সন্তানের প্রযুক্তি আসক্তি: মা–বাবার করণীয়

গত ৩০ আগস্ট ২০২৩, প্রথম আলো ট্রাস্ট আয়োজিত (১৬৬তম) অনলাইন মাদকবিরোধী পরামর্শ সভায় প্রযুক্তি আসক্তি নিয়ে আলেচনা হয়।

মোবাইল কিংবা পর্দায় কাজ করা যায় এমন যেকোনো যন্ত্রের প্রতি তীব্র টানই হলো প্রযুক্তি আসক্তি।  শিশু,কিশোর–কিশোরী থেকে সব বয়সের মানুষই বর্তমানে প্রযুক্তিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে। মাদকাসক্তি ও প্রযুক্ত আসক্তির পরিণতিটা একই রকম।

গত ৩০ আগস্ট ২০২৩, প্রথম আলো ট্রাস্ট আয়োজিত (১৬৬তম) অনলাইন মাদকবিরোধী পরামর্শ সভায় প্রযুক্তি আসক্তি নিয়ে আলেচনা হয়। সভার আলোচক কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের  মনোবিদ ডা. রাহেনুল ইসলাম ‘সন্তানের প্রযুক্তি আসক্তি: মা–বাবার করণীয়’ বিষয়ে আলোচনা করেন।

প্রযুক্তি আসক্তি থেকে পরিত্রানের উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন, পরিবর্তনের শুরুটা করতে হবে নিজের থেকে। বাবা–মায়ের উদ্দেশ্যে বলবো বাসায় থাকার সময় কল রিসিভ ছাড়া মোবাইলের অন্য ধরনের ব্যবহার বন্ধ করুন। বাসায় থাকার সময় মোবাইলের নোটিফিকেশন বন্ধ রাখুন। মনে রাখবেন আপনার শিশুটি কিন্তু আপনাকে অনুকরণ করে বড় হয়ে হচ্ছে। ঘুম থেকে ওঠার সময়টা নির্দিষ্ট রাখুন। প্রতিদিন সকালে একই সময় ঘুম থেকে উঠুন। আপনার সন্তান আপনাকে দেখেই শিখবে। সন্তানের সঙ্গে প্রমিত আচরণ করুন।

যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শিশু সমাজের উপযুক্ত সদস্যে পরিণত হয়, তাকে সামাজিকীকরণ বলে। সন্তানকে প্রযুক্তি আসক্তি থেকে মুক্ত রাখতে চাইলে সামাজিকীকরণের গুরুত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, আমরা বর্তমানে বিশেষ করে করোনার সময়ের পর থেকে কাছের মানুষদের বাসা–বাড়িতে খুব একটা যাই না। কাছের মানুষরাও আমাদের বাসায় আসে না। এর ফলে আমাদের সন্তানদের সামাজিকীকরনের ক্ষেত্রে একটা বড় ধরণের বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। কাছের মানুষদের সঙ্গে আমাদের সন্তানদের সুস্থ সম্পর্ক গড়ে উঠছে না। আমরা সন্তানদের মোবাইল থেকে দূরে থাকতে বলছি। কিন্তু তাদেরকে মোবাইলের বিকল্প কিছুতো দিতে হবে। আপনাদের সমমনা ব্যাক্তিদের সন্তানদের  সঙ্গে নিজের সন্তানকে নিয়মিত মেশার সুযোগ করে দিন। শিশু–কিশোররা তাদের সমবয়সীদের সঙ্গে নিয়মিত গল্প করার, আড্ডা দেওয়ার কিংবা খেলাধুলার সুযোগ  পেলে মোবাইল কিংবা প্রযুক্তিতে আসক্ত হওয়ার সম্ভবনা কমবে। ব্যস্ত জীবনে এখন অনেকেই আয়োজন করছেন ওয়ান ডিশ পার্টির। ছুটির দিনক্ষণ ঠিক করে প্রতিবেশি, বন্ধু–বান্ধবদের নিয়ে এই ওয়ান ডিশ পার্টির আয়োজন আপনারাও করতে পারেন। এতে করে আমাদের একঘেয়েমি দূর হবে, সন্তানেরা তাদের সমবয়সীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগ পাবে। মোবাইল না দিয়ে  বিকল্প উপায়ে ইতিবাচকভাবে সন্তানদেরকে কীভাবে আনন্দ রাখা যায় সেই উপায় বাবা– মায়েকেই সৃজনশীলতার সঙ্গে খুঁজে বের করতে হবে।

যে কোন পরিবর্তন চট করে আসে না উল্লেখ করে ডা. রাহেনুল ইসলাম বলেন, পরিবর্তনের একটা বিজ্ঞানসম্মত উপায় আছে। মোবাইল কিংবা প্রযুক্তিতে আসক্ত হয়ে পড়ছেন এটি যদি আপনি বুঝতে পারেন তাহলে আসক্তি থেকে বের হবার জন্য প্রথমেই ভালোভাবে প্রস্তুতি নিন। কবে থেকে মোবাইল ব্যবহারের আচরনে পরিবর্তন আনবেন তার একটা তারিখ নির্ধারণ করুন। দিনটি একটা ছুটির দিন হতে পারে। মোবাইলের অতিরিক্ত ব্যবহার থেকে বিরত থাকলে আপনার কী কী উপকার হবে সেটি নির্দিষ্ট করে একটা কাগজে লিখে ফেলুন। আপনার পরিবারের অন্য সদস্য, বন্ধু–বান্ধবদের সহযোগিতা নিন। আপনি একা মোবাইলের অতিরিক্ত ব্যবহার বন্ধ করলেন কিন্তু পরিবারের অন্য সদস্যরা মাত্রারিক্ত ব্যবহার অব্যাহত রাখলো। এতে কিন্তু আপনিও প্রভাবিত হবেন। তাই সম্ভব হলে পরিবারের সব সদস্য মিলে এক সঙ্গে মোবাইলের অতিরিক্ত ব্যবহার কমিয়ে আনুন। মোবাইলের অতিরিক্ত ব্যবহার কমাতে পারলে নিজেকে নিজেই পুরস্কৃত করুন।

কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের মনোবিদ ডা. রাহেনুল ইসলাম।

অনেকেই প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে দ্বিধাপূর্ব অবস্থানে থাকেন এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সে মনে করে ডিভাইসের অতিরিক্ত ব্যবহারের ফলে কোন ক্ষতি নেই। সবাই ব্যবহার করছে, আমি ব্যবহার না করলে আনস্মার্ট থেকে যাচ্ছি। ডিভাইসের অতিরিক্ত ব্যবহারের কারণে তার ব্যাক্তিগত, সামজিক ও পরিবারিক জীবনে কী ক্ষতি হচ্ছে সেই বিষয়ে সে সচেতন নয়। এই ধরণের অবস্থা থেকে খুব সহজেই মুক্তি মিলবে না। এই অবস্থা থেকে আপনজনকে মুক্ত করতে চাইলে তার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করুন। তাকে সরল বাক্যে সরাসরি বলুন, তুমি সারাক্ষণ মোবাইল ব্যবহার করছো এটি আমাকে খুব কষ্ট দেয়। আমি তোমার সঙ্গে আরও সময় কাটাতে চাই। বরং নির্দিষ্ট করে বলুন আমি অফিস থেকে ফেরার পরে তোমার সঙ্গে দুই ঘন্টা সময় কাটাতে চাই।  এইভাবে যদি আসক্ত ব্যাক্তির সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে পারেন তাহলে তাকে আসক্তি থেকে মুক্ত করা সম্ভব।

 শিশুদের প্রযুক্তি আসক্তির কোন পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শারানাপন্ন হতে হবে এ প্রসঙ্গে ডা. রাহেনুল ইসলাম বলেন, একটি শিশু সাধারণত তিনটি সিস্টেম– পরিবার, প্রতিবেশি ও স্কুলের  সঙ্গে যুক্ত থাকে।  আমরা যদি শিশুর ক্ষেত্রে লক্ষ্য করি সে স্কুলে ঠিক সময় যেতে পারছে না কিংবা পরীক্ষায় খারাপ ফল করছে, নিজেকে আঘাত করছে, কিংবা বন্ধু–বান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের  সঙ্গে ঠিক মত মিশতে পারছে না তাহলে আমার পরামর্শ হচ্ছে সেই শিশুটিকে নিয়ে দ্রুত বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের শরানাপন্ন হন।

মাদকবিরোধী পরামর্শ সভাটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সভাটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।