মাদক: প্রতিরোধই সর্বোত্তম চিকিৎসা

মাদকবিরোধী সচেতনতা সভা স্কুল পর্যায়, রাজধানীর উত্তরায় স্কলাস্টিকা স্কুলে।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে হ্যালুসিনোজেনস গোত্রভুক্ত মাদকের আগ্রাসন দেখে চমকে উঠতে হয়েছে আমাদের। এ গ্রুপের মাদক এলএসডি আসক্ত কতিপয় যুবককে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। ভিডিও ফুটেজে দেখেছি, গ্রেপ্তারের কারণে কোনো ভয় কিংবা প্রতিক্রিয়া তাদের অভিব্যক্তিতে দেখা যায়নি।

গ্রেপ্তার হওয়ার পরও কেন আসক্ত তরুণেরা ছিল প্রতিক্রিয়াহীন, নির্বিকার কিংবা হাসিমুখে? এ প্রশ্নের উত্তর জানার আগে জেনে নিতে হবে হ্যালুসিনোজেনস শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ।

এটি এসেছে লাতিন শব্দ Allucinan থেকে। এর অর্থ dream to wonder in mind. চারপাশ প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা, আবেগ-অনুভূতি, এর প্রকাশসহ অন্য মানসিক প্রক্রিয়াগুলো বদলে দেয় কিংবা বিকৃত করে দেয় এ মাদক। যথাযথ চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পায়, ভেতরের শক্তি কিংবা তাগিদ উৎসাহ-আকাঙ্ক্ষা-চাহিদা—সবকিছু দখলে নেয় মাদক।

পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ব্রেন যেসব তথ্য গ্রহণ করে, তা প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে আমাদের বোধ তৈরি করে, উপলব্ধি তৈরি করে। এসব তথ্য যথাযথভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ আবেগ-অনুভূতির জন্ম দেয়। স্মরণশক্তি কিংবা কগনিটিভ প্রসেস বা অবহিতকরণ প্রক্রিয়ায়ও তা ব্যবহার করে ব্রেন। যথাযথ চিন্তা করা, যুক্তি আরোপ, সমস্যা সমাধান এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও কগনিটিভ প্রসেসের গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ। মাদক তা বিকৃত করে দেয়। মনের স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি বদলে যাওয়া কিংবা বিকৃত হওয়ার কারণে অভিব্যক্তি কিংবা আচরণেও তার প্রভাব পড়ে; যা আমরা দেখেছি ওই তরুণ দলের আচরণ ও প্রকাশভঙ্গিতে। হ্যালুসিনোজেনস ডিলিউশন সৃষ্টি করতে পারে।

ডিলিউশন (Delusion) অর্থ ভ্রান্ত-অলীক–অবিশ্বাস্য কোনো ঘটনাও সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে পারে। কোনো যুক্তি দিয়ে সে বিশ্বাস খণ্ডানো যায় না, তার অবস্থান থেকে তাকে টলানো যায় না। এভাবে আসক্তজন বদলে যায়। ব্রেনের ভেতর থেকেই বদলে যায়। তার আবেগ ও মানবিক অনুভূতি, যেমন শ্রদ্ধা-মায়া-মমতা-ভালোবাসা, বিশ্বাস-আস্থা—সব ছারখার হয়ে যেতে থাকে।

জাতিসংঘের ‘অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম’ প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য নিয়ে কাজ করে থাকেন। এবার যে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়েছে তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ : People first : stop stigma and discrimination, strengthen prevention. অর্থাৎ কুসংস্কার ও বৈষম্য দূর করে, মানুষকে সবার ওপরে স্থান দিয়ে প্রতিরোধকে গুরুত্ব দিতে হবে।

সবার ওপরে মানুষ । মানুষের অমানবিক হয়ে ওঠার পথ বন্ধ করতে হবে। কৌতূহল বা নানা কৌশলের জালে জড়িয়ে যারা আসক্ত হয়ে যায় তাদের প্রতি নেতিবাচক ধারণা বদলাতে হবে। তবে মাদক ব্যবসায়ীদের কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। আসক্তজন কিংবা তাদের পরিবারের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ দূর করতে হবে। তাদের অপরাধী না ভেবে , সহমর্মী হয়ে চিকিৎসার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে।

প্রতিরোধের প্রথম শর্ত নতুন করে যেন কেউ মাদক না নেয়। মাদককে ‘না’ বলতে হবে। ‘না’ বলার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। ‘না’ বলার জন্য আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। ‘না’ বলতে হলে অশুভ সঙ্গী ও অশুভ পরিবেশ থেকে দূরে থাকতে হবে। ভালো বন্ধু সার্কেল গড়ে তুলতে হবে। নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী ভালো ভালো কাজ করতে হবে। তাহলে সমাজের উন্নয়ন ঘটবে, দেশের উন্নয়ন ঘটবে।

মাদককে কীভাবে ‘না’ বলব

মাদককে ‘না’ বলা একধরনের বিশেষ দক্ষতা, ক্ষমতা। গুণটি অর্জনের জন্য শিশুকাল থেকে ঢেলে সাজাতে হয় ‘ব্যক্তিত্ব’। ‘ব্যক্তিত্ব’ই মানসিক কাঠামোর শক্তিশালী বনিয়াদ, প্ল্যাটফর্ম। দৈনন্দিন জীবনে পরিচিত, বহুল আলোচিত এ শব্দের অর্থ কী?

যখন শিশুবিকাশের কথা বলি, সহজে বুঝতে পারি, কী ধরনের বৈশিষ্ট্য (traits) নিয়ে বড় হচ্ছে শিশু। এ বৈশিষ্ট্য বা গড়ন সহজেই এক শিশু থেকে অন্য শিশুকে আলাদা করে দিতে পারে, শিশুটির সামাজিক অবস্থানও আলাদা হয়ে ওঠে একই কারণে।

ব্যক্তিত্বের কাঠামোর মধ্যে রয়েছে শিশুর আত্মোপলব্ধি, নিজস্ব ধারণা (self concept) ও বৈশিষ্ট্য। ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে যায় কীভাবে একটি শিশু নিজেকে জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেবে। বিকাশের ধারায় সন্তান যে আত্মোপলব্ধি অর্জন করে, মানুষের গুণাবলি হিসেবে সেটি স্থায়ী হয়ে যায়। এভাবে পরিবেশের মধ্যে কোনো কোনো শিশু হয়ে ওঠে আত্মবিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী নিজের প্রতি আত্মসম্মানবোধ নিয়ে বড় হতে থাকে, নৈরাশ্য গ্রাস করতে পারে না, জীবন সম্পর্কে তারা থাকে আশাবাদী।

আবার অনেকের ব্যক্তিত্বের গড়ন এমন থাকে, কোনো কিছুতেই ‘না’ বলতে পারে না। বুঝেও প্রতিরোধ করতে পারে না অনৈতিক আহ্বান। এ ধরনের ব্যক্তিত্বের অধিকারীরা মনে করে, ‘না করা’ মানেই ‘অন্যকে কষ্ট দেওয়া’, ‘নিজে ছোট হয়ে যাওয়া’, ‘বন্ধু হারানো’, ‘দলছুট হওয়া’, ‘তারা আমার সঙ্গে মিশবে না’, ‘আমার ক্ষতি করতে পারে’ ইত্যাদি আশঙ্কা ও নেতিবাচক ভাবনার জালে জড়িয়ে যাওয়া। ফলে অন্যদের অশুভ প্রভাবকে ‘না’ বলতে পারে না। মাদক প্রতিরোধে তাই সচেতনভাবে ছেলেবেলা থেকেই শিশুকে কৌশলে  দক্ষ করে তুলতে হবে।

লেখক: সাবেক পরিচালক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।