কলেজে থাকতেই চঞ্চল (ছদ্মনাম) আসক্ত হয়েছিলেন মাদকে। আর আগে থেকেই ধরেন সিগারেট। শুধু নেশার কারণে তাঁকে কলেজ ছাড়তে হয়। তাই দ্বিতীয় বর্ষে পা রাখার মুহূর্তে আবার ঘুরে প্রথম বর্ষে ভর্তি হন ঢাকার একটি কলেজে। চঞ্চল বলেন, ‘আমার জীবনটা খাপছাড়া। কোনো কিছুর ঠিক নেই। এরই মধ্যে কয়েক বন্ধু মিলে একটা ব্যান্ড তৈরি করি। ওই দল নিয়ে একটা প্রতিযোগিতায় অংশ নিই। ফাইনালেও চলে গিয়েছিলাম। তারপর...’
চঞ্চলের পরের গল্পগুলো অন্ধকারাচ্ছন্ন। মাদকের ছোবলে ছেয়ে গিয়েছিল এই উঠতি গায়কের জীবন। পরে প্রথম আলো ট্রাস্ট মাদকবিরোধী কর্মসূচির সংস্পর্শে এসে বর্তমানে সুস্থ আছেন তিনি। আজ ২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস। এ উপলক্ষে প্রথম আলো ট্রাস্ট মাদকবিরোধী আন্দোলনের উদ্যোগে বিকেলে রয়েছে অনলাইন আলোচনা সভা।
প্রথম আলো ট্রাস্ট মাদকবিরোধী আন্দোলনের সেবা নিয়ে চঞ্চলের মতো সুস্থ হয়েছেন অনেকেই। প্রতি মাসে পরামর্শ সহায়তার আয়োজন করে প্রথম আলো ট্রাস্ট মাদকবিরোধী আন্দোলন। এ পর্যন্ত রাজধানীর ধানমন্ডি ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে ১২০টি এবং করোনাকালে অনলাইনে ২১টিসহ মোট ১৪১টি পরামর্শ সহায়তা সভা করা হয়েছে। এখানে মূলত উপস্থিত থাকেন মাদকাসক্ত রোগী ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। এসব অনুষ্ঠানে পরামর্শ সেবা গ্রহণ করে সুস্থ হয়েছেন অসংখ্য মানুষ।
শুরুতে বলছিলাম চঞ্চলের কথা। মাদকের বিভীষিকা যে কত নির্মম, চঞ্চল সেটি বুঝেছেন অনেক মূল্য দিয়ে। তাই তিনি প্রথম আলোকে বললেন তাঁর জীবনের গল্প।
২০০০ সালের কথা। ঢাকার বাইরের একটা মেডিকেল কলেজের ক্যাম্পাসে গিটার হাতে গান গাইতে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে গান শুনতে এসেছিলেন এক মেয়ে। চঞ্চলের ভাষায়, তাঁর দিকে দৃষ্টি পড়তেই মেয়েটি হয়ে গেল তাঁর ‘ক্রাশ’।
কিন্তু ওই ‘ক্রাশ’ হলে কী হবে, মেডিকেল কলেজের ওই মেয়ে তো চঞ্চলকে ভালোবাসতে রাজি নন। হতাশা থেকে নেশার জগতে চঞ্চলের হাঁটাহাঁটি শুরু হলো। তবে মেয়েটির মন জয় করার চেষ্টা চলতে থাকল সমানতালে। একসময় মেডিকেলের শিক্ষার্থী মেয়েটি তাঁর প্রেমে সাড়া দিয়ে তাঁকে ‘হ্যাঁ’ বললেন, পরে তাঁকে বিয়েও করলেন বটে, কিন্তু মাদকের নেশা তো আর চঞ্চলকে ছাড়ে না।
‘মানুষ নেশা করলে কেমন হয়ে যায়, তা আমি বুঝেছি হাড়ে হাড়ে। এমনও হয়েছে, আমার স্ত্রী অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে, আমার সন্তান আসছে পৃথিবীতে, মা আমার অপেক্ষায় আছেন, অথচ তাঁদের একনজর দেখেই ছুটছি মাদক নিতে।’—নিজের জীবনের কথা অবলীলায় বলে গেলেন চঞ্চল।
বেশ কয়েক বছর চিকিৎসা নিয়ে এখন সুস্থ তিনি। বললেন, ‘প্রথম আলো মাদকবিরোধী কর্মসূচি আমাকে নতুন জীবন দিয়েছে। এখানে এসে অবশেষে আমি বুঝতে পেরেছি, মাদক মানুষের মানবিক বোধগুলোকে ভোঁতা করে দেয়। তাই এ চক্কর থেকে মুক্তি পেতে মাদকাসক্ত ব্যক্তির পরিবারের সহযোগিতা খুবই দরকার হয়। আবারও বলতে চাই, প্রথম আলোর সহায়তায় আমি যেন ঘরে ফিরেছি।’
পড়াশোনা শেষে এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন চঞ্চল। চঞ্চলের মতো এমন গল্প আছে আরও অনেকের।
অনেকেই ‘দেখি না কী হয়’—এ আগ্রহ থেকে মাদক নেওয়া শুরু করেন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আহমেদ হেলাল এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘মাদককে হেলাফেলা করা মোটেই উচিত নয়, একবার–দুবার মাদক গ্রহণ করলে যে কেউ এতে আসক্ত হয়ে পড়তে পারে।’ তরুণসমাজকে মাদকমুক্ত করার লক্ষ্যে ২০০৩ সালের ১ মে যাত্রা শুরু হয় প্রথম আলো মাদকবিরোধী আন্দোলনের। ২০০৯–এর ২৩ মে প্রথম আলো ট্রাস্টের কার্যক্রম শুরু হলে মাদকবিরোধী আন্দোলনের কার্যক্রম ট্রাস্টের অধীনে চলে যায়। ২০০৩ সাল থেকে গত ১৮ বছরে প্রায় প্রতি মাসেই পরামর্শ সহায়তা সভা আয়োজিত হয়েছে। মুক্ত আলোচনার পাশাপাশি হয়েছে মাদকবিরোধী শোভাযাত্রা। মাদকবিরোধী কনসার্ট হয়েছে ১৭টি। একই সঙ্গে শিশু–কিশোরদের সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতিবছর মাদকবিরোধী স্টিকার ডিজাইন প্রতিযোগিতা, সাংবাদিকদের জন্য ‘মাদকবিরোধী সেরা প্রতিবেদন পুরস্কার’, স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে মাদকবিরোধী সচেতনতামূলক সভার আয়োজনসহ আরও নানা কর্মসূচি নিয়ে সক্রিয় রয়েছে ট্রাস্ট।