আজ ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। ১৯৯২ সাল থেকে মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতনতার উদ্দেশ্যে দিনটি পালিত হয়ে আসছে। এ বছর এই দিবসের প্রতিপাদ্য হলো: বিপর্যয় ও জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবার অধিকার" (Access to Services: Mental Health in Catastrophes and Emergencies)। এই প্রতিপাদ্যটি সহজ ভাষায় বুঝিয়ে দেয়, যে সময় এসে গেছে যে, জীবনের চরম সংকটকালেও যেন মানসিক স্বাস্থ্যসেবা থেকে কেউ বঞ্চিত না হয়।
মানুষের জীবন সব সময় এক সরল রেখায় চলে না। প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন: ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প আবার এইযে বিশ্বের নানা দেশে যুদ্ধ বা সংঘাত চলছে—এই বিষয়গুলোও আমাদের মনে আঘাত করে। বিপর্যয়ের শিকার প্রায় প্রতিটি মানুষই তীব্র মানসিক চাপ, ভয়, উদ্বেগ এবং দুশ্চিন্তার মধ্য দিয়ে যায়। প্রিয়জন হারানোর বেদনা, ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তা, জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারিয়ে ফেলার যন্ত্রণা—এই সবকিছু মিলিয়ে মানসিক সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। অনেকেই এই সময় ঘুমের সমস্যা, দুঃস্বপ্ন দেখা, হতাশা বা পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার (PTSD)-এর মতো রোগে ভুগতে পারেন। অন্যদিকে এই সব পরিস্থিতিতে মানুষের কষ্ট-অসহায়ত্ব, দেখেও আমাদের মনে ক্ষত তৈরি হয়।
যারা আগে থেকেই মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন, জরুরি পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থা আরও খারাপ হয়ে যায়। কিন্তু এই সময়েই মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার সুযোগ সীমিত হয়ে আসে, প্রায় পাওয়া যায় না বললেই চলে।
২০২৫ সালের এই প্রতিপাদ্য এক জোরালো বার্তা দিচ্ছে: খাবার, পানি, চিকিৎসার মতো, মনের যত্নও সমানভাবে প্রয়োজন। বিশেষকরে বিপর্যয় বা জরুরি পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া একটি মৌলিক অধিকারের মতোই মানবিক অধিকার।
এই অধিকার নিশ্চিত করতে আমাদের করণীয়:
প্রথমত সচেতনতার কোন বিকল্প নাই। এর বাইরেও আরও কিছু প্রস্তুতি আমাদের নিয়ে রাখা উচিত-
১. সহানুভূতিশীল সমাজ: আমাদের চারপাশে যারা বিপর্যয়ের শিকার, তাদের প্রতি সহানুভূতি ও সহমর্মিতা দেখানো অত্যন্ত জরুরি। তাদের কথা মন দিয়ে শোনা এবং তাদের পাশে থাকাটাই চিকিৎসার প্রথম ধাপ।
২. নেতিবাচক ধারণা দূর করা: মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের সমাজে নানা রকম নেতিবাচক ধারণা (Stigma) রয়েছে, তা দূর করতে হবে। ব্যাপকভাবে সচেতনতা তৈরি কাজ করতে হবে। মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা কোনো দুর্বলতা নয়, বরং এটি যে কোনো রোগের মতোই স্বাভাবিক।
৩. স্বেচ্ছাসেবকদের মানসিক প্রাথমিক চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দেওয়া: যারা দুর্যোগকালীন সময়ে মানুষের পাশে দাঁড়ান, সাহায্য করেন যেমন—স্বেচ্ছাসেবক, উদ্ধারকারী দল, স্বাস্থ্যকর্মী—তাদেরও 'মানসিক প্রাথমিক চিকিৎসা' (Mental Health First Aid) সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া, যাতে তারা প্রাথমিকভাবে মানসিক কষ্টের শিকার মানুষদের প্রাথমিক সাহায্য করতে পারেন।
৪. সহায়তা কেন্দ্র তৈরি: জরুরি অবস্থায় আক্রান্তদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সহায়তা কেন্দ্র তৈরি করা, যেখানে প্রশিক্ষিত চিকিৎসক ও পরামর্শদাতা থাকবেন। যেকোনো দুর্যোগকালীন সময়ে যেন তাঁরা সেই সহায়তা কেন্দ্রে গিয়ে সহায়তা নিতে পারেন।
নিজের প্রতি যত্নশীল হন-
• আজকের দিনে কেবল অন্যের কথা ভাবলেই হবে না, নিজের মনের যত্নের দিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
• নিজের অনুভূতিগুলো বিশ্বস্ত কারও সঙ্গে ভাগ করে নিন।
• পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নিন।
• নিয়মিত হালকা ব্যায়াম করুন এবং সুষম খাবার খান।
• যদি বুঝতে পারেন যে মানসিক চাপ বা দুঃখ দীর্ঘস্থায়ী হচ্ছে এবং দৈনন্দিন জীবনে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে, তবে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিতে দ্বিধা করবেন না।
আমরা এমন একটি সমাজ গড়ব, যেখানে শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হবে, বিশেষ করে যখন জীবন চরম সংকটের মুখে এসে দাঁড়ায়, তখনো যেন শারীরিক সুস্থতার মতো মনের সুস্থতার বিষয়ে আমাদের সমাজের মানুষেরা সমানভাবে সচেতন হন-কোনো বিপর্যয়ই যেন মানুষকে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে না পারে, এটিই হোক আমাদের অঙ্গীকার।