব। স্নাতকে পর্যায়ে চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে (এইউডব্লিউ) ভর্তির সুযোগ পান তানিয়া। একই সঙ্গে আবেদন করেন আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্ট ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তির জন্য। পরিবারের বড় মেয়ে হিসেবে ২০১৭ সালে পেয়ে যান ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি। এই শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে এই বছর অর্থনীতিতে স্নাতক পর্যায় শেষ করেন। এখন আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের মানবসম্পদ বিভাগে ইন্টার্ন হিসাবে কাজ করছেন। আত্মবিশ্বাসী তানিয়ার স্বপ্ন একজন সফল উদ্যোক্তা হওয়া। সেই গল্পই ওঠে আসল ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, বুধবার, বিকেল ৫টা ৩০মিনিট ‘অদ্বিতীয়ার গল্প’ নামক অনলাইন অনুষ্ঠানে। প্রথম আলো ট্রাস্ট এই অনলাইন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
পাঁচ বছর আগের তানিয়া আর এখনকার তানিয়া পুরো আলাদা। এখন আমি লিড দিতে জানি। নিজে কিছু করার সাহস করি। এইউডব্লিউ শিখিয়েছে যে— আমার নিজের কাজ একান্ত নিজেরই। নিজের সমস্যা নিজেকেই সমাধান করতে হবে। এইউডব্লিউ সব সময় লিডার হতে শেখায়।
তানিয়া আক্তারের পথ চলার গল্পটা জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার পথ চলাটা অনেক কঠিন ছিল। অনেক উত্থান-পতন দেখে এসেছি। এ বছর এইউডব্লিউ থেকে স্নাতক শেষ করি। এইউডব্লিউতে আপনাদের মাধ্যমে বৃত্তি পেয়ে পড়াশোনা করেছি। আমার নিজের একটা পরিচয় তৈরি হয়েছে। এ জন্য প্রথম আলো ও আইডিএলসিকে অনেক ধন্যবাদ।’
আরও যোগ করে বলেন, ‘বাংলা মাধ্যম থেকে ইংরেজি মাধ্যমে গিয়ে অনেক সমস্যা হয়েছে আমার। প্রথমে আমাকে এক্সেস একাডেমিতে দিয়ে দেয়। কিন্তু আমি পেরে উঠতে পারছিলাম না। পরে আলোচনা করে প্রি-এক্সেস একাডেমিতে দেওয়া হয়। এখান থেকে আস্তে আস্তে নিজেকে প্রস্তুত করেছি। আমার রুমমেট ছিল বিদেশী। সেও অনেক হেল্পফুল ছিল। পরে সবমিলে মনে হলো—আমি পারব। এবং শেষ পর্যন্ত আমি পেরেছি।’
পাঁচ বছর আগের তানিয়া আর এখনকার তানিয়ার মধ্যে পার্থক্য কেমন অর্থাৎ এইউডব্লিউর ট্রান্সমিশনটা কেমন? এর উত্তরে তানিয়া জানান, পাঁচ বছর আগের তানিয়া আর এখনকার তানিয়া পুরো আলাদা। এখন আমি লিড দিতে জানি। নিজে কিছু করার সাহস করি। এইউডব্লিউ শিখিয়েছে যে— আমার নিজের কাজ একান্ত নিজেরই। নিজের সমস্যা নিজেকেই সমাধান করতে হবে। এইউডব্লিউ সব সময় লিডার হতে শেখায়।’
এই প্রসেসটা কেমন জানাতে চাইলে জানান, এইউডব্লিউর পরিবেশটাই এমন। পারস্পরিক সহযোগিতার পরিবেশ। চাপ দিয়ে নয়, সব সময় সহজ করে দেয়। যেমন পরীক্ষার সময় অনেকেই মানসিক স্ট্রেসে থাকে। তাই স্ট্রেস কাটানোর জন্য পরীক্ষার আগে মানসিক চাপ কামানোর জন্য আমার মনোবিদের সঙ্গে কথা বলি। তখন অনেক সহজ হয়ে যায়।’
আমার জন্য কোন কাজটা ভালো হবে সেটাই করতে হবে। কোনো কাজ ফেলে রাখা যাবে না। জীবনটা যুদ্ধের। যুদ্ধটা জয় করতেই হবে। আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।
এইউডব্লিউর ভর্তি পরীক্ষার ধরনটা কেমন জানতে চাইলে বলেন, এখানে নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত আকারের প্রশ্ন হয়। লিখিত পরীক্ষা ফ্রি-হ্যান্ড রাইটিং বেশি থাকে। এখানে উত্তীর্ণ হলে মৌখিক পরীক্ষার জন্য ডাকা হয়। পরে মেডিকেল পরীক্ষা করে চূড়ান্ত ভর্তির সুযোগ দেওয়া হয়।
স্বপ্ন কি? এর উত্তরে বলেন ,‘ আমি এখন ইন্টার্ন করছি। তবে আমার ইচ্ছা উদ্যোক্তা হওয়ার। আমি শুধু নিজের জন্য নয়, অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে চাই। আমি যদি সফল হতে পারি তবে আমার আশপাশের অনেককে সহায়তা করতে পারব। রান্না করা আমার খুব ভালো লাগে। তাই আমি একটা রেস্টুরেন্ট দিতে চাই।’
এই যুদ্ধর জন্য কতটুকু প্রস্তুত? দৃঢ়তার সহিত বলেন, ‘রান্নার বিষয়ে আমি আত্মবিশ্বাসী। আমি পারব—এই মনোবল আমার আছে। এখন আমার দরকার—সাহায্য সহযোগিতা ও পরামর্শ। ঝুঁকি ছাড়া সফলতা আসে না। ঝড় দেখে স্বপ্ন দেখা বাদ দেব না। ঝড় পাড়ি দেওয়ার আনন্দটা পেতে চাই।’
এ ক্ষেত্রে বাবা-মা কি বলে... আমার উপর আস্থা আছে তোমার মন যা চায়, তা কর। মন যেটা বলে সেটা করো। আমাদের দোয়া আছে। কেননা একটা কাজে আগ্রহ থাকলে মনে হবে— এটা আমার কাজ, কিছু একটা করতেই হবে, এই তাগিদ থাকবে।
এখন যাঁরা অদ্বিতীয়া আছেন, তাঁদের জন্য পরামর্শ কি? এ ক্ষেত্রে তানিয়া দৃঢ় চিত্তে বলেন, ‘ভয়কে জয় করতে হবে। আমার জন্য কোন কাজটা ভালো হবে সেটাই করতে হবে। কোনো কাজ ফেলে রাখা যাবে না। জীবনটা যুদ্ধের। যুদ্ধটা জয় করতেই হবে। আত্মবিশ্বাসী হতে হবে।’
উল্লেখ্য, নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ২০১২ সাল থেকে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এবং প্রথম আলো ‘ফার্স্ট ফিমেল ইন দা ফ্যামিলি স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ নামে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান শুরু করে। পরিবারের প্রথম নারী অথচ অসচ্ছল, যিনি উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজ গঠনে আগ্রহী, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের এ রকম ১০ জনকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। ট্রান্সকম গ্রুপের সহায়তায় প্রথম আলো ট্রাস্ট এই বৃত্তির ব্যবস্থা করে। ট্রান্সকম গ্রুপের সহায়তায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪২ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছে।
২০১৭ সাল থেকে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড এই শিক্ষাবৃত্তির দায়িত্ব নেয়। নতুনভাবে নামকরণ করা হয় ‘অদ্বিতীয়া’ নামে। আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সহায়তায় ৪৬ জনসহ ২০২১ পর্যন্ত মোট ৮৮ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছে। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনও তাঁদের আবাসন, টিউশন ফি সুবিধাসহ নানা সুযোগ দেয়।
অনুষ্ঠানটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।