সবার আগে মানুষ: সচেতনতাই মুক্তি
সমাজ ও মানুষের প্রতি দায়বদ্ধতা থেকে নানা রকমের সামাজিক কাজ প্রথম আলো প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই করে আসছে। কিশোর–কিশোরীদের মাদক থেকে দূরে রাখা এবং সচেতনতা তৈরির মাধ্যমে তরুণসমাজকে মাদকমুক্ত করার লক্ষ্যে ২০০৩ সালের ১ মে যাত্রা শুরু হয় মাদকবিরোধী আন্দোলনের। ২০০৫ সালে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান র্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার লাভ করেন। পুরস্কারলব্ধ ৩৩ লাখ টাকা সমান তিনটি ভাগে অ্যাসিডদগ্ধ নারীদের জন্য, মাদকবিরোধী আন্দোলন ও নির্যাতিত সাংবাদিক সহায়তা তহবিলে বরাদ্দ দিলে এর কার্যক্রম আরও জোরালো হয়।
মাদকবিরোধী আন্দোলন প্রথম আলোর সামাজিক দায়বদ্ধ কাজের মধ্যে অন্যতম। মাদক সেবনের অভ্যাসটি যখন একজনের নেশায় পরিণত হয়, একসময় সেই অভ্যাস তার মানসিক ও শারীরিক নির্ভরতায় পর্যবসিত হয়। ধীরে ধীরে মাদকের মাত্রা ও সময় বেড়ে নেশা তার সব মনোযোগ কেড়ে নেয়। বিশৃঙ্খল জীবনে দিন–রাত একাকার হয়ে যায়।
২০০৯ মাসের ২৩ মে প্রথম আলো ট্রাস্টের কার্যক্রম শুরু হলে মাদকবিরোধী আন্দোলনের কার্যক্রম ট্রাস্টের অধীন চলে আসে। প্রতিটি মানুষের মধ্যে আছে অনন্ত সম্ভাবনা। সেই সম্ভাবনাময় মানুষগুলো যেন জীবনের পথ থেকে হারিয়ে না যায়, সেই লক্ষ্যে মাদকের বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি ও মাদকের ভয়াল থাবা থেকে যুবসমাজকে দূরে রাখতে কাজ শুরু করে প্রথম আলো ট্রাস্ট। প্রথম আলো ট্রাস্টের বিভিন্ন কার্যক্রমের মধ্যে মাদকবিরোধী আন্দোলন একটি অন্যতম। মাদকবিরোধী আন্দোলন বছরজুড়ে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। অনুষ্ঠানগুলোর মধ্যে প্রায় প্রতি মাসে মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা, গোলটেবিল, শোভাযাত্রা, মানববন্ধন, আলোচনা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, সচেতনতা সৃষ্টিতে মাদকবিরোধী স্টিকার ডিজাইন প্রতিযোগিতা, মাদকবিরোধী বন্ধুমেলা, কনসার্টসহ ২৬ জুন বিশ্ব মাদকমুক্ত দিবস পালন উপলক্ষে বিশেষ আয়োজন। প্রথম আলো মাদকবিরোধী আন্দোলনের স্লোগান, ‘মাদককে না বলো—মাদকাসক্তি একটি ব্যাধি’। অনুষ্ঠানের পাশাপাশি মাদকসংক্রান্ত রিপোর্ট প্রতিযোগিতা, ফিচার, বিজ্ঞাপন, সম্পাদকীয় ও চিঠিপত্র প্রকাশ করা হয়, যা মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে।
মাদকের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার অংশ হিসেবে ২০০৩ সাল থেকে গত ২০ বছরে প্রায় ১৭৫টি পরামর্শ সহায়তা সভা আয়োজিত হয়েছে। প্রথম আলো ট্রাস্ট মাদকবিরোধী আন্দোলন মূলত বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরী, তাদের অভিভাবক, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও সমাজের সবাইকে মাদকের ভয়াবহতা, ক্ষতিকর দিক, প্রিয়মুখ মাদকাসক্ত হওয়ার সম্ভাব্য কারণ-লক্ষণ, একজনকে মাদকমুক্ত রাখার জন্য কী কী করতে হবে, বাবা-মায়েদের কীভাবে সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে, দুর্ঘটনাবশত যদি পরিচিত কেউ মাদকের কবলে পড়েই যায়, তাহলে কোথায় চিকিৎসা নেওয়া যেতে পারে, সর্বোপরি যেই মানুষটা আসক্তির অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে তাঁকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনার জন্য কী কী করণীয়—এসব বিষয় সম্পর্কে সচেতন করার চেষ্টা করে যাচ্ছে।
এসব চেষ্টা একদম বৃথা যায়নি। পরামর্শ সহায়তা সভা থেকে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসার মাধ্যমে মাদক ছেড়ে সুস্থ জীবনে ফিরে এসেছেন, এমন সংখ্যাও কম নয়। আমরা সবসময় চেয়েছি, মাদক নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ুক, কিশোর-কিশোরীরা নিজেরাই যেন বুঝতে পারে যে মাদক নিতে বলে, সে প্রকৃত বন্ধু নয়। আমাদের তরুণ প্রজন্ম জানুক এবং বিশ্বাস করতে শিখুক যে মাদককে ‘না’ বলাই স্মার্টনেস। অভিভাবকেরা জানুক, সন্তানকে মাদকের ভয়াল থাবা থেকে মুক্ত রাখতে হলে সন্তানের সঙ্গে এমন সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে, যেন সন্তান তাঁদের সঙ্গে সব উৎসাহ, উৎকণ্ঠা, ভালো-মন্দ বলার জায়গাটা পায়।
আমাদের সমাজে মাদকের চিকিৎসা ও চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে একটা ভ্রান্ত ধারণা আছে। অনেকেই মনে করেন, মাদকের চিকিৎসা করেও জীবনভর এই আসক্তি থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় নেই। পরামর্শ সহায়তা সভাসহ সব ধরনের সচেতনতামূলক আয়োজনে আমরা বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে জানানোর চেষ্টা করেছি যে মাদকাসক্তি একটি মানসিক রোগ। যথাযথ বৈজ্ঞানিক চিকিৎসার মাধ্যমে এই আসক্তি থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হওয়া সম্ভব। আবার অনেকেই একবার চিকিৎসা নিয়ে ফিরে আসার পর পুনরায় যখন আসক্ত হয়ে পড়েন, তখন তার পরিবার হতাশ হয়ে যায়। সে ক্ষেত্রে চিকিৎসা নিয়ে আসা ব্যক্তির প্রতি পরিবারের সদস্যদের আচরণ কেমন হওয়া উচিত, সে বিষয়েও সচেতন করা হয়েছে। আর পাঁচটা রোগের জন্য চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চিকিৎসা নিলে যেমন সুস্থ হয়ে ওঠা যায়, তেমনি মাদকের আসক্ত ব্যক্তিটিও রোগী। তাঁরও চিকিৎসা-যত্ন-সহানুভূতি-ভালোবাসা প্রয়োজন।
সচেতনতা প্রত্যেকের নিজস্ব শিক্ষা, চেতনা ও মূল্যবোধের বহিঃপ্রকাশ। যা কিছু ভালো তার সাথে থাকার প্রত্যয় নিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার, সবাইকে সচেতন করার এই দায়িত্ব পালন করে চলেছে প্রথম আলো ট্রাস্ট। ভালোর সাথে আলোর পথে প্রথম আলো ট্রাস্টের এই যাত্রা চিরন্তন। আমরা বিশ্বাস করি, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও সহযোগিতায় একদিন এই সমাজ, এই বাংলাদেশ মাদকমুক্ত হবে। একদিন আমরা সবাই একসঙ্গে সমস্বরে বলব—‘মাদককে না বলো’।