‘জীবন মানে স্বপ্ন দেখা, হার না মানা’

আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তিপ্রাপ্ত প্রিয়াংকা মাহালী।

মৌলভীবাজারের সিন্দুরখাঁন চা বাগানের মেয়ে প্রিয়াংকা মাহালী। বড় ৪ বোন আর বাবা-মা, এই নিয়ে প্রিয়াংকার সংসার। মা-বাবা দুজনই চা শ্রমিক। ৫ মেয়েকে যতটুকু সম্ভব পড়াশোনা করিয়েছেন তাঁরা। বড় দুই বোন পঞ্চম শ্রেণি, মেঝো বোন জেএসসি এবং চর্তুথ বোন এইচএসসি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছেন। প্রিয়াংকার এসএসসি পাস করার পর পরই তাঁর বাবা পক্ষাঘাতে আক্রান্ত হয়ে আর কাজ চালিয়ে যেতে পারেননি। মায়ের একার পক্ষে এত বড় সংসার চালিয়ে নেওয়াটাও ছিল কষ্টের। সংসারের এমন পরিস্থিতিতে প্রিয়াংকার মনোযোগ দিয়ে আর পড়াশোনা করা হয়ে ওঠে না। একবার ভাবছিলেন পড়াশোনাই মনে হয় আর হবে না। এসএসসি পরীক্ষার পরের তিনমাস সেলাইয়ের কাজ শেখেন প্রিয়াংকা। সেলাইয়ের প্রতি মেয়ের ঝোঁক দেখে মা তাঁকে একটা সেলায় মেশিনও কিনে দেন। সেই সেলাই মেশিন নিয়ে একটু একটু করে কাজ করতে শুরু করেন প্রিয়াংকা। তিনমাসে নিজের চেষ্টায় যতটুকু কাজ শিখলেন তা পুঁজি করেই সেলাইয়ের ব্যবসা শুরু করেন তিনি।

সেলাই করে যেই টাকা পেতেন সেই টাকা দিয়ে মাকে সহায়তা করেছেন। আবার নিজের পড়াশোনার খরচও চালিয়ে গেছেন। সেলাই মেশিনই তাঁর একমাত্র সম্বল ছিল। কেবল যে বাবা-মাই প্রিয়াংকার মনের সাহস জুগিয়ে গেছেন তা নয়, বড় চার বোন আর দুলাভাইয়েরাও প্রিয়াংকাকে সহায়তা করেছেন। নিজের পরিবার নিয়ে বলতে গিয়ে প্রিয়াংকা বলেন, 'আমার বড় চার বোন এবং দুলাভাইয়েরা আমাকে অনেক সাহায্য করে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে। যখন যেটার প্রয়োজন হতো, তখনি সেটা দিয়ে সাহায্য করত। এখনো করে। আমার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মা-বাবা এবং দিদি দুলাভাইয়েরা। তাঁরা ছোট থেকেই আমাকে মেয়ের মতো দেখে আসছেন। এইচএসসি পাস করার পর আমি পড়াশোনা করতে চাইনি। তাঁরা আমাকে পড়াশোনা করার জন্য জোর দেন। আমি সর্বদা তাঁদের প্রতি চিরকৃতজ্ঞ থাকব।'

আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তিপ্রাপ্ত প্রিয়াংকা মাহালী।

এভাবে পরিবারের সকলের সহযোগিতা আর সাহসে প্রিয়াংকা ভর্তি হন অনার্সে। এমন সময় তিনি জানতে পারেন, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন চা বাগানের মেয়েদের পড়াশোনার জন্য স্কলারশিপ দিচ্ছে। পরিবার ও শিক্ষকেরা প্রিয়াংকাকে সেখানে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে পরামর্শ দেন এবং ভর্তি পরীক্ষা সংক্রান্ত সকল ক্ষেত্রে তাঁকে আন্তরিকভাবে সাহায্য করে যান। তাঁদের প্রচেষ্টা এবং নিজের পরিশ্রমে শেষ পর্যন্ত প্রিয়াংকা সফল হন। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে শিক্ষাবৃত্তি নিয়ে পড়াশোনা করার সুযোগ পেয়ে যান। একই সঙ্গে পেয়ে যান আইডিএলসি-প্রথম আলো ট্রাস্ট অদ্বিতীয়া শিক্ষাবৃত্তিও। পেছনের বাধা পেরিয়ে এখন এগিয়ে যাচ্ছেন তিনি।

প্রিয়াংকাই তাঁর পরিবারের প্রথম মেয়ে যিনি এইচএসসি পাস করে স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনার পথে পা বাড়িয়েছেন। বর্তমানে চট্টগ্রামের এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের পড়াশোনা করছেন প্রিয়াংকা মাহালী। স্বাবলম্বী হয়ে সব সময় নিজের পরিবারের পাশে থাকতে চান প্রিয়াংকা। দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি' বিষয় নিয়ে স্নাতক শেষ করে শিক্ষক হতে চান তিনি। নিজের পথচলার গল্পগুলো ভাগাভাগি করে চা বাগানের শিক্ষার্থীদের সাহস যোগাতে চান তিনি। একজন সাহসী হিসেবে তিনি সকলকে জানাতে চান, ‘জীবন মানে স্বপ্ন দেখা, হার না মানা। আর সাহস নিয়ে চলতে থাকলে একদিন ঠিক স্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দেয়।’ আর সেই ছোটবেলার সেলাইয়ের শখ একেবারে জীবন থেকে হারিয়ে যায়নি। সুযোগ পেলে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের কোর্সটাও করে ফেলতে চায় এই স্বপ্নবাজ অদ্বিতীয়া।