মাদকের আসক্তি কাটাতে সন্তানের পাশে থাকুন

করোনার সময়ে অনলাইন ক্লাস করার জন্য ছেলের হাতে স্মার্টফোন তুলে দেন বাবা। এই ফোনের মাধ্যমে সে শুধু ক্লাসেই সীমাবদ্ধ থাকে না, মাদকের জগতেও জড়ায়। ছেলের জন্য বেশ কয়েক মাস রাজধানী ছেড়ে গ্রামে চলে যান মা–বাবা। ছেলেকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করেন

কিন্তু ছেলে তারপরও ফাঁকি দিয়ে অন্ধকার জগতেই যায়। অবশেষে ছেলেকে পুনর্বাসনকেন্দ্রে পাঠান। বাবা এখন ছেলেকে বাড়ি আনবেন। কিন্তু ছেলে ফিরলে তার সঙ্গে কী আচরণ করবেন, কীভাবে ছেলেকে চোখে চোখে রাখবেন, নানান প্রশ্ন এই বাবার মনে।

গতকাল শনিবার রাজধানীর ধানমন্ডির ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে প্রথম আলো ট্রাস্টের মাদকবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম নিয়মিত কার্যক্রম পরামর্শ সহায়তার অনুষ্ঠান হয়।

সে অনুষ্ঠানেই এই বাবার মতো আরও বাবা, মা, বোন এসেছেন আপনজনদের মাদক থেকে কীভাবে ফেরাবেন, তাদের সঙ্গে কী আচরণ করবেন, সেসব পরামর্শ নিতে। আলোচনা অনুষ্ঠানের আগে বিনা মূল্যে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা পরামর্শ ও চিকিৎসা সহায়তা দেন।

প্রথম আলো মাদকবিরোধী আন্দোলন ‘আসুন মাদকমুক্ত থাকি’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় অতিথিরা। গতকাল ধানমন্ডির ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে।
ছবি: দীপু মালাকার

অনুষ্ঠানে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক মোহিত কামাল বলেন, করোনায় অনলাইন স্কুল চালু করতে হয়। এতে শিশুরা অবাধে স্মার্টফোন, ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পায়। এতে তাদের নানান জায়গায় বিচরণ ঘটে, তারা সেদিকে মজা পায়। মানুষের ব্রেন যেদিকে মজা পায়, সেদিকে ছোটে, মাদকের মতো। যখন অনলাইনে আসক্ত হয়ে যাবে, তখন চট করে ইন্টারনেট–সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা, ফোন কেড়ে নেওয়ার মতো কাজ করা যাবে না। সন্তানকে একটি রুটিন দিতে হবে যে সে কতক্ষণ সময় ফোন ব্যবহার করতে পারবে। এ ছাড়া বই পড়া, গান শোনা, ঘুরতে নিয়ে যাওয়াসহ বিভিন্ন সামাজিক কাজের মধ্যে সংযোগ ঘটানোর মতো ব্যবস্থা করতে হবে, বিকল্প বিনোদনের ব্যবস্থা করতে হবে।

সন্তানের যেকোনো আসক্তি থেকে মুক্তির জন্য অভিভাবকের আবেগ বা আচরণও নিয়ন্ত্রণ জরুরি বলে জানান এই অধ্যাপক। তিনি বলেন, সন্তানের দোষ না ধরে পাশে থাকুন।

জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক মেখলা সরকার বলেন, নেশার খপ্পরে পড়লে তা জালের মতো জড়িয়ে যায়। যত সময় যায়, এই জাল তত বেশি জড়াতে থাকে। সামাজিক, শারীরিক ও মানসিক দিক বিবেচনায় নিয়ে একজন মাদকাসক্তের চিকিৎসা করা হয়। এ চিকিৎসাপ্রক্রিয়ায় পরিবারেরও সহায়তা প্রয়োজন।

অনুষ্ঠানে এক বোন এসে জানতে চান, তাঁর ভাই মাদক ছেড়ে দিলেও আচরণ স্বাভাবিক হচ্ছে না। তিনি কী করতে পারেন। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক অভ্র দাশ তাঁর উদ্দেশে বলেন, মাদক শুধু শারীরিক ক্ষতিই করে না, এটা মস্তিষ্কেরও ক্ষতি করে। অনেকে হয়তো মাদক থেকে ফিরে আসে, কিন্তু মস্তিষ্কে প্রভাব থেকে যায় এবং আচরণগত পরিবর্তন দেখা যায়। এর জন্য দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা প্রয়োজন।

ওসিডি বা চিন্তাবাতিক ও বাধ্যতাধর্মী আচরণ (শুচিবাই) থেকে মুক্তি পেতেও মানুষ মাদক গ্রহণ করে থাকে বলে জানান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অধ্যাপক সুলতানা আলগিন। তিনি বলেন, মাদকাসক্তের চিকিৎসার পাশাপাশি সাইকিয়াট্রিক চিকিৎসাও জরুরি।

কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময়কেন্দ্রের আবাসিক চিকিৎসক মো. রাহেনুল ইসলাম বলেন, মাদক থেকে পুরোপুরি ভালো থাকার বিষয়টি আজীবনের যুদ্ধ।

বিএসএমএমইউয়ের মনোরোগ বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সরদার আতিক শিশুদের শাসন করার বিষয়ে বলেন, গায়ে হাত তোলা যাবে না। সন্তানকে শাসন করা ও বন্ধুত্বের ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট মাত্রা বজায় রাখার কথা বলেন। তিনি বলেন, শিশুর সঙ্গে গল্প করতে হবে, তার জগতকে বুঝতে হবে।

একই বিভাগের আরেক সহকারী অধ্যাপক ফাতিমা মারিয়া খান জানান, বাচ্চাদের লালনপালন বা সন্তানের মানসিক অসুস্থতা থাকলে সে বিষয়ে পরিবারের জন্যও থেরাপির ব্যবস্থা আছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্বিবদ্যালয়ে।

মাদকবিরোধী আন্দোলনের এই পরামর্শ সভা সঞ্চালনা করেন প্রথম আলোর বিশেষ ক্রোড়পত্র সমন্বয়ক সাইদুজ্জামান রওশন।