একজন সফল ব্যাংকার হতে চান বিন্টি তাঁতী

এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর অর্থনীতি বিভাগে স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী অদ্বিতীয়া বিন্টি তাঁতী।

মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার কেজুরিছড়া চা-বাগানের মেয়ে বিন্টি তাঁতী। মা, ভাই, কাকা, কাকি, কাকাতো দুই ছোট বোনের সঙ্গে থাকতেন তিনি। বিন্টির বয়স যখন সাত মাস তখন তাঁর বাবা আত্মহত্যা করেছিলেন। মা চা-পাতা তুলে তাদের মানুষ করেছেন। তবে বাবার অভাব বুঝতে দেননি বিন্টির কাকা। সব সময় উৎসাহ দিয়েছেন। বাগানের অন্য অনেক মেয়ের মতো আমাকেও তিনি বিয়ে দিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু বিন্টির কাকা চেয়েছেন, বিন্টি পড়ালেখা করে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হোক। কাকার দেওয়া সাহস ও নিজের শক্ত মনোবল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি। নিজের একান্ত চেষ্টায় স্নাতক পর্যন্ত যেতে পেরেছেন। ২০২০ সালে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি পান। শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর অর্থনীতি বিভাগে স্নাতক শেষ বর্ষে পড়াশোনা করছেন তিনি।

আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষা বৃত্তিপ্রাপ্ত চা-বাগানের মেয়ে বিন্টি তাঁতী।

স্নাতক শেষ করে দেশের কোনো একটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করবেন। পরে ব্যাংকের চাকরির পরীক্ষা দেবেন। স্বপ্ন দেখেন একজন সফল ব্যাংকার হওয়ার। পরিবারের প্রথম নারী হিসেবে স্নাতক পর্যায়ে যাওয়া এবং স্বপ্নের কথাগুলো ওঠে এল ৩১ ডিসেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, বিকেল ৫টায় প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়ার গল্প’ অনলাইন অনুষ্ঠানে।

ছোটবেলার গল্প দিয়ে অনুষ্ঠানের শুরু হয়। বিন্টি জানালেন, ‘একদম ছোটবেলায় বাবা মারা যায়। পরে কাকা-কাকির কাছে বড় হয়েছি। ছোট থেকেই পড়াশোনার প্রতি আগ্রহ ছিল আমার। কাকা কাকির ইচ্ছা এবং আমার একাগ্রতায় এইচএসসি পাস করে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু সুযোগ হয়নি। পরে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে পরীক্ষা দিয়ে চা-বাগান কোটায় টিকে যাই। এভাবেই এখানে আসা।

এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের খবর জানলেন কীভাবে? এর উত্তরে বিন্টি বলেন, ‘আমার কাকা কোনো এক দাদার কাছ থেকে চা-বাগানের কোটা সম্পর্কে জানতে পারেন। পরে কাকার কথা মতো আবেদন করি। তখন করোনার সময়। শ্রীমঙ্গলেই পরীক্ষা দিই। কিছুই জানতাম না, তেমন প্রস্তুতিও ছিল না। তারপরও শক্ত মনোবল নিয়ে পরীক্ষা দেই এবং ভাইভার জন্য কল পাই। পরে ভাইভা দিই এবং চূড়ান্ত ভর্তির অনুমতি পাই।’

আমরা যত দূর জানি, করোনার সময় অনলাইনে ক্লাস হয়েছে। ওই সময়টা কীভাবে গেল? উত্তরে বিন্টি জানান, ‘আমার কোনো ফোন ছিল না। যার কারণে ২ সপ্তাহ ক্লাসে অংশ নিতে পারেনি। কীভাবে জয়েন করে সেটাই জানাতাম না। পরে এক বন্ধুর কাছে সব জেনে, ফোনের ব্যবস্থা করে ক্লাসে যুক্ত হই। এদিকে চা-বাগানে নেট থাকত না। স্কুলের ছাদে ওঠে ক্লাস করতাম। দিনের বেলায় অ্যাসাইনমেন্ট জমা দিতে পারতাম না দুর্বল নেটের কারণে। রাতের বেলা জমা দিতাম। অনেক সময় রাস্তায় গিয়ে যেখানে নেট পেত, সেখানে ক্লাস করতাম। মানুষের কথাও শুনতে হয়েছে এর জন্য।’

নিজেকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে হবে। আমি পারব—এই মনোবল থাকতে হবে: বিন্টি তাঁতী।

পরে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হলে ক্যাম্পাসে গেলেন। সেই সময়ের অভিজ্ঞতা কেমন? এর উত্তরে বিন্টি বলেন, ‘অনলাইন আর সরাসরি ক্লাসের অনেক তফাৎ। এখানে সবার সঙ্গে দেখা হওয়া, ফেইস টু ফেইস ক্লাস হওয়া—এটার অনুভূতিই আলাদা। তবে সবকিছু ইংরেজিতে হওয়ায় কিছুটা সমস্যায় পড়তে হয়েছে। আমি বাংলা মাধ্যম থেকে গিয়েছি। তবে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গেছে।’

কখনো কি মনে হয়েছে আর চাপ নিতে পারছি না, পড়াশোনা আর হবে না? অনেক বার মনে হয়েছে। এগুলো মায়ের কাছে বলতাম। কাকুকে বলতে পারতাম না। তবে অনুশীলনের মধ্য দিয়ে সব ঠিক হয়ে গেছে—বললেন বিন্টি।

ক্লাস-পরীক্ষা ও এক্সট্রা-কারিকুলার কাজ কীভাবে সামলে নিতেন? এর উত্তরে বিন্টি বলেন, ‘সবগুলো সাজিয়ে নিতাম। তা ছাড়া এই সবকিছুই সময় হিসাব করে শিডিউল করা হয়। ক্লাস-পরীক্ষায় অংশ নিয়ে অন্যান্য বিষয়গুলোতে যোগ দিতাম। কাজটা একটু কঠিন থাকলেও রুটিন করে প্রায়োরিটি বেসিসে সব করতাম।’

২০২০ এর বিন্টি আর ২০২৫ এর বিন্টির মধ্যে পার্থক্য কি এবং আত্মবিশ্বাসের রেটিং করতে বলেতে কত দেবেন আপনি? বিন্টির সহজিয়া উত্তর, ‘আগে কলেজেও একা যাওয়ার সাহস পেতাম না। এমনকি কোথাও একা যেতে পারতাম না। এখন আমি চট্টগ্রাম থেকে একাই বাড়ি যাই। একা একাই চলতে পারি। সেই সাহসটা হয়েছে, আত্মবিশ্বাসী হয়েছি। আর ১০ নম্বরে রেটিং করতে বললে, ২০২০ এ ৩-৪ এর মধ্যে আর ২০২৫ এ ৮-৯ এর মধ্যে হবে। আমি নিজেকে এখন একজন আত্মবিশ্বাসী নারী মনে করি।’

এখন কি স্বপ্ন দেখেন তিনি? এর উত্তরে বিন্টি বলেন, ‘স্নাতক শেষ করে স্নাতকোত্তর করব। দেশের বাইরেও আবেদন করার ইচ্ছা আছে। তবে দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পেলে স্নাতকোত্তর পরবেন। ব্যাংকার হওয়ার ইচ্ছে আছে আমার। এই ইচ্ছাটা আমার ছোট বেলা থেকেই ছিল। পাশাপাশি চা-বাগানের ছেলেমেয়েদের ইংরেজি ভাষায় দক্ষ করতে কাজ করার দেওয়া ইচ্ছাও আছে।’

এখন যারা অদ্বিতীয়া আছে তাদের উদ্দেশ্যে বিন্টির পরামর্শ হলো, ‘নিজেকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তুলতে হবে। আমি পারব—এই মনোবল থাকতে হবে। পরিবারের কথা চিন্তা করে নিজের ওপর বিশ্বাস নিয়ে এগোতে হবে।’

অনুষ্ঠানটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবাসুলতানা।