সাক্ষাৎকার

টাইম ম্যানেজমেন্ট ও ফোকাস ঠিক করা খুবই জরুরি— শিল্পী কৈরী

প্রথম আলো ট্রাস্টের একটি নিয়মিত আয়োজন হলো ‘অদ্বিতীয়ার গল্প’। এ আয়োজনে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া একজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনলাইন এই আয়োজনে ২০২৫ সালের ১৫ জুলাই বিকেল ৫টায় আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল মৌলভীবাজারের কুলাউড়া উপজেলার ছোট্ট তিলকপুর চা-বাগানের শ্রমিক পরিবারের সন্তান শিল্পী কৈরীকে। তিনি তাঁর পরিবারের প্রথম কোনো সদস্য যিনি বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছাতে পেরেছেন। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) জনস্বাস্থ্য বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। পরিবারের প্রথম নারী হিসেবে স্নাতক পর্যায়ে যাওয়া এবং স্বপ্নের কথাগুলো ওঠে এসেছে এ অনুষ্ঠানে। আয়োজনটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সভাটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা। প্রশ্ন উত্তর আলোকে অনুষ্ঠানের চুম্বক অংশ নিয়ে লিখেছেন মো. নাজিম উদ্দিন।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

এইউডব্লিউতে তিন বছর হয়ে গেছে আপনার। কেমন লাগছে?

শিল্পী কৈরী: অনেক ভালো লাগে আমার। এখানে বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন সংস্কৃতির মেয়েদের সঙ্গে এক সঙ্গে থাকি, খাবার খাই, ক্লাস করি। অনেক কিছু শিখি। শুধু পড়াশোনা নয়, সাংস্কৃতিক বিনিময় হয়। এগুলো খুব ভালো লাগে আমার।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

আপনার ছোটবেলার গল্পটা জানতে চাই। কেমন ছিল আপনার ছোটবেলা?

শিল্পী কৈরী: আমরা পাঁচ ভাইবোন। বাবা চা-শ্রমিক। মা বাড়িতে থাকেন। দুই ভাই ও তিন বোনের মধ্যে আমি সবার ছোট। বাবার একার সামান্য আয়ে সংসার চালানো কঠিন ছিল। তাই বড় ভাইবোনের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেনি। আমিই প্রথম স্নাতক পর্যন্ত এসেছি। ভাইবোনেরা অনেক সহযোগিতা করেছে। বিজ্ঞানের ছাত্রী হিসেবে প্রাইভেট পড়া ও অন্যান্য খরচ হতো। শিক্ষকেরা অর্ধেক বেতন নিতেন। এভাবেই আমি পড়াশোনা করেছি। প্রথমে ব্র্যাকের স্কুলে বিনা মূল্যে প্রাথমিক পর্যায় শেষ করি। মাধ্যমিকে আমার চা-বাগান থেকে ৩ কিমি. দূরে গিয়ে পড়েছি। হেঁটে স্কুলে যেতাম। সকাল ৭টায় বের হয়ে ফিরতে বিকেল হয়ে যেত।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

আপনি এইউডব্লিউর খবর জানলেন কিভাবে?

শিল্পী কৈরী: এইচএসসির পর টাকার অভাবে কোচিং করতে পারিনি। চা-বাগানের এক দাদার মাধ্যমে জানতে পারি এইউডব্লিউর বিষয়ে। পরে আমার এক বান্ধবী জানায় যে, আবেদন চলছে। আবেদন করি, পরীক্ষা দিয়ে চা-বাগান কোটায় টিকে যাই।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

এইউডব্লিউ ক্যাম্পাসে যেহেতু সবই ইংরেজিতে. . বাংলা মাধ্যমে থেকে গিয়ে কোন সমস্যার মুখে পড়েছেন কি?

শিল্পী কৈরী: আমাদের প্রথম সেমিস্টার ছিল অনলাইনে। আমার কোনো ফোন ছিল না। পরে একটা ফোন কিনি। জুম অ্যাপ কি, কিভাবে যুক্ত হতে হয়—এগুলো জানতাম না। আস্তে আস্তে শিখেছি। যখন ক্যাম্পাস খুলে দেওয়া হলো, তখন খাপ খাওয়াতে একটু সময় লেগেছে। এমনি চা-বাগানের মেয়ে, যেখানে কোনো ভালো স্কুল ছিল না। সে জন্য সমস্যা হয়েছে। তবে আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে গেছে।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

এইউডব্লিউতে আসার আগে ও পরে নিজেকে ১০ এ কত নম্বর দেবেন?

শিল্পী কৈরী: আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বেড়েছে। আমি যখন বাগানে ছিলাম তখন মানুষের সঙ্গে কথা বলতাম না, ইনট্রোভার্ট ছিলাম। এখন আমি সবার সঙ্গে কনফিডেন্টলি কথা বলতে পারি। সুতরাং এইউডব্লিউতে আসার আগে আমি আমাকে ১০-এ ৫ দেব। আর এখন আমি নিজেকে ১০-এ ৮ দেব।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

ভীষণ ভালো। এখন একটু স্বপ্নের কথা জানব। কি করতে চান বা কি হতে চান?

শিল্পী কৈরী: আমি জনস্বাস্থ্য নিয়ে পড়ছি। সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ নিয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে চাই। আমার কমিউনিটির লোকদের রোগ নিয়ে গবেষণা করতে চাই। আমাদের চা-বাগানের ওপর তেমন গবেষণা নেই। আর ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে যদি বলি তাহলে, বিভিন্ন বেসরকারি ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান যারা স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করে, সেখানে কাজ করব এবং গবেষণা করব।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

বাবা-মা কি বলেন এখন?

শিল্পী কৈরী: আমার মা-বাবা অনেক বেশি গর্বিত আমাকে নিয়ে। তাঁরা অনেক খুশি। শুধু বাবা-মা নয়, আশপাশের মানুষও আমাকে নিয়ে গর্ববোধ করেন।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

আপনি আরও অনেক সফল হন। নতুন অদ্বিতীয়াদের জন্য আপনার কোনো পরামর্শ আছে কি?

শিল্পী কৈরী: প্রথমেই বলব ফোকাস ঠিক করতে হবে। সবকিছুতে ফোকাস রাখতে হবে। এক্সট্রা-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস করতে হবে। মন ভালো রাখতে হলে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নিতে হবে। টাইম ম্যানেজমেন্ট করতে জানতে হবে। এটা ছাড়া কিছুই এখানে সম্ভব না। প্রথমত একাডেমিক পড়াশোনা এবং দ্বিতীয়ত ক্লাব অ্যাকটিভিটিস, অনলাইন বিভিন্ন কোর্স, লিডারশিপ ইত্যাদির মাধ্যমে নিজেকে তৈরি করতে হবে।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

শিল্পী নিজেকে টাইম ম্যানেজমেন্টে ১০-এ কত দেবে?

শিল্পী কৈরী: আমি খুব সময় মেনে চলি। আমি নিজেকে অবশ্যই ১০-এ ৯.৫ দেব।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

অনেক ধন্যবাদ শিল্পী আপনাকে। আপনি ভালো কিছু করেন। নিজের স্বপ্ন পূরণ করেন—এটাই আমাদের প্রত্যাশা। অনেক শুভকামনা আপনার জন্য।

শিল্পী কৈরী: আপনাদেরকেও ধন্যবাদ আমাকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য এবং আমার পাশে থাকার জন্য।