সাক্ষাৎকার

সন্তানের বয়ঃসন্ধিকাল: অভিভাবকের সচেতনতা

প্রথম আলো ট্রাস্টের একটি নিয়মিত আয়োজন মাদকবিরোধী পরামর্শ সভা। গত ২৮ এপ্রিল ২০২৫ প্রথম আলো ট্রাস্ট আয়োজিত অনলাইন মাদকবিরোধী পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার আলোচক মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার ‘সন্তানের বয়ঃসন্ধিকাল: অভিভাবকের সচেতনতা ’—এই বিষয়ের ওপর আলোচনা করেন। মাদকবিরোধী পরামর্শ সভাটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সভাটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা। প্রশ্ন উত্তরের আলোকে পরামর্শ সভার চুম্বক অংশ নিম্নরূপ।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

বয়ঃসন্ধিকাল আসলে কি? এই সময় কি কি পরিবর্তন দেখা যায়?

ডা. মেখলা সরকার: একটা সন্তান ভূমিস্ট হওয়ার পর আমাদের চেষ্টা থাকে তাকে এমন ভাবে তৈরি করতে যেন সে শারীরিক এবং মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে যেকোনো প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে টিকে থাকতে পারে। বয়ঃসন্ধিকালে হরমোনাল কিছু পরিবর্তনের জন্য আমরা শারীরিক পরিবর্তনগুলো খুব সহজে লক্ষ্য করতে পারি। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আমরা তার মানসিক পরিবর্তনগুলো সেই ভাবে লক্ষ্য করি না। কিছু কিছু পরিবর্তন খুব সহজেই বাইরে থেকে আমরা দেখতে পারি। এই শারীরিক পরিবর্তনগুলোর পাশাপাশি কিছু ক্ষেত্রে তার মানসিক পরিবর্তন ঘটে। সেই সময়টাতে পরিবারে এবং সমাজে তার কি কি দায়িত্ব-কর্তব্য রয়েছে আমরা তাকে আস্তে আস্তে বুঝিয়ে দেবার চেষ্টা করি। এই পরিবর্তনগুলো যদি বাবা মার লক্ষ না করে তাহলে সন্তানদের নানা দিকে চলে যাবার সম্ভাবনা আছে। এই সময় তাদের মধ্যে আবেগেরও প্রতুলতা থাকে। তারা ভুল সঠিক বুঝে উঠতে পারে না। তাদের নৈতিকতাগুলো ততটা সংঘটিত হয় না যতটা হলে তারা ভুল বা সঠিক পথ বেছে নিতে পারে। এ সময় তার একটা আইডেন্টিটি তৈরি হয়।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানের মধ্যে কি কি প্রবণতা দেখা দেয়?

ডা. মেখলা সরকার: একজন মানুষের বয়ঃসন্ধিকালের আগে তার নিজস্ব কোন পরিচয় থাকে না। সে তার বাবা-মায়ের পরিচয়েই পরিচিত হয়। কিন্তু বয়ঃসন্ধিকালের পরে তার নিজস্ব পরিচয় তৈরি হয়। এই সময় তার পছন্দ অপছন্দগুলো ভিন্নতর হতে দেখা যায়। যেমন কি পোশাক পড়বে,কার সাথে মিশবে এই ভাবনাগুলি তখন তার মধ্যে অনেক বেশি দেখা যায়। তার নিজের আত্মপরিচয়ের ব্যাপারে সে অনেক বেশি সচেতন হয়ে ওঠে। তখন তার মধ্যে ভালো-মন্দ বিচারের একটা প্রবণতা গড়ে ওঠে। আগে যেমন বাবা-মা যা বলতো তাই তারা মেনে নিত। কিন্তু এই সময়টাতে তারা আরো বেশি সচেতন হয়ে যায়। তারা নিজেদের সিদ্ধান্ত নিজেরাই নিতে চায়। এমনকি তারা সমাজ এবং রাজনীতি বিষয়েও অনেক বেশি সচেতন হয়ে ওঠে। তখন তাদের মধ্যে নানা রকম জিজ্ঞাসা তৈরি হয়। এই অভিজ্ঞতাটা বাবা-মার জন্য নতুন। কেননা আগে তারা এমন করত না বা এমন সব বিষয়ে প্রশ্ন করত না যেসব বিষয়ে বাবা মায়েরা তাদের দূরে রাখত। এটাও বাবা-মার জন্য এক নতুন অভিজ্ঞতা। সন্তানদেরও বাবা-মায়ের সঙ্গে মানিয়ে চলার একটা প্রবণতা এই সময় দেখা যায়। তারা সব ক্ষেত্রে নিজের স্বাধীন মতামত দেয়ার চেষ্টা করে।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানদের সাথে বাবা মায়ের সম্পর্ক কেমন হওয়া উচিৎ? 

ডা. মেখলা সরকার: আসলে প্রতিটা মানুষই জন্মগতভাবে স্বাধীন সত্তা। এই বিষয়টা তাদের জন্মের পরে সেই ভাবে দেখা যায় না। কিন্তু বয়ঃসন্ধিকালে পরিবর্তন অনেক বেশি হয় এবং তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করে। আর এখান থেকেই তৈরি হয় তার সমবয়সীদের একটা দল যারা তার মত চিন্তাভাবনা করে। তাদের সঙ্গেই তাদের সখ্যতা গড়ে ওঠে। চিন্তা ভাবনাগুলো তাদের সঙ্গেই শেয়ার করতে দেখা যায়। অর্থাৎ বয়ঃসন্ধিকালে তাদের মা-বাবার বাইরে তাদের বন্ধু-বান্ধবরাই তাদের জীবনে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এই বয়সে তার একটা জৈবিক পরিবর্তন দেখা যায়। বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকর্ষণও এই বয়স থেকেই তৈরি হয়। তার এই সার্বিক পরিবর্তনের জন্যই আচার-আচরণের কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। অর্থাৎ সে এখন আগের মত এত মা বাবার সঙ্গে থাকেনা। একটু আলাদা থাকে, একা একা থাকে। নিজের মত থাকতে সে পছন্দ করে। বাবা-মায়ের উচিৎ এই সময়টা তাদের মতো করে থাকতে দেওয়া। এমন কিছু না বলা বা করা যাতে তারা নিজেদেরকে ছোট মনে করে। তাদের আত্নবিশ্বাসী করে গড়ে তোলার জন্য বাবা-মাকেই অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

সন্তানের বয়সন্ধিকালে মা-বাবার করণীয়টা আসলে কি?

ডা. মেখলা সরকার: এক থেকে দশ বছর বয়স পর্যন্ত সন্তান অনেকটাই বাবা- মায়ের উপর নির্ভরশীল থাকে। তখন বাবা-মা যা বলে তারা তাই মেনে নেয়। কোনরকম তর্ক-বিতর্কে তারা যেতে চায় না বা যায় না। কিন্তু বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানের শারীরিক সক্ষমতা বা শক্তি যেমন বৃদ্ধি পায় তেমনি অন্যান্য বিষয়ে পছন্দ-অপছন্দের বিষয়গুলো চলে আসে। অনেক সময় দেখা যায় যে সে তার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মারামারি করছে বা তাদের সাথে বিতর্ক করছে। আর এই পরিবর্তনগুলো বাবা-মা সহজে মেনে নিতে চায় না। যখনই সন্তান কোন একটা বিষয়ে মতামত দিচ্ছে মা-বাবা যেহেতু অভ্যস্ত না তারা একটা প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। যখনই সে আলাদা করে একটু প্রাইভেসি চাচ্ছে তখনই তাদের সম্পর্কে অনেক ধরনের নেতিবাচক চিন্তাভাবনা চলে আসছে। যা তাকে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তোলে। আর তখনই তারা সন্তানদের অনেক বেশি নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। এই অতিরিক্ত নিয়ন্ত্রণ করার প্রবণতার ফলে সন্তানদের সঙ্গে বাবা-মায়ের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। এই দূরত্বের কারণে একটা নেতিবাচক সম্পর্কের সৃষ্টি হয়। যে কারণে সন্তানরা তাদের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে অনেক বেশি মিশতে শুরু করে। মনে রাখতে হবে বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানদের মধ্যে আত্মমর্যাদার সৃষ্টি হয়।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

বাবা মায়ের কি এই বিষয়ে শেখার বা জানার কিছু আছে?

ডা. মেখলা সরকার: এ ক্ষেত্রে বাবা- মাকে যথেষ্ট কৌশলী হতে হবে। সব সময় সন্তানের আচরণে সঙ্গে প্রতিক্রিয়া দেখানো যাবে না। যেহেতু এই সময় আত্মমর্যাদা সৃষ্টি হয় তাই একটা ব্যাপার মনে রাখতে হবে, আগে যেখানে ছিল শুধু ভালোবাসা এখন সেখানে ভালোবাসা এবং সম্মান দুইটাই থাকবে। এই সময় সন্তানদের আত্মমর্যাদা বা সম্মানের একটা চাহিদা থাকে। সে চায় সবাই তার নিজস্ব ভাবনাকে সম্মান করুক। যখনই বাবা-মা সন্তানের সিদ্ধান্তকে সম্মান করছে না তখনই তাদের মধ্যে একটা দূরত্ব সৃষ্টি হচ্ছে। সন্তান যদি মনে করে যে বাবা-মা তাদের বুঝতে পারছে না তখনই তাদের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়। সন্তানের সঙ্গে যোগাযোগটা সঠিক হতে হবে। তাহলেই তাদেরকে সহজে বোঝা যাবে। সন্তানের মনের মধ্যে কি চলছে সেটাও বাবা মাকে বুঝতে হবে। তারা কোন ব্যাপারে কষ্ট পাচ্ছে কিনা বা তাদের মধ্যে কোন বিষয়ে জিজ্ঞাসা আছে কিনা, তাদের সঙ্গে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে কিনা এই ব্যাপারগুলো মা-বাবাকেই বুঝতে হবে।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের দূরত্ব কমিয়ে আনার উপায় কি?

ডা. মেখলা সরকার: সবার আগে বাবা-মাকে বুঝতে হবে সন্তানের যে শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তনগুলো হচ্ছে সেটি তার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় তাদের মধ্যে মর্যাদাবোধ যেমন সৃষ্টি হয় তেমনি করে তারা আশা করে অন্যরাও তার কথা মন দিয়ে শুনবে। শুধু বাবা-মা নয় তাদের বাইরেও অন্যান্য মানুষের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তাদের এই শারীরিক এবং মানসিক পরিবর্তনগুলো বাবা- মাকে ঠিকমত বুঝতে হবে। সন্তান কাদের সঙ্গে মিশবে সেই ব্যাপারে মা-বাবার নিয়ন্ত্রণ থাকতে হবে।নিয়মিত তাদের খোঁজখবর নিতে হবে। নিয়ন্ত্রণ এর প্রথম ধাপ হল সন্তানকে কোন অবস্থায় অপমান করে কথা না বলা অর্থাৎ তার সঙ্গে এমন কোন কথা বলা যাবে না যাতে তার সম্মানহানি হয়। তাকে খারাপ কথা বলা যাবে না। এমনকি তাকে অন্যের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। অর্থাৎ এমন কিছু করা যাবে না যাতে সে মনে কষ্ট পায়। এগুলো শিশুদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। একবার যদি তার মনে ঢুকে যায় যে সে খারাপ তাহলে তার ব্যক্তিত্ব সেই ভাবে গড়ে ওঠে। এই সময়টা শিশুদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি হয়। তাই তাদের আত্মবিশ্বাস কোন ভাবেই নষ্ট করা যাবে না। তারা যাতে আত্মবিশ্বাসী হয়ে পথ চলতে পারে এটা বাবা-মাকেই নিশ্চিত করতে হবে। তার মধ্যে কোন নেতিবাচক আচরণের প্রভাব যেন না পড়ে এদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে এবং সে যেন আত্মবিশ্বাসহীন হয়ে না যায় সেটাও দেখতে হবে।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

সন্তান নেতিবাচক আচরণ করলে করনীয় কি?

ডা. মেখলা সরকার: সন্তান যদি কোন নেতিবাচক আচরণ করে তাহলে সরাসরি সেই ব্যাপারে তখনই কোনরকম প্রতিক্রিয়া না দেখানো। অর্থাৎ তাকে রাগত অবস্থায় কোন কিছু না বলা। তাকে ঠান্ডা মাথায় বোঝানো আপনি আসলে তার কাছে কি চান। কোন ভাল কাজ করলে সেই ব্যাপারে তাকে বার বার উৎসাহ দেয়া যাতে সে ভালো কাজের জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠে। সন্তান যদি কোন শাস্তিযোগ্য অপরাধ করে ফেলে তাহলে পরিবারে বাবা-মায়ের ক্ষমতা বা তাদের কার্যকারিতা তাকে বুঝিয়ে দিতে হবে। যাতে সে বুঝতে পারে তার কাজটা ঠিক হয়নি এবং এটা একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কাজটা কিভাবে করলে তার জন্য ভাল হবে সে ব্যাপারে তাকে ঠাণ্ডা মাথায় বুঝিয়ে বলা।

প্রথম আলো ট্রাস্ট:

সন্তানের ভাল কাজের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিৎ?

ডা. মেখলা সরকার: সন্তান যখন ভালো কাজ করবে তখন তাকে অবশ্যই যেটা সত্যি সেই পরিমাণ প্রশংসাই করা উচিত। কোন মিথ্যা প্রশংসা করা উচিত নয়। আপনার যে আস্থা তার প্রতি তৈরি হয়েছে এটা যদি সে বুঝতে পারে তাহলে প্রশংসা দিয়ে অনেক কিছু তাকে দিয়ে করানো সম্ভব। শুধুমাত্র পড়াশোনায় ভালো করাটাই গুণাবলী নয়। অন্যান্য মানবিক গুণাবলীও তার মধ্যে দেখা গেলে তাকে অবশ্যই প্রশংসা করতে হবে। যাতে সে ভালো কাজ করতে আগ্রহী হয়। এগুলো তাকে সামনে এগোতে সাহায্য করবে।