নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকিয়েছেন, এখন পড়ছেন আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে
নওগাঁর মান্দা থানার সোহানা আক্তার নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে এখন এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিজ্ঞানে স্নাতক শেষ বর্ষে অধ্যয়নরত। তিনি গ্রামের প্রথম মেয়ে হিসেবে এই সাফল্য অর্জন করেন এবং শিক্ষার মাধ্যমে সামাজিক পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখেন।
'অদ্বিতীয়ার গল্প' অনুষ্ঠানে অতিথি হিসেবে এসেছিলেন নওগাঁর মান্দা থানায় দুর্গাপুর গ্রামের মেয়ে সোহানা আক্তার। তিনি ২০১৯ সালে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থী। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের (এইউডব্লিউ) জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি যখন মাধ্যমিকের শিক্ষার্থী ছিলেন, তখন নিজের বাল্যবিয়ে তিনি ঠেকিয়েছেন। কারণ তিনি পড়াশোনাটা করতে চান। এ সব নানা ধরনের প্রতিকূলতা পেয়ে কীভাবে অদ্বিতীয়া হয়ে উঠলেন, সেই ওঠে এল ৩০ এপ্রিল ২০২৪ তারিখ 'অদ্বিতীয়ার গল্প' অনুষ্ঠান।
নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকানোর বিষয়ে সোহানা বলেন, ‘নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় বিয়ে প্রায় হয়েই গেছিল। গ্রামের বেশির ভাগ মানুষ শিক্ষিত না। আত্মীয়স্বজন ও প্রতিবেশীরা তাঁকে বিয়ে দিতে বলেন। বলে যে, এত পড়াশোনা করিয়ে কি হবে—গরুর গোবর তো ফেলতেই হবে! এমন অবস্থায় বাবাও রাজি হয়ে গেছিল। তবে তাঁর মা তখন রাজি হয়নি। পড়াশোনায় ভালো ছিলাম আমি। এদিকে মায়ের বিয়েও হয়েছিল ১৩ বছর বয়সে। তাই মা চাননি তার মতো তাঁর মেয়েরও এই অবস্থা হোক। তা ছাড়া আমিও সবার বিরুদ্ধে গিয়ে আমার নিজের বিয়ে ঠেকিয়েছি।’
এখন মেয়ে স্বনামধন্য একটি আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ছে, বাবা-মা কেমন ফিল করেন? এর উত্তরে সোহানা বলেন, ‘মা অনেক খুশি। মা বলেন, তুমি তো পড়তে পারছ। এখন তোমার অনেক দায়িত্ব গ্রামের প্রতি। বাবাও বলেন, বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল তার। এখন বাবাও আমার জন্য গর্ববোধ করেন।’
সোহানা তাঁর পরিবারের তো বটেই, গ্রামের প্রথম মেয়ে যিনি স্নাতক পর্যায়ে যেতে পেরেছেন। সোহানার ধারণা করেন নওগাঁর মান্দা থানায় প্রথম কোনো নারী আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পেরেছেন, সেটা তিনি।
রাজশাহীর নওগাঁর একটি গ্রাম থেকে চট্টগ্রামের যাওয়ার সাহস কিভাবে হলো জানাতে চাইলে সোহানা বলেন, ‘এইচএসসিতে নওগাঁর সরকারি কলেজে ভর্তি হই। কিন্তু নওগাঁয় মেসে থেকে পড়াশোনা করা সামর্থ্য ছিল না। তাই বাড়ি থেকে প্রতিদিন যেতে হতো বাসে করে। ৯টায় ক্লাস ছিল,৭টা বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতাম। আমি ছোট থেকেই পড়াশোনা ভালো ছিলাম। সে জন্য গ্রামীণ ব্যাংক থেকে বৃত্তি পেতাম। এইউডব্লিউর বিষয়েও জানাতে পারি গ্রামীণ ব্যাংক থেকেই। তারা আমাকে এখানে আবেদন করতে বলেন। তবে এটা নিয়ে আশপাশে অনেক কথা হয়েছে। প্রতিবেশীদের অনেকেই বলেছে, মেয়েদের পড়িয়ে কি হবে, ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে লাখ টাকার স্বপ্ন—ইত্যাদি। এ সময় মা অনেক সাপোর্ট করেছে। এমনকি এইউডব্লিউতে ভর্তির পর মা-ই আমাকে প্রথম ক্যাম্পাসে রেখে আসেন।’
ওই প্রতিবেশীরা কি বলে এখন? উত্তরের সোহানা বলেন, এখনো অনেকে নেতিবাচক কথা বলেন, তবে প্রশংসাও করেন অনেকেই।’
এইউডব্লিউ’র পরিবেশে কীভাবে খাপ খাওয়ালেন? এর উত্তরে সোহানা বলেন, ‘আমি বাংলা মাধ্যমের হওয়ায় প্রথমে সমস্যা হয়েছে। পরে সব ঠিক হয়ে গেছে। আমি চেষ্টা করেছি এবং ওভারকাম করতে পেরেছি। টাইম ম্যানেজমেন্ট ও চর্চার করে ২-৩ মাসের মধ্যেই ভাষাগত সমস্যা দুর করেছি। পরে সবগুলো সেমিস্টারের মধ্যে ৩ টিতে জিপিএ-৪ এ ৪ পেয়েছি।’
ডাবল মেজর করছেন কেন এবং স্বপ্ন কি দেখেন? এর উত্তরে সোহানা জানান, ‘আমি জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ নিয়ে মেজর করছি। এই দুইটা একটা আরেকটার সঙ্গে জড়িত। পরিবেশের বিভিন্ন ইস্যুগুলো কীভাবে স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব ফেলে সেটা নিয়ে গবেষণা করতে চাই। সেই স্বপ্ন নিয়েই এগোচ্ছি। তা ছাড়া আমি যে এলাকা থেকে এসেছি, ওখানে বেশির ভাগ মানুষ অসচ্ছল ও অশিক্ষিত। তারা সচেতন না, প্লাস্টিকের ব্যবহার করে অনেক বেশি। আমার আরেকটা স্বপ্ন হলো, আমার কমিউনিটির মানুষজনকে সচেতন করা, তাদের দিয়ে বায়ো-গ্রেডের পণ্য উৎপাদন করা এবং তাদের জন্য কাজের সুযোগ তৈরি করা। তা ছাড়া গ্রামের মা ও মেয়েদের শিক্ষার দিকে নেওয়া যাতে করে কোনো বল্যবিয়ের শিকার না হয়।’
এখন যারা অদ্বিতীয়া আছে তাদের জন্য সোহানার পরামর্শ, ‘আত্মবিশ্বাস বাড়াতে হবে, টাইম ম্যানেজমেন্ট করা শিখতে হবে। যখন যে কাজ, সেটা করে ফেলতে হবে। নিয়মানুবর্তী হওয়া এবং টার্গেট ঠিক রেখে স্বপ্নের পথে এগোতে হবে।’
শেষে সোহানা জানান, আমি সম্প্রতি ‘টিচ ফর বাংলাদেশ’ নামক একটা প্রতিষ্ঠান থেকে ফেলোশিপ করার অফার পেয়েছি। আমার স্নাতক শেষ হবে আগস্টে, নভেম্বরে ফেলোশিপে যোগ দেব। ওখানে সমাজে বিশেষ করে নারী ও শিশু যার অসমতার শিকার হয় তাদের নিয়ে কাজ করব।
অনুষ্ঠানটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।