ইয়াবা, গাঁজা যেমন মাদক হিসেবে ধরা হয় তেমনি নিকোটিনকে আলাদা রাখার প্রবণতা রয়েছে। কেউ কেউ ধূমপানকে মাদক বলতে চান না। আমেরিকার গবেষণায় দেখা যায়, নিকোটিনকেও মাদক বলা হয়েছে। অন্যান্য মাদকের মতো নিকোটিনে আসক্তি তৈরি করে।
ধুমপানের স্বাস্থ্যগত দিকটা সবাই জানে। সিগারেটের ক্ষতির কথা সিগারেটের প্যাকেটেই লেখা থাকে। ধূমপানে ক্যান্সার হয়। এর যে আসক্তি হওয়ার প্রবণতা, সেটা লোকে কম জানে। কোন ব্যক্তি ইয়াবা বা হোরোইনে আসক্ত হলে ছেড়ে দেওয়া যেমন কঠিন, তেমনি ধূমপানে আসক্ত হলেও ছাড়া কঠিন। নিকোটিনে শারীরিক আসক্তি হয় না, কিন্তু আসক্তি হয় মানসিক। যিনি ধূমপান করেন প্রতিবার ছাড়ার চেষ্টা করেন, তারপরও পুনরাসক্তি হয়।
প্রথম আলো ট্রাস্টের একটি নিয়মিত আয়োজন মাদকবিরোধী পরামর্শ সভা। গত ২৯ অক্টোবর ২০২২, প্রথম আলো ট্রাস্ট আয়োজিত অনলাইন মাদকবিরোধী পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ‘ধূমপান ছাড়ার কৌশল’ শিরোনামে এ সভায় শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের সাইকিয়াট্রি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ডা. মো. জিল্লুর রহমান খান নানা প্রশ্নের উত্তর দেন।
সভায় চিকিৎসক জানান, ‘যিনি সিগারেট খাচ্ছেন তিনি কি পরিমাণে নিচ্ছেন, এটা দেখতে হবে। কেউ দৈনিক চারটা বা পাঁচটা সিগারেট খাচ্ছেন। কেউ আবার ১০ থেকে ১২ টা নিচ্ছেন । দুইটার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। দৈনিক যিনি বিশটা সিগারেট খান তার জন্য ছেড়ে দেওয়াটা কঠিন। প্রথম দিকে প্রত্যাহারজনিত সমস্যা হতে পারে । কিন্তু এটা ছেড়ে দিতে ইচ্ছা শক্তিই যথেস্ট । ইচ্ছা শক্তি ও মোটিভেশন দরকার । কিন্তু যিনি দিনে ৪ থেকে ৫ টা নিচ্ছেন তার জন্য ছেড়ে দেওয়া সহজ। আর যারা কম পরিমাণে খান, তাদের ছেড়ে দেওয়ার তুলনামূলকভাবে সহজ হয়। কালকে ছেড়ে দেব, এই ইচ্ছা শক্তিই যথেষ্ট। ছেড়ে দেওয়ার পর এক দুই দিন খারাপ লাগবে ঠিকই কিন্তু ইচ্ছাশক্তি ও মোটিভেশন তাকে এটা ধরে রাখবে।’
নিজেকে কিসের মধ্যে ব্যস্ত রাখলে ধূমপানে পুনরাসক্তি কম হবে? এর উত্তরে ডা. মো. জিল্লুর রহমান খান বলেন, ‘ধূমপান ছেড়ে দিলে প্রতাহারজনিত সমস্যা হয়। ধূমপান ছেড়ে দিয়ে শুধু বসে থাকা নয়। বিভিন্ন কাজের সঙ্গে যুক্ত হবেন। এ জন্য মোটিভেশনাল কাউন্সেলিং দরকার। কারও কারও সাইকোথেরাপির প্রয়োজন হতে পারে। দিনের রুটিন ফলো করা। আগে থেকে প্রস্তুত থাকতে হবে। অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। সামান্য সমস্যা অস্থিরতায় বিষন্নতা নয়। এই কাজটা নিয়মিত করতে হবে। বেড়াতে যেতে পারেন। বাচ্চাদের সময় দিতে পারেন। এই ধরনের কমর্সূচির মধ্যে থাকলে সহজেই ধূমপান না করতে পারে। যারা বেশি পরিমাণে ধূমপান করেন তাদের প্রত্যাহারজনিত সমস্যা হতে পারে। মানসিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। অস্থিরতা দেখা দিতে পারে, ঘুমের সমস্যা হতে পারে । মানসিকভাবে ক্লান্ত হতে পারে। আস্তে আস্তে ধুমপান ছাড়তে হবে। ধীরে ধীরে সংখ্যার পরিমাণ কমাতে হবে। মোটিভেশন কাউনসিলিং সাইকোথেরাপি দরকার।’
তিনি আরও যুক্ত করে বলেন, ধূমপান হল মাদকের গেটওয়ে। বিষন্নতা, উদ্বেগ, মানসিক সমস্যা থেকে শারীরিক রোগ যেমন অ্যাজমা , ব্রংকাইটিস দেখা দিতে পারে। এ জন্য চিকিৎসার প্রয়োজন। ধুমপান ছাড়ার ইচ্ছা শক্তি বাড়ানো দরকার। ধূমপান ছাড়ার পর পুনরাসক্তি হতে পারে। এক বছর পরেও পুনরাসক্তি দেখা যায়।
ধূমপানের সঙ্গে স্মার্টনেসের কোন সর্ম্পক নেই। কোন তরুণ যদি মনে করে ধূমপান করে স্মার্ট হব, তিনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
৪৫ বছর বয়সে ১০বার ধূমপান ছেড়েছি। কিভাবে ছাড়ব? এর উত্তরে ডা. মো. জিল্লুর রহমান খান বলেন, ‘ধূমপান ছাড়ার মোটিভেশন লেভেলটা সুদৃঢ় করতে হবে । তিনটি জিনিস খেয়াল করতে হবে। সময়, স্থান ও ব্যক্তি। যে সময়ে ধূমপান করতেন, যে স্থানে বসে ধূমপান করতেন, যে ব্যাক্তির সঙ্গে ধূমপান করতেন। এই গুলো এড়িয়ে চলতে হবে। যে সময়ে ধূমপান করতেন ওই সময়ে ভুলে থাকার জন্য সৃজনশীল কোন কাজ করতে পারেন। যে ব্যক্তির সঙ্গে ধূমপান করতেন সেই ব্যক্তিকে এড়িয়ে চলতে পারেন। কেউ যদি অফার করে তাকে রিজেক্ট করতে হবে । মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ দেখাতে হবে। কারও কারও ধারণা আছে ধূমপান ছাড়তে ডাক্তারের কাছে যেতে হয় না, এটি ভুল। ধূমপান ছাড়তে ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। গবেষণায় দেখা যায়, তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বেশি ধূমপায়ী। বিশেষ করে ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে ৫০-৬০ ভাগ ধুমপান করে। তরুণ বয়সে ধূমপান শুরু হয়। তরুণদের কাছে সেলিব্রিটি কারা। তাদের সেলিব্রেটিরা ধূমপান করে। কিশোর তরুণেরা সেলিব্রিটিদের অনুকরণ করতে চায়। কোন কোন সেলিব্রিটি প্রকাশ্যে ধূমপান করে। কিশোর তরুণ ওই সব সেলিব্রিটিদের অনুকরণ করে। বন্ধু কোন বন্ধুকে ধূমপানের জন্য অফার করলে তা ‘না’ করবে।’
মেয়েদের ধারণা ধূমপান করলে সে স্মার্ট। এটা কি ঠিক? এর উত্তরে ডা.জিল্লুর রহমান খান বলেন, ‘স্মার্টনেস চিন্তা চেতনা, রুচি, মনন, বাচনভঙ্গির উপর নির্ভর করে। সিগারেট খেলেই স্মার্ট হয় না। কিংবা পোশাক দিয়েই স্মার্ট হয় না। স্মার্ট সম্পর্কে তাদের ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। কিশোর তরুণেরা সেলিব্রিটিদের অনুকরণ করতে চায়। কোন কোন সেলিব্রিটি প্রকাশ্যে ধূমপান করে। সেটা ওই সেলিব্রেটির সমস্যা। এর সঙ্গে স্মার্টনেসের কোন সর্ম্পক নেই। কোন তরুণ যদি মনে করে ধূমপান করে স্মার্ট হব, তিনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘ধূমপান করলে মুখে দুর্গন্ধ হয়। খারাপ লাগে। দুর্গন্ধ তো কোন স্মার্টনেসের বহি:প্রকাশ নয়। এটা তরুণদের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে । ধরা যাক, তিনজন বন্ধুর মধ্যে দুজন একসঙ্গে সিগারেট খেল। অন্যজনের উপর চাপ তৈরি হল। সিগারেট খেলে উচ্চ রক্তচাপ, ক্যান্সার হয়, শারীরিক অনেক সমস্যা হয় । এই সচেতনতা যদি থাকে ওই বন্ধু নিজেকে দূরে রাখতে পারে। ধূমপান না করাটাই স্মার্টনেস। ধূমপানে নিজের ক্ষতি হচ্ছে। মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, সেই বার্তাটা তরুণদেরকে দিতে হবে। এটি পশ্চাৎমুখী চিন্তা। তরুণ-তরুণীকে এর থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সিগারেটকে ‘না’ বলা শিখতে হবে, বর্জন করতে শিখতে হবে।’
টেনশনে সিগারেট খেতে ইচ্ছে করে, এখন কি করব? এর উত্তরে ডা.জিল্লুর রহমান বলেন, ‘নিকোটিনে উদ্বেগ, অস্থিরতা কমায় — এটা সাময়িক। বরং উদ্বেগ, অস্থিরতা আরও বাড়ায়। এটা সাইকোলজিক্যাল ইস্যু । মানসিক চাপ বোধ করলেই সিগারেট খাওয়া —এটা ভুল। মানসিক চাপ বোধ করলে ব্যায়াম করা, দুশ্চিন্তা না করা। দুশ্চিন্তা দূর করার ব্যায়াম আছে, যেমন মনোযোগ বাড়ানো, কাজের সিডিউল করা, প্রার্থনা করা। যে সব কাজ স্বাস্থ্যকর,তাই করা উচিত। স্বাস্থ্যকর প্রক্রিয়ায় এ সবের মোকবিলা করা যায়। ধূমপান স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। মানসিক অনাকাঙ্ক্ষিত কোন ঘটনা ঘটলে ধুমপান করা যাবে না । সাময়িক আনন্দ হলেও দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি হয়। ধূমপান শারীরিক ও মানসিক ক্ষতি করে।
ইদানিং বিশেষ করে করোনার পরে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে নিয়মতান্ত্রিক লাইফস্টাইল নেই। দিনে ঘুমাচ্ছে রাত জেগে ফেসবুক লাইভ, ফাস্টফুড খাওয়ার কারণে স্থূলতা বেড়ে চলছে । মানসিক সমস্যা তৈরি হচ্ছে। ভালো থাকতে হলে স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করতে হবে।