স্বপ্ন

বিদেশে স্নাতকোত্তর করে দেশে এসে কাজ করার স্বপ্ন ‘অদ্বিতীয়া’ মনি মুন্ডার

প্রথম আলো ট্রাস্টের একটি নিয়মিত আয়োজন হলো ‘অদ্বিতীয়ার গল্প’। এ আয়োজনে আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি পাওয়া একজনকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। অনলাইন এই আয়োজনে ২০২৫ সালের ০২ মার্চ বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল হবিগঞ্জের চন্ডিছাড়া চা-বাগানের মেয়ে মনি মুন্ডাকে। তিনি বর্তমানে চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের স্নাতক শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী। ২০২০ সালে ‘অদ্বিতীয়া’ বৃত্তি পেয়ে পরিবারের প্রথম নারী হিসেবে স্নাতক পর্যায়ে যাওয়া এবং স্বপ্নের কথাগুলো ওঠে এসেছে এ অনুষ্ঠানে। আয়োজনটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সভাটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা। প্রশ্ন উত্তর আলোকে অনুষ্ঠানের চুম্বক অংশ নিয়ে লিখেছেন মো. নাজিম উদ্দিন।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

চা-বাগান থেকে চট্টগ্রামে আসা, ছোটবেলা—এ বিষয়ে শুনতে চাই।

মনি মুন্ডা: ছোটবেলা বলতে—আমি চন্ডিছড়া চা-বাগান থেকে ওঠে আসা মেয়ে। আমার চার বোন, মা-বাবাকে নিয়ে পরিবার ছিল। বাবা-মা চা শ্রমিক ছিলেন। আমার শিক্ষাজীবনের প্রথমে বাড়ির পাশে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হই। ওখানে পড়াশোনা ভালো হতো না। পরে জানতে পারি পাশেই ব্র্যাকের স্কুলে ভালো পড়াশোনা হয়। ব্র্যাকের স্কুলে ভর্তি হই। ওখান থেকেই প্রাথমিক পর্যায় শেষ করি। এরপর হাইস্কুলে ভর্তি হই। শিক্ষকদের সহযোগিতায় পড়াশোনা করি। নবম, দশম পড়াশোনার সময় একটু কঠিন সময় যায় আমাদের। তারপরও এসএসসি পরীক্ষা দিয়ে পাস করি। কলেজে ভর্তি হই, তবে অনেক দূর ছিল। যেতে আসতে সন্ধ্যা হয়ে যেত। যা হোক অনেক কষ্ট করে যাতায়াত করে বিজ্ঞান বিভাগে পড়া চালিয়ে যাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত পদার্থবিজ্ঞানে ফেল করি। তখন মনে হয়েছিল—আমি হেরে গেছি। তবে সবাই আমার পাশে ছিল। বাবা তখন বলেছে, ‘একবার ব্যর্থ হয়েছ বলে কি হয়েছে, তুমি আবার দাঁড়াবে’। আমি ঠিকই দাঁড়িয়েছি।

চা-বাগানের মেয়েদের পড়াশোনার প্রতি তেমন সাপোর্ট থাকে না। আমার প্রাইমারি পর্যন্ত স্মুথ ছিল। পরে অনেকে বলেছে, ‘এত পড়িয়ে কি হবে! বাগানে মেয়ে, বিয়ে হবে, একদিন বাগানেই কাজ করবে।’ কিন্তু এ ক্ষেত্রে আমার বাবা-মা আমাকে বেশ সাপোর্ট করেছে। তা চাড়া সপ্তম শ্রেণি থেকেই টিউশনি করে আমার নিজের খরচ চালিয়েছি।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

 এইউডব্লিউর খবর পেলেন কিভাবে?

মনি মুন্ডা: কলেজে পড়া পর্যন্ত আমি বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। শুধু জানতাম, কোচিং করতে হয়, প্রস্তুতি নিতে হয়। ভর্তি পরীক্ষা নিয়েও কোনো ধারণা ছিল না আমার। ওই সময়ে আমাদের পাশের গ্রামে একটা অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সম্পর্কে একটা লিফলেট পাই। তারপর এক দাদা ভর্তি সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য জানান আমাকে। কয়েক জায়গায় পরীক্ষা দেই, হয়নি। পরে ওই দাদা এইউডব্লিউ সম্পর্কে বলেন। চা-বাগানের মেয়েদের জন্য কোটা আছে শুনে আবেদন করি। পরীক্ষা দেই এবং ভর্তির সুযোগ পেয়ে যাই।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

আপনি ২০২০ সালে ভর্তি হন। তখন করোনা মহামারি চলে। ওই সময়ে আপনাদের ক্লাস শুরু হলো কিভাবে?

মনি মুন্ডা: ভর্তি হওয়ার পর অনলাইনে ক্লাস শুরু হয়। বাড়িতে নেট থাকত না। তখন বাড়ির পাশে, খোলা উঁচু জায়গায় গিয়ে ক্লাসে যোগ দিতাম। অনেক সমস্যা হতো। অ্যাসাইনমেন্ট দিত। করে জমা দিতে হতো। কিন্তু নেটের সমস্যার কারণে অনেক দেরি হতো। তখন আশপাশের মানুষজন নানা কথা বলত। আমি নাকি সারা দিন ফোনে পড়ে থাকি…।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

যখন ক্যাম্পাসে প্রথম আসলেন তখনকার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

মনি মুন্ডা: আমার যেহেতু বাংলা মাধ্যমে ছিলাম, তাই আমাদের জন্য একটু কঠিন ছিল। এখানে যেহেতু বিদেশি মেয়েরা থাকে, তাই সবই ইংরেজিতে বলতে হয়। প্রথমে বেশ জড়তা কাজ করত। পরে সব ঠিক হয়ে গেছে।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি কি করতে হয়?

মনি মুন্ডা: নিয়মিত পড়াশোনার বাইরে বিভিন্ন ক্লাব অ্যাকটিভিটিস, অ্যাসাইনমেন্ট ম্যানেজ করতে হয়। এগুলো নিয়মিত মেনে চলা একটু কঠিন হলেও করতে হয়। কারণ নিজেকে তৈরি করতে ক্লাব অ্যাকটিভিটিস খুবই জরুরি। তা ছাড়া এখানে শারীরিক শিক্ষার জন্য বিভিন্ন ধরনের খেলাধুলার ব্যবস্থা আছে। এই সবই করি। মাঝে মাঝে চাপ বেড়ে যায়, তখন সময় ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে চলি।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

এখনকার মনি আর আগের মনিকে তুলনা করতে বললে নিজেকে ১০-এ কত নম্বর দেবেন?

মনি মুন্ডা: আমি গড়ে নিজেকে ১০-এ ৯ দিব। আমি নিজেকে এগিয়ে নিচ্ছি। কীভাবে নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়, কীভাবে কমিউনিকেট করতে হয়, কোপ-আপ করতে হয়, সেগুলো শিখেছি।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

স্বপ্নে কথা জানতে চাই আপনার?

মনি মুন্ডা: আপাতত স্বপ্ন হলো, স্নাতক শেষ করে দেশের বাইরে গিয়ে স্নাতকোত্তর করব। আর পেশা হিসেবে আমি একজন বন কর্মকর্তা হতে চাই। একজন ভালো মানুষ হতে চাই। নিজ কমিউনিটি তথা দেশের জন্য কাজ করতে চাই। এটাই ইচ্ছা আমার।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

আপনাকে ধন্যবাদ।

প্রথম আলো ট্রাস্ট ও আইডিএলসি ধন্যবাদ আমার স্বপ্নের পথে সাহস যোগানোর জন্য।