প্রিয়জন মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে…

করোনাকালেও মাদকের ভয়াবহতা থেমে নাই। লকডাউনের কারণে হাসপাতালে ভর্তির সংখ্যা কম হলেও ব্যক্তিগতভাবে ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করে কাউন্সিলিং বা চিকিৎসাসেবা গ্রহন করছেন অনেকে। লকডাউনের আগে মাদকাসক্তরা বন্ধুর আড্ডায় বা সরাসরি মাদক সেবন করতেন। কিন্তু লকডাউনে কিভাবে মাদক সংগ্রহ করেছেন জানতে চাইলে খুব মজার তথ্য পাওয়া যায়। কুরিয়ারের মাধ্যমে পার্সেলে বা অনলাইনের মাধ্যমে মাদক সংগ্রহ করছেন অনেকে। গতকাল ১৪ জুলাই বুধবার প্রথম আলো ট্রাস্টের মাদকবিরোধী পরামর্শ সভায় শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক এবং মনোরোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. জোবায়ের মিয়া এ কথা বলেন।

বিকেল চারটা থেকে আধা ঘণ্টা প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে মাদকবিরোধী অনলাইন পরামর্শ সহায়তা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়কারী মাহবুবা সুলতানা। অনলাইনে মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা সভার এটি ছিল ২৩তম আয়োজন। অনলাইন এই সভায় ডা. মো. জোবায়ের মিয়া বলেন, ‘মাদকের চিকিৎসা অনেকগুলো ধাপ আছে। তার একটি হচ্ছে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের তত্ত্বাবধানে রেখে মানসম্মত হাসপাতালে রেখে চিকিৎসা করাতে হবে। পুনর্বাসন কেন্দ্র থেকে বাড়িতে ফিরে নিয়মিত ফলোআপ করা। মাদকাসক্তকে বিজ্ঞানসম্মত চিকিৎসা করাতে হবে। মাদকের সঙ্গে মানসিক রোগের একটা সম্পর্ক রয়েছে। একজন মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে অপরাধী হিসেবে না দেখে তাকে রোগী হিসেবে দেখা উচিত। মাদকসেবীরা বলে থাকেন আনন্দ নিতে গিয়ে একবারের জন্য মাদক গ্রহণ করে ও একসময় মাদক নিতে বাধ্য হয়। অর্থাৎ মাদকের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। করোনাকালে মাদক রোগীর সংখ্যা বেড়েছে কারণ স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় সবকিছু বন্ধ। হতাশা থেকেও অনেকে মাদকাসক্ত হয়ে থাকেন। মাদক সাময়িক আনন্দ দেওয়ার জন্য হলেও এটা ব্রেইনে মারাত্মক ক্ষতি করে।’

মাদক থেকে দূরে থাকতে হলে কি করতে হবে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘সৃজনশীল কাজে যুক্ত থাকা উচিত। জীবনে সব ধরণের পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে। কোন শিক্ষার্থীর ৪০মিনিটের বেশি সময় স্ক্রিনের সামনে থাকলে চোখের ক্ষতি হয়। কিছুক্ষণ বিরতি দিয়ে আবার করতে পারে। সামর্থ্য ও প্রতিভা অনুযায়ী মাদকাসক্তরা চাইলে বাগান করা, ছবি আঁকা, রান্না করতে পারেন। লোক সমাগম কম হয় সেরকম জায়গায় প্রতিদিন ৩০মিনিট করে হাঁটতে পারেন। লম্বা করে শ্বাস নিবেন আবার ছাড়বেন । পুরনো ক্লাসিক বইগুলো পড়ে ফেলতে পারেন । হাতে ধরে বই পড়তে পারেন । মৌসুমি ফলমূল খেতে হবে তাতে রোগ প্রতিরোধ হবে, জীবনী শক্তি বাড়বে। জীবনে দুঃখ হতাশা আসবে কিন্তু হতাশাবোধ, দুঃখ ভুলে থাকার জন্য নেশা না । মাথা থেকে মাদক নেওয়ার চিন্তা দূর করতে হবে।‘

এক বা একাধিকবার রোগী মাদকে পুনরাসক্তি হতে পারে। এক্ষেত্রে তিনটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে। তাহলো ১.সময় ২.স্থান ৩.ব্যাক্তি । যেই সময়ে সে মাদক গ্রহণ করত সেই সময়ে সতর্ক থাকতে হবে। যে জায়গায় মাদক গ্রহণ করতো সেই জায়গা এড়িয়ে চলা। যাদের সঙ্গে বসে মাদক গ্রহণ করত তাদের এড়িয়ে চলা। মাদক গ্রহণ করে এমন কারো সাথে মেলামেশা যাবে না। নিজের সচেতনতা থাকতে হবে। একজন বন্ধু যদি মাদক গ্রহণ করতে বলে সে ক্ষেত্রে তাকে কিভাবে ‘না’ করবে। তাকে সুন্দরভাবে সহমর্মিতা প্রকাশ করে তাকে না করতে হবে। কারণ কোন বাজে মন্তব্য করলে সেটা হিতে বিপরীত হতে পারে । যেমন বলা যেতে পারে, ‘ন’ আমি তো খাই না। আগে তো খেতাম। আমি চিকিৎসা নিয়েছি । মাদকের সঙ্গে আর বন্ধুত্ব নয়। বাজে মন্তব্য করলে মনের ভেতর ওই ‘না’ নেতিবাচত হিসেবে কাজ করে।

অভিভাবকের আচরণ কেমন হওয়া উচিত এই প্রশ্নের উত্তরে ডা. মো.জোবায়ের মিয়া বলেন, আগে অভিভাবককে জানতে হবে তার সন্তান মাদকাসক্ত কিনা। সেক্ষেত্রে কিছু আচরণ লক্ষ্য করা যায় যেমন, লেখাপড়ায় খারাপ করা, কাজে মনোযোগ কমে যাওয়া, কারণে-অকারণে মিথ্যা কথা বলা, উগ্র আর রূঢ় আচরণ করা, মেজাজ খিটখিটে থাকা। রাতে জেগে থাকা আর দিনের বেলায় ঘুমানো। বেশি বেশি হাতখরচের টাকাপয়সা চাওয়া, দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়া। ঘন ঘন মুঠোফোনের নম্বর পাল্টানো। ঘরে মাদক গ্রহণের উপকরণ সিগারেটের রাংতা, ট্যাবলেটের স্ট্রিপ, দেশলাই ইত্যাদি পাওয়া। বাসার দামি জিনিসপত্র হারিয়ে যেতে থাকা। স্বাস্থ্য ভেঙে পড়া এবং খাওয়া-দাওয়ার অনিয়ম। বাথরুমে বেশি সময় কাটানো। এসব থাকলে মনোরোগ চিকিৎসক অথবা মেডিসিনের চিকিৎসকের কাছে যেতে পারেন। রোগী স্বেচ্ছায় যেতে না চাইলে কৌশল অবলম্বন করতে পারেন। পুরো পরিবারের রুটিন চেকআপ করাবেন । ডাক্তার কে আগে থেকে বলে রাখলে, ডাক্তার প্রয়োজনীয় রক্ত, পেশাব ইত্যাদির পরীক্ষা দেবেন।

প্রিয়জন মাদকাসক্ত হয়ে পড়লে কি করতে হবে জানতে চাইলে ডা. মো. জোবায়ের মিয়া বলেন, ‘সন্তানের সাথে বন্ধুর মত মিশতে হবে। আদর করে ডেকে তার সঙ্গে সবকিছু শেয়ার করতে হবে। সমব্যথী হয়ে তার কষ্টের কথা শুনতে হবে। রুঢ় আচরণ করা যাবে না। সুন্দর করে বোঝাতে হবে। মাদক গ্রহণ করলে তোমার তো এই সমস্যা হচ্ছে। কিভাবে আমরা থেকে মোকাবেলা করতে পারি। তার সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে, আদর করে তার সঙ্গে ডেকে সবকিছু শেয়ার করতে হয়। কষ্টের কথাগুলো শুনতে হবে। বকাঝকা, দোষারোপ করা যাবেনা।’