প্রযুক্তি আসক্তি ও মাদকাসক্তি: সমাধানের উপায় কী
প্রথম আলো ট্রাস্টের একটি নিয়মিত আয়োজন মাদকবিরোধী পরামর্শ সভা। গত ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, প্রথম আলো ট্রাস্ট আয়োজিত অনলাইন (১৬৯ তম) মাদকবিরোধী পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার আলোচক জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. ফারজানা রহমান ‘প্রযুক্তি আসক্তি ও মাদকাসক্তি: সমাধানের উপায় কী’ এই বিষয়ের উপর আলোচনা করেন।
তিনি প্রযুক্তি আসক্তির সজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেন, মোবাইল ফোন, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, গেমিং সিস্টেম—বিশেষ করে পর্দায় কাজ করা যায় এমন যেকোনো যন্ত্রের প্রতি তীব্র টানই হলো প্রযুক্তি আসক্তি। বিশেষ করে কিশোরদের মধ্যে প্রযুক্তি আসক্তি দেখা গেলেও সব বয়সের মানুষই এতে আসক্ত হতে পারে।
প্রযুক্তি আসক্ত ব্যাক্তিকে কীভাবে চেনা যায় এই প্রসঙ্গে ডা. ফারজানা রহমান বলেন, ‘যে কোন ধরনের প্রযুক্তিতে যদি কেউ আগের চেয়ে বেশি সময় দেয় তখনই আমরা বুঝবো সে আসক্তিতে জড়িয়ে পড়েছে। এই আসক্তির ফলে সে তাঁর পেশাগত কাজ, শিক্ষাসংক্রান্ত কাজ, পরিবারিক কাজ, ব্যাক্তিগত কাজে সমস্যার মধ্যে পড়ে। অনেকেই এই আসক্তি থেকে মুক্তি পেতে চায় কিন্তু সহজে মুক্তি মেলে না। একজন ব্যাক্তির বই পড়া, গান শোনা,মানুষের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার মত কাজগুলো হয়তো একসময় খুবই প্রিয় ছিল কিন্তু প্রযুক্তি আসক্তির ফলে প্রিয় কাজগুলো তাঁর আর ভালো লাগে না।
মাদকাসক্তি ও প্রযুক্তি আসক্তি সম্পর্কের বিষয়ে তিনি বলেন, মাদকাসক্তি ও প্রযুক্তি আসক্তি মস্তিষ্কের একই জায়গায় কাজ করে। যে কোন ধরনের আনন্দময় ঘটনা যেমন– পুরস্কার প্রাপ্তি, প্রিয়জনের সান্নিধ্য আমাদের মস্তিষ্ককে উদ্দীপ্ত হয়। মাদকাসক্তি ও প্রযুক্তি আসক্তির ফলেও মস্তিষ্ক উদ্দীপ্ত হয়। কিন্তু মাদকাসক্তি ও প্রযুক্তি আসক্তির ফলে মস্তিষ্ক ক্ষতিকরভাবে উদ্দীপ্ত হয়।’
মাদক ও প্রযুক্তি আসক্তির কারণ প্রসঙ্গে ডা. ফারজানা রহমান বলেন, জীবন চলার পথে নানা কারণে অনেকই কষ্ট পায়। এই বেদনাবোধ, কষ্টের অনুভূতি ভুলে থাকতে অনেকেই আসক্তির পথে পা বাড়ায়। এছাড়া বন্ধু–বান্ধবের সঙ্গে দূরত্ব, একাকিত্ব, হতাশা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বুলিংয়ের শিকার,পরীক্ষায় ভালো ফল না হওয়া, পরিবারিক সম্পর্কের অবনতি কিংবা নিছক কৌতুহল থেকে অনেকেই প্রযুক্তি কিংবা মাদকে আসক্ত হয়ে পড়ে।
আসক্তি থেকে বের হওয়ার উপায় প্রসঙ্গে তিনি বলে, মাদক কিংবা প্রযুক্তি আসক্তি থেকে বের হতে হলে প্রথমেই কারনটা খুঁজে বের করতে হবে। আসক্ত মানুষ যদি প্রথমেই বুঝতে পারে এই পথ থেকে মুক্তি পেতে হবে তাহলে আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়ার কাজটি সহজ হবে। প্রযুক্তি আসক্তি থেকে তরুণ–তরুণীদের দূরে রাখতে হলে বাবা–মায়ের বড় ভূমিকা রয়েছে। অভিভাবকেরা খেয়াল রাখবেন ল্যাপটপ, মোবাইল এইসব ডিভাইসগুলো সন্তানেরা যাতে একটা নির্দিষ্ট সময় ব্যবহার করেন। রাত বারোটার পরে ডিভাইস যাতে সন্তানের হাতে না থাকে এই বিষয়টা বাবা–মায়েদের খেয়াল রাখতে হবে।
প্রযুক্তি ব্যবহারে নিরাপত্তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের ছেলে–মেয়েরা বর্তমানে সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে মেয়েরা সাইবার বুলিংয়ের বেশি শিকার হয়। এর ফলে প্রযুক্তি ব্যাবহারের সাথে সাথে এর নিরপত্তার বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।
কিশোর–কিশোরীদের মাদক কিংবা প্রযুক্তিতে আসক্তির সম্ভবনা সব থেকে বেশি থাকে উল্লেখ করে তিনি বলেন, কিশোর–কিশোরীরা কোন কিছুতে আসক্ত হয়ে পড়লে বিষয়টি কাউকে শেয়ার করতে চায় না। চিকিৎসক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা হচ্ছে আমাদের সন্তানেরা যদি তাদের না বলা কথাগুলো আমাদেরকে সহজে বলতে পারতেন তাহলে অনেক সঙ্কট থেকে আমরা মুক্তি পেতাম। আমাদের অভিভাবকদের বলবো সন্তানদের বিচার করার পূর্বে তাদের কষ্টের কথাগুলো প্রথমে শুনতে হবে। সন্তানদের যে কোন সঙ্কটের সময় অভিভাবকদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তরুণ–তরুণীরা যদি তাদের সঙ্কটের কথাগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে অভিভাবকদের বলে কিংবা স্কুল–কলেজের কাউন্সিলর অথবা আপনজন কারও সঙ্গে শেয়ার করে তাহলে সঙ্কট থেকে সহজেই মুক্তি মিলবে।
মাদকাসক্তির সঙ্গে মানসিক রোগের গভীর সম্পর্ক রয়েছে উল্লেখ করে ডা. ফারজানা রহমান বলেন, কেউ যদি মাদক কিংবা প্রযুক্তি আসক্তির চরম পর্যায়ে পৌঁছায় তাহলে তাকে জরুরি ভিত্তিতে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে। এক্ষেত্রে আসক্ত ব্যাক্তি যদি চিকিৎসা নিতে অনিচ্ছুক কিংবা অনাগ্রহ দেখায় সেক্ষেত্রে তাকে চাপ প্রয়োগ করে চিকিৎসা সেবার আওতায় আনতে হবে। মাদকে আসক্ত হওয়ার ফলে কারও মধ্যে যদি আত্মহত্যার প্রবণতা, আন্য কাউকে আঘাত করার প্রবনতা দেখা যায় সেক্ষেত্রে আমাদের দেশে প্রচলিত আইন আনুযায়ী তাকে বল প্রয়োগ করে চিকিৎসা সেবার আওতায় আনতে হবে। যে কোন ধরণের আসক্ত ব্যাক্তিকে যদি সঠিকভাবে চিকিৎসা করা যায়, বাব–মা–পরিবার যদি সহযোগিতা করে তহলে মাদক কিংবা প্রযুক্তি আসক্তি থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
পারিবারিক জীবনযাপনে সততার চর্চা খুবই গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমাদের বাবা–মায়েরাও কিন্তু মোবইল কিংবা প্রযুক্তিতে আসক্ত। আমাদের সন্তানেরা যাতে মোবাইল দেখে ফুল, পাখি, সবজি না চেনে। সন্তানকে সময় দিতে হবে। সন্তানকে নিয়ে নিয়মিত গ্রামে যান, পার্কে কিংবা নার্সারিতে ঘুরতে যান। সন্তানকে গাছ, ফুল, পাখি কাছ থেকে চেনাতে শেখান। এছাড়া গান শোনা, গল্পের বই পড়া, আবৃত্তি শেখানো, ভালো সিনেমা দেখা এসবের সঙ্গে সন্তানকে যুক্ত করতে হবে। সন্তানকে নিয়ে আনন্দের সঙ্গে সময়কে উপভোগ করুন।
মাদকবিরোধী পরামর্শ সভাটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সভাটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।