গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার তাজপুর গ্রামের মেয়ে মোছা. হোসনেয়ারা খাতুন। বাবা গ্রাম্য পশু চিকিৎসক, মা গৃহিণী। বাবার অল্প আয়ে সংসার চালানো ও পড়াশোনার খরচ চালানো কঠিন ছিল। অসচ্ছলতা সত্ত্বেও বাধা অতিক্রম করে অদম্য ইচ্ছা নিয়ে এগিয়েছেন হোসনেয়ারা। তিনি ২০১৭ সালে আইডিএলসি ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘অদ্বিতীয়া’ শিক্ষাবৃত্তি পেয়েছেন। শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে সম্প্রতি অর্থনীতিতে স্নাতক শেষ করেছেন চট্টগ্রামে অবস্থিত এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন থেকে। বর্তমানে তিনি সরকারি চাকরির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
হোসনেয়ারা জানালেন, ‘তিনি তাঁর গ্রামের প্রথম গ্র্যাজুয়েট সম্পন্নকারী নারী।’ তাঁর পরিবার প্রথম গ্র্যাজুয়েট হওয়া ও বর্তমান পরিস্থিতির যাবতীয় বিষয় নিয়ে আলোচনা হলো ‘অদ্বিতীয়ার গল্প’ নামক অনলাইন অনুষ্ঠানে। গত ৩০ নভেম্বর ২০২২, বুধবার, বেলা ৩টায় প্রথম আলো ট্রাস্ট এই অনলাইন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
হোসনেয়ারা খাতুনের পথ চলার গল্পটা জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার বাড়ি উত্তরাঞ্চলে আর বিশ্ববিদ্যালয়টা দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত। তাই এই দূরত্বটাই একটা বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। আমার মা-বাবা কোন সমস্যা করেনি। তবে প্রতিবেশী ও আত্মীয়-স্বজনরা অনেক সমস্যা করেছে। তারা বলেছে, ‘মেয়ে মানুষ এত দূরে গিয়ে কীভাবে পড়াশোনা করবে?’
ছোটবেলার গল্পটা কেমন ছিল জানতে চাইলে জানান, ‘আমার ছোটবেলা গ্রামে কেটেছে। তবে পড়াশোনা করেছি শহরে। প্রতিদিন গ্রাম থেকে গিয়ে ক্লাস করেছি। আমার পড়াশোনার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা ছিল অর্থনৈতিক সমস্যা। প্রতিবেশীরা বলত, ‘এত খরচ করে মেয়েকে পড়ানোর দরকার নাই। বিয়ে দিয়ে দাও।’ তবে পরিবার থেকে কখনো বাধা তৈরি করেনি। আমার মনে আছে—আমি যখন ৫ম শ্রেণির ফাইনাল পরীক্ষা দেব তখন পরীক্ষার ফি ও বেতন বাবা দিতে পারছিলেন না। তখন মা তাঁর বিয়ের আংটি বিক্রি করে টাকার ব্যবস্থা করে দেন। তারপর পরীক্ষা দিই।
আবার যখন গার্লস স্কুলে যাই, নবম-দশম শ্রেণিতে পড়ি তখন অনেক সমস্যা হয়েছে। অনেক বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার কারণে অনেক প্রাইভেট পড়তে হয়েছে। বাবা ভোরে স্কুলে দিয়ে এসেছেন, আবার বিকেলে নিয়ে এসেছেন। ওই সময়টাতে বাবা অর্থনৈতিক ও শারীরিকভাবে অনেক কষ্ট করেছেন—জানালেন হোসনেয়ারা।
এভাবে এসএসসিতে ভালো ফল নিয়ে পাস করে হোসনেয়ারা। পরে বগুড়ায় ভর্তি হন। এ ব্যাপারে তিনি বলছিলেন, ‘নতুন জায়গা, মেসের খরচ—যাইহোক অনেক কষ্ট করে এইচএসসি পাস করলাম। পরে আরও সমস্যায় পড়লাম। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি যুদ্ধ শুরু হলো। কয়েকটাতে পরীক্ষা দেই। কিন্তু সুযোগ হয়নি। তখন অনেক ডিপ্রেসড ছিলাম। ক্ষণে ক্ষণে মনে হতো, পরিবারের লোকজন বিরক্ত আমার ওপর। অনেকটা ভেঙে পড়ি।’
আমি কখনো সমনা-সামনি বিদেশি দেখিনি। এই অভিজ্ঞতাটা নতুন ছিল। যখন প্রথম আমি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করি, সিনিয়র আপুরা আমার রুম পর্যন্ত দিয়ে এসেছে। এই আচরণই আমাকে সহজ করে দেয়।
সেই সময়টা ভালো যায়নি হোসনেয়ারার। তবে গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে জানতে পারেন এইউডব্লিউ’র কথা। ফরম নিয়ে আবেদন করেন। এক মাস পর এসএমএস আসে লিখিত পরীক্ষার জন্য। পরীক্ষা বসেন। পরীক্ষা ছিল মূলত ফ্রি-হ্যান্ড রাইটিং। পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন, ভাইভার জন্য ডাক পেলেন। হোসনেয়ারা জানালেন, ‘আমি যেহেতু বাংলা মাধ্যমের ছিলাম, তাই ইংরেজিতে ভাইভা কেমনে দেব—একটা ভয় ছিল। অনেক কষ্ট করে বলেছি। আমার এই অবস্থা দেখে শেষ প্রশ্নের উত্তর আমাকে বাংলায় বলতে বলেন, তখন বাংলায় বলেছি।’
পরক্ষণেই যোগ করলেন, ‘আসলে ভর্তির সুযোগ হবে কি হবে না—এটা ভেবে অনেক হতাশ হয়েছিলাম। কয়েক দিন পর একটা ফোন আসে, আমি ভর্তির সুযোগ পেয়েছি। তবে বৃত্তি পেলেও ভর্তির ৪৮ হাজার টাকা দিতে হবে। পরে গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ভর্তি হই। কষ্ট হলেও বাবা অনেক খুশি হয়েছিলেন।’
তখন পাড়া প্রতিবেশীদের প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল জানতে চাইলে জানান, ‘তারা তখন বলত—এত বড় বৃত্তি কেন দিল তারা? বিদেশিরা পাচার করে দেবে নাতো? যেহেতু গ্রাম, তাই এ রকমটা বলেছে।’
তারপরে গল্প সম্পর্কে হোসনেয়ার বলেন, যখন চট্টগ্রামে যাই, সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ। ৬০% মেয়েরা বিদেশি। আমি কখনো সমনা-সামনি বিদেশি দেখিনি। এই অভিজ্ঞতাটা নতুন ছিল। যখন প্রথম আমি ক্যাম্পাসে প্রবেশ করি, সিনিয়র আপুরা আমার রুম পর্যন্ত দিয়ে এসেছে। আমাকে কি করতে হবে সব বুঝিয়ে দিয়েছেন। এই আচরণই আমাকে সহজ করে দেয়।’
যখন ক্লাস শুরু হলো? ক্লাসে গিয়ে দেখি সব ইংরেজিতে। শিক্ষক বিদেশি। তখন আমি অনেক কিছুই বুঝতাম না। মনে হতো ক্লাসে আসব না। এ ক্ষেত্রে শিক্ষাকগণ আমাদের বিদেশি শিক্ষার্থীর সঙ্গে বসাত, যাতে করে কথা বলে জড়তা কেটে যায়। তারাও অনেক হেল্প ফুল ছিল। মেন্টররা অনেক হেল্প করেছে। এভাবে প্রি-অ্যাকসেস, অ্যাকসেস শেষ করেছি। প্রথম দিকে সব চ্যালেঞ্জিং হলেও পরে সব সহজ হয়ে যায়—বললেন হোসনেয়ারা।
আত্মবিশ্বাসী হলেন কিভাবে? এইউডব্লিউর মাল্টিকালচারাল ডাইভার্সিটি থেকে অনেক কিছু শিখেছি। একপর্যায়ে ব্যাংক জবের দিকে আমার একটা ঝোঁক তৈরি হয়। এ জন্য আমি বিজ্ঞানের ছাত্রী হলেও অর্থনীতিকে মেজর হিসেবে নেই। আর আত্মবিশ্বাসের কথা বলতে গেলে, আমি অনেক লাজুক ছিলাম। কিন্তু ক্লাস, পার্টি, প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করে করে সাহসটা অর্জন করি। আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠি।
এখন যারা অদ্বিতীয়া আছে তাদের উদ্দেশে তিনি জানালেন, ‘এইউডব্লিউতে অনেক এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটি হয়, সেগুলোতে যুক্ত থাকতে হবে। এগুলো নিজেকে অনেক আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। নিয়মিত ক্লাস করতে হবে, সবার সঙ্গে মিশতে হবে।’
উল্লেখ্য, নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ২০১২ সাল থেকে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এবং প্রথম আলো ‘ফার্স্ট ফিমেল ইন দা ফ্যামিলি স্কলারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ নামে শিক্ষাবৃত্তি প্রদান শুরু করে। পরিবারের প্রথম নারী অথচ অসচ্ছল, যিনি উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সমাজ গঠনে আগ্রহী, এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনের এ রকম ১০ জনকে শিক্ষাবৃত্তি দেওয়া হয়। ট্রান্সকম গ্রুপের সহায়তায় প্রথম আলো ট্রাস্ট এই বৃত্তির ব্যবস্থা করে। ট্রান্সকম গ্রুপের সহায়তায় ২০১৬ সাল পর্যন্ত ৪২ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন।
২০১৭ সাল থেকে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড এই শিক্ষাবৃত্তির দায়িত্ব নেয়। নতুনভাবে নামকরণ করা হয় ‘অদ্বিতীয়া’ নামে। আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সহায়তায় ৪৬ জনসহ ২০২১ পর্যন্ত মোট ৮৮ জন শিক্ষার্থী এই বৃত্তি পেয়েছেন। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনও তাঁদের আবাসন, টিউশন ফি সুবিধাসহ নানা সুযোগ দেয়।
অনুষ্ঠানটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।