প্রথম আলো ট্রাস্টের নিয়মিত আয়োজন 'অদ্বিতীয়ার গল্প' অনুষ্ঠানে এ পর্বের অতিথি ছিলেন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনর অর্থনীতি বিভাগে সদ্য স্নাতক শেষ করা অদ্বিতীয়া জেমি নাহার। জেমির বাবা সৈনিক একজন ছিলেন, ২০১৭ সালে অবসরে যান। তাঁর বাবার একার আয়ে তিন ভাইবোনের পড়াশোনা কঠিন ছিল। তিন ভাইবোনের মধ্যে জেমি নাহার বড়। ছোট বোন অনার্স প্রথমবর্ষ, ছোট ভাই ক্লাস সেভেনে পড়েছে।
জেমি তাঁর পরিবারের প্রথম নারী, যে স্নাতক পর্যন্ত যেতে পেরেছেন। জেমি ২০১৮ সালে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি পান। শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) অর্থনীতি বিভাগ থেকে সম্প্রতি স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। এখন স্নাতকোত্তর পড়ছেন। স্বপ্ন দেখে শিক্ষক হবেন। সেই চেষ্টায় এগিয়ে যাচ্ছেন। পরিবারে প্রথম স্নাতক অর্জনকারী জেমির পথ চলার নানা বিষয় ওঠে এল ৩১ অক্টোবর ২০২৩, মঙ্গলবার, বিকেল ৫টায় প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়ার গল্প’ অনলাইন অনুষ্ঠানে।
ছোটবেলার জেমি থেকে আজকের জেমি—পুরো জার্নিটা কেমন ছিল, জানতে চাইলে জানান, ‘বাবা সাধারণ সৈনিক ছিলেন। সে জন্য দেশের বিভিন্ন জায়গায় থাকতে হয়েছে। আমার এগিয়ে যাওয়ার পেছনে মা সব করেছেন। আমার মায়ের ছোটবেলায় বিয়ে হয়ে যাওয়ায় পড়াশোনা তেমন করতে পারেনি। মা চাইতেন আমি যেন ভালোভাবে পড়াশোনা করে বড় কিছু হই। আমিও মায়ের স্বপ্ন পূরণ করতে চেয়েছি। পঞ্চম শ্রেণিতে বৃত্তি পেয়েছি। এসএসসি পাস করে এইচএসসি পড়েছি জয়পুরহাটে। মফস্বলে ভালো শিক্ষক পাইনি, তাই অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিলাম আমি।’
পরক্ষণেই যুক্ত করে জেমি বলেন, ‘আমার মা পিকেএসএফের সদস্য ছিলেন। এইউডব্লিউ পিকেএসএফকে কিছু সুবিধা দেয়। এটা আমার মার মাধ্যমে জানতে পারি। পরে আবেদন করি। এইউডব্লিউতে ইংরেজি ও গণিতে ওপর পরীক্ষা হয়। গণিতে আমি ভালো ছিলাম। সমস্যা ছিল ইংরেজি নিয়ে। পরীক্ষার আগে কিছু সময় পেয়েছিলাম। ওই সময়টাতে ভালো করে ইংরেজির ওপর প্রস্তুতি নিই। এভাবে ইংরেজিতে ভালো করি। পরীক্ষাও ভালো হয়। আমি ভর্তির সুযোগ পাই।’
ভর্তির পরের অভিজ্ঞতা কেমন ছিল আপনার? এর উত্তরে জেমি বলেন, ‘প্রথম যেদিন এইউডব্লিউতে পা রাখলাম, দেখি সবাই ইংরেজিতে কথা বলে। আমি তো বাংলা মিডিয়ামের, তাই জড়তা কাজ করত। কিন্তু শিক্ষক থেকে শুরু করে সবাই অনেক আন্তরিক ছিল, অনেক সহযোগিতা করেছে। এভাবে ক্লাস করতে করতে এক সময় সব শিখে ফেলি। এখানে সবাই সবাইকে রেসপেক্ট করে, কাউকে ভিন্নভাবে দেখে না।’
স্বপ্নের কথা বলতে গিয়ে জেমি বলেন, ‘আমি ছোটবেলা থেকেই শিক্ষক হতে চাইতাম। এইউডব্লিউতে গিয়ে এই ইচ্ছাটা আরও বেড়েছে। কারণে এখানে শিক্ষার পরিবেশ, পড়ানোর ধরন অনেক উন্নত এবং আলাদা। পড়াশোনার পাশাপাশি অনেক ধরনের এক্সট্রা-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস শেখানো হয়। এই পরিবেশটা আমি বাংলাদেশে ছড়িয়ে দিতে চাই। আমি মনে করি, শিক্ষকতায় পেশায় নতুন কিছু শেখাতে পারব।
এক্সট্রা-কারিকুলার অ্যাকটিভিটিস কীভাবে সহায়তা করে? এর উত্তরে জেমি বলেন, ‘ক্লাবগুলোতে যুক্ত থাকলে অনেক ধরনের কর্মকাণ্ড করতে হয়, অনেক সঙ্গে কথা বলতে হয়। এতে অনেক কিছু শেখা হয়, সময় ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সম্যক জ্ঞান লাভ করা যায়। চাকরি ও ব্যক্তি জীবনে কাজে দেয়।’
মায়ের অনুভূতি কেমন জানতে চাইলে জানান, এখনো অনেক পথ বাকি। তারপরও মা অনেক খুশি। অনেকেই বলেছে, জয়পুরহাট থেকে চট্টগ্রাম গিয়ে এই মেয়ে পারবে না। কিন্তু মা সব সময় সাপোর্ট করেছে, বলছে—ও পারবে। বাবাও খুশি। এখন এইউডব্লিউতেই স্নাতকোত্তর পড়ছি। মা এখনো সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন ঠিক আগের মতোই। আর আমিও ধীরে ধীরে স্বপ্নপূরণের পথে এগোচ্ছি। ধন্যবাদ আমার পাশে থাকার জন্য।
উল্লেখ্য, নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ২০১২ সাল থেকে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এবং প্রথম আলো ‘ফার্স্ট ফিমেল ইন দা ফ্যামিলি স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ নামে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান শুরু করে। প্রতিবছর পরিবারের প্রথম নারী অথচ অসচ্ছল, যিনি উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজ গঠনে আগ্রহী, এ রকম ১০ জনকে ট্রান্সকম গ্রুপের সহায়তায় এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে এ শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া শুরু করে প্রথম আলো ট্রাস্ট। ট্রান্সকমের সহায়তায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪২ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন।
২০১৭ সাল থেকে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড এই শিক্ষাবৃত্তির দায়িত্ব নেয়। নতুনভাবে নামকরণ করা হয় ‘অদ্বিতীয়া’ নামে। আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সহায়তায় ৫৬ জনসহ ২০২২ পর্যন্ত মোট ৯৮ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনও তাঁদের আবাসন, টিউশন ফি সুবিধাসহ নানা সুযোগ দেয়।
অনুষ্ঠানটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।