মাদক মস্তিষ্কের রাসায়নিক দানব: প্রতিরোধই সর্বোত্তম চিকিৎসা

প্রথম আলো ট্রাস্টের আয়োজন মাদকবিরোধী পরামর্শ সভা। গত ১৪ মার্চ ২০২৩ তারিখ রংপুরের ইন্টারন্যাশনাল গ্রামার স্কুলে অনুষ্ঠিত হয়।

বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে হ্যালুসিনোজেনস গোত্রভুক্ত মাদকের আগ্রাসন দেখে চমকে উঠতে হয়েছে আমাদের। এ গ্রুপের মাদক এলএসডি আসক্ত কিছু যুবককে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। ভিডিও ফুটেজে দেখেছি তাঁদের। গ্রেপ্তারের কারণে কোনো ভয় কিংবা প্রতিক্রিয়া তাঁদের অভিব্যক্তিতে দেখা যায়নি। হাসিখুশি এই তরুণ দলটাকে দেখে শুধু জাতি চমকে ওঠেনি, পুলিশ দলও হতবাক হয়ে গিয়েছিল।

গ্রেপ্তার হওয়ার পরও কেন আসক্ত তরুণেরা ছিল প্রতিক্রিয়াহীন, নির্বিকার কিংবা হাসিমুখে? এ প্রশ্নের উত্তর জানার আগে জেনে নিতে হবে ‘হ্যালুসিনোজেনস’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ।

এটি এসেছে লাতিন শব্দ ‘Allucinan’ থেকে। এর অর্থ dream to wonder in mind। চারপাশ প্রত্যক্ষ করার ক্ষমতা, আবেগ-অনুভূতি এবং তার প্রকাশসহ অন্য মানসিক প্রক্রিয়াগুলো বদলে দেয় কিংবা বিকৃত করে দেয় এ মাদক। যথাযথ চিন্তা করার ক্ষমতা লোপ পায়, ভেতরের শক্তি কিংবা তাগিদ—উৎসাহ-আকাঙ্ক্ষা-চাহিদা সবকিছু দখলে নেয় মাদক।

পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ব্রেন যেসব তথ্য গ্রহণ করে, তা প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে আমাদের বোধ তৈরি করে, উপলব্ধি তৈরি করে। এসব তথ্য যথাযথভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ আবেগ-অনুভূতির জন্ম দেয়। স্মরণশক্তি কিংবা কগনিটিভ প্রসেস বা অবহিতকরণ প্রক্রিয়ায়ও তা ব্যবহার করে ব্রেন। যথাযথ চিন্তা করার ক্ষমতা, যুক্তি আরোপের ক্ষমতা, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাও কগনিটিভ প্রসেসের গুরুত্বপূর্ণ অনুষদ। মাদক তা বদলে দেয়, বিকৃত করে দেয়। মনের স্বাভাবিক গতিপ্রকৃতি বদলে যাওয়া কিংবা বিকৃত হওয়ার কারণে অভিব্যক্তি কিংবা আচরণেও তার প্রভাব পড়ে, যা আমরা দেখেছি ওই তরুণ দলের আচরণ ও প্রকাশভঙ্গিতে। এ মাদক কেবলই স্বপ্নময় জগতে আসক্তজনকে ছুটিয়ে নিয়ে যায় না, হ্যালুসিনোজেনস―ডিলিউশন সৃষ্টি করতে পারে। দুঃস্বপ্নে ডুবিয়ে দিতে পারে তাদের।

হ্যালুসিনোজেনস অর্থ চারপাশে কোনো ধরনের সেনসরি উদ্দীপক না থাকার পরও তা তারা দেখতে পায়, শুনতে পায়, তার স্পর্শ পায়, গন্ধ পায়, কিংবা স্বাদ পায়। বাস্তবে হ্যালুসিনেট করে এমন ব্যক্তির সঙ্গে কেউ কথা না বললেও আজগুবি কারও কথা সে শুনতে পারে।

আর ডিলিউশন (Delusion) অর্থ ভ্রান্ত-অলীক অবিশ্বাস্য কোনো ঘটনাও সে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতে পারে। কোনো যুক্তি দিয়ে সে বিশ্বাস খণ্ডানো যায় না, তার অবস্থান থেকে তাকে টলানো যায় না। চারপাশ বা সমাজের অন্য কেউ তা বিশ্বাস করে না, সামাজিক প্রেক্ষাপট বা ধর্মীয় অনুশাসন দিয়েও তা মাপা যায় না।

এভাবে আসক্তজন বদলে যায়। ব্রেনের ভেতর থেকেই বদলে যায়। তার আবেগ ও মানবিক অনুভূতি যেমন শ্রদ্ধা-মায়া-মমতা-ভালোবাসা, বিশ্বাস-আস্থা সব ছারখার হয়ে যেতে থাকে। দিন দিন হিংস্র-নিষ্ঠুর-নির্মম-পাষণ্ড হয়ে ওঠে আসক্তজন। তাদের মস্তিষ্ক রাসায়নিক বোমায় পরিণত হয়। বোমা বিস্ফোরিত হলে যেমন চারপাশ লন্ডভন্ড হয়ে যায় তেমনিভাবে তাদের হিংস্র আচরণ পুরো পরিবারকে তছনছ করে দেয়; প্রিয়জনের জীবন বিষিয়ে তোলে, নিঃশেষ করে দেয় পরিবার এবং স্বজনদের। জীবনের ট্রেক থেকে লক্ষ্যচ্যুত হয়ে যায় আসক্তজন।

সবার ওপরে মানুষ। মানুষের অমানবিক হয়ে ওঠার পথ বন্ধ করতে হবে। কৌতূহল বা নানা ফাঁদ কিংবা মাদক ব্যবসায়ীদের নানা কৌশলের জালে জড়িয়ে যারা আসক্ত হয়ে যায়, তাদের প্রতি নেতিবাচক ধারণা বদলাতে হবে। তবে ব্যবসায়ীদের কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। আসক্তজন কিংবা তাদের পরিবারের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ দূর করতে হবে। তাদের অপরাধী না ভেবে, জেলে না ঢুকিয়ে সহমর্মী হয়ে বিকল্প চিকিৎসার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে; evidence based voluntary service নিশ্চিত করতে হবে সবার জন্য। সর্বোপরি কুসংস্কারাচ্ছন্ন নেতিবাচক ধারণা বদলিয়ে বৈজ্ঞানিক চেতনায় আলোকিত হয়ে বৈষম্য থামাতে হবে, মাদক প্রতিরোধে আরও জোরদার ভূমিকা রাখতে হবে। সরবরাহ কমানো বা বন্ধ করার জোরালো উদ্যোগ নিতে হবে। ক্ষতিরোধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে। চাহিদাও কমাতে হবে। নতুন প্রজন্মের কেউ যেন মাদক নিতে না পারে, তার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর সরকারিভাবে এ কাজে নিয়োজিত থাকলেও তাদের জনবল পর্যাপ্ত নয়। অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও সমন্বিতভাবে ব্যবহার করে আকাশ, জল–স্থল সীমান্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে। দেশের ভেতরে মাদকের সরবরাহ রোধ করতেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সদা সতর্ক থাকতে হবে। বর্তমান সরকার মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করলেও, প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণ মাদক ধরা হলেও এর সরবরাহ বন্ধ করা যাচ্ছে না। চাহিদা বাড়ছে, সরবরাহ বাড়ছে। এই চেইন ভাঙার জন্য সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। বেসরকারি পর্যায়ও এ আন্দোলন জোরদার করতে হবে। ২০০২ সাল থেকে প্রথম আলো মাদকবিরোধী আন্দোলন, পত্রিকা প্রকাশের পাশাপাশি নিয়মিতভাবে সমাজ সচেতনতা এবং সেবামূলক এ কাজ করে যাচ্ছে। আরও আরও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে এলে জাতি উপকৃত হবে, তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করা সহজ হবে। জাতিসংঘের ‘অফিস অন ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম’ প্রতিবছর একটি প্রতিপাদ্য নিয়ে কাজ করে থাকেন।

এবার যে প্রতিপদ নির্ধারণ করা হয়েছে, তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ : People first : stop stigma and discrimination, strengthen prevention। অর্থাৎ

কুসংস্কার ও বৈষম্য দূর করে, মানুষকে সবার ওপরে স্থান দিয়ে প্রতিরোধকে গুরুত্ব দিতে হবে।

মাদকবিরোধী পরামর্শ সভার ১০০তম আসর। ধানমন্ডির রবীন্দ্রসরোবরে ২০১৮ সালের ছবি।

প্রতিরোধের প্রথম শর্ত নতুন করে যেন কেউ মাদক না নেয়―prevention of new incidence। মাদককে ‘না’ বলতে হবে। না বলার শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। ‘না’ বলার জন্য আত্মবিশ্বাসী হতে হবে। ‘না’ বলার শক্তি অর্জন করতে হলে নিজের দক্ষতাকে শাণিত করতে হবে। ‘না’ বলতে হলে অশুভ সঙ্গী ও অশুভ পরিবেশ থেকে দূরে থাকতে হবে। ভালো বন্ধু সার্কেল গড়ে তুলতে হবে। নিজের যোগ্যতা অনুযায়ী ভালো ভালো কাজ করতে হবে; নিজের মেধা নিজের উন্নয়নে ব্যয় করতে হবে। তাহলে সমাজের উন্নয়ন ঘটবে, দেশের উন্নয়ন ঘটবে।

পারিবারিক ও নৈতিক মূল্যবোধের মধ্য দিয়ে কাদামাটির বয়স থেকে শিশু লালন-পালনের সময় সন্তানের মনোজগতে এমন বৈশিষ্ট্যের বীজ রোপণ করতে হবে, যেন সে বড় হয়ে আত্মবিশ্বাসী-আত্মপ্রত্যয়ী-আত্মমর্যাদাশীল হয়। বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে মা–বাবাকে। আর এ জীবনচর্চায় প্রধান রসায়ন হচ্ছে শিশুর বয়সের স্তরে নেমে শিশুকে বোঝা। তার ভালো কাজের প্রশংসা করা। তার সঙ্গে সৎ থাকা। আনন্দময় পরিবেশে খেলাধুলার নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করা। তার নিরাপত্তাবোধ সুরক্ষা করা, ভুল কাজে তার উদ্দেশে শ্লেষাত্মক শব্দ ব্যবহার না করা। উপযুক্ত সময়ে তা বুঝিয়ে বলা, সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া।

ব্যতিক্রম থাকলেও বলা যায় আত্মবিশ্বাসী-আত্মপ্রত্যয়ী-আত্মমর্যাদাশীল সন্তানের পক্ষে মাদক থেকে দূরে থাকা সহজ হয়।

মাদককে কীভাবে ‘না’ বলব

মাদককে ‘না’ বলা একধরনের বিশেষ দক্ষতা, ক্ষমতা। গুণটি অর্জনের জন্য শিশুকাল থেকে ঢেলে সাজাতে হয় ‘ব্যক্তিত্ব’। ‘ব্যক্তিত্ব’ই মানসিক কাঠামোর শক্তিশালী বনিয়াদ, প্ল্যাটফর্ম। দৈনন্দিন জীবনে পরিচিত, বহুল আলোচিত―এ শব্দটির অর্থ কী?

যখন শিশু বিকাশের কথা বলি, সহজে বুঝতে পারি কী ধরনের বৈশিষ্ট্য (traits) নিয়ে বড় হচ্ছে শিশু। এ বৈশিষ্ট্য বা গড়ন সহজেই এক শিশু থেকে অন্য শিশুকে আলাদা করে দিতে পারে, শিশুটির সামাজিক অবস্থানও আলাদা হয়ে ওঠে একই কারণে।

ব্যক্তিত্বের কাঠামোর মধ্যে রয়েছে শিশুর আত্মোপলব্ধি, নিজস্ব ধারণা (self concept) এবং বৈশিষ্ট্যসমূহ। একটি চাকার সঙ্গে ব্যক্তিত্বের কাঠামোর তুলনা করা যেতে পারে। যদি স্পোকসকে ধরা হয় বিভিন্ন ধরনের বৈশিষ্ট্য, তবে কেন্দ্রস্থলটি হবে নিজের প্রতি নিজস্ব ধারণা বা উপলব্ধি। নিজস্ব মূল্যবোধ কিংবা নিজের প্রতি নিজের ধারণা শিশুর বিশ্বাস এবং মানসিক প্রক্রিয়া ও আচরণ প্রতিফলিত করে। সমাজের অন্যরা কী দৃষ্টিতে তাকে মূল্যায়ন করবে, নির্ধারিত হয়ে যায় শিশুর আত্মোপলব্ধির ভেতর থেকে। ব্যক্তিত্বের বৈশিষ্ট্যের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়ে যায় কীভাবে একটি শিশু নিজেকে জীবনের সঙ্গে মানিয়ে নেবে। বেড়ে ওঠার পথে শিশুর কাদামাটি বয়সে মননে ছাপ হিসেবে বসে যায় বৈশিষ্ট্যসমূহ। বিকাশের ধারায় সন্তান যে আত্মোপলব্ধি অর্জন করে, মানুষের গুণাবলি হিসেবে সেটি স্থায়ী হয়ে যায়। এভাবে পরিবেশের মধ্যে কোনো কোনো শিশু হয়ে ওঠে আত্মবিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী—নিজের প্রতি আত্মসম্মানবোধ নিয়ে বড় হতে থাকে, নৈরাশ্য গ্রাস করতে পারে না, জীবন সম্পর্কে তারা থাকে আশাবাদী—সহজেই প্রতিকূল পরিবেশ মোকাবিলা করার ক্ষমতা অর্জন করে নেয় আপন দক্ষতায়।

আবার অনেকের ব্যক্তিত্বের গড়ন এমন থাকে যে কোনো কিছুতেই ‘না’ বলতে পারে না। বুঝেও প্রতিরোধ করতে পারে না অনৈতিক আহ্বান। এ ধরনের ব্যক্তিত্বের অধিকারীরা মনে করে ‘না-করা’ মানেই ‘অন্যকে কষ্ট দেওয়া’, ‘নিজে ছোট হয়ে যাওয়া’, ‘বন্ধু হারানো’, ‘দলছুট হওয়া—‘তারা আমার সঙ্গে মিশবে না’, ‘আমার ক্ষতি করতে পারে’ ইত্যাদি আশঙ্কা ও নেতিবাচক ভাবনার জালে জড়িয়ে যাওয়া। ফলে অন্যদের অশুভ প্রভাবকে ‘না বলতে’ পারে না। মাদক প্রতিরোধে তাই সচেতনভাবে ছেলেবেলা থেকেই শিশুকে দক্ষ করে তুলতে হবে কৌশলে। জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান বলেছিলেন বিষয়টি নিয়ে শিশুকাল থেকে খোলামেলা আলাপ করতে হবে, শিশুদের সঙ্গে এর ক্ষতিকর প্রভাব এবং কীভাবে তারা ফাঁদে জড়িয়ে যেতে পারে, তা চোখের সামনে তুলে ধরতে হবে। তাহলে বড় হতে হতে সে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে নিজেকে সুরক্ষা করতে পারবে।

 

সমস্যা মোকাবিলায় কী করতে হবে

প্রধান কাজ হচ্ছে সঠিকভাবে ‘না বলা শেখা’র দক্ষতা অর্জন করা, দৃঢ়তার সঙ্গে নিজেকে প্রকাশের ক্ষমতা বাড়ানো। মনস্তত্ত্বের ভাষায় এই দক্ষতাকে বলে Assertiveness—অন্যকে কষ্ট না দিয়ে বা অসম্মান না করে নিজের ইচ্ছা, অনুভূতিকে দৃঢ়তার সঙ্গে প্রকাশ করার ক্ষমতা।

‘না বলা’র সময় অবাচনিক আচরণ বা যোগাযোগ যেমন চোখের দিকে তাকানো, কণ্ঠস্বর, মুখভঙ্গি ইত্যাদি সঠিকভাবে ব্যবহার করার দক্ষতা অর্জন করতে হবে। অর্থাৎ মাদকের আহ্বানকে না বলার সময় সরাসরি আহ্বানকারীর চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে হবে এবং কণ্ঠস্বর অতিরিক্ত নিচু বা উঁচু করা চলবে না। ক্ষেত্রবিশেষে মৃদু হেসে বিষয়টিকে এড়িয়ে যেতে হবে।

অপর পক্ষ আঘাত পায়, এভাবে কথা না বলা। যেমন বকাঝকা, গালাগাল না করা, অপমানজনক কথা না বলা।

মাদকসেবী এবং মাদক ব্যবসায়ীদের আহ্বানকে No thanks বলতে হবে। কিন্তু অনেকেই এই সহজ কথাটা সহজে বলতে পারে না বা ভুলে যায় বা অনভ্যাসের কারণে বলতে দ্বিধাবোধ করে। সব ধরনের অযৌক্তিক ক্ষেত্রে No thanks বলার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। মাদক নেওয়ার আহ্বানকে এভাবে সহজেই মোকাবিলা করা যায়।

ভবিষ্যতে মাদক নেওয়ার কোনো ধরনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া যাবে না। যেমন ‘আজ নেব না দোস্ত, অন্য দিন নেব’—এ ধরনের প্রতিশ্রুতির ফলে আসক্ত বন্ধুরা আবারও মাদক অফার করার সুযোগ পাবে।

অশুভ প্রভাবকে না বলার জন্য আহ্বানকারীর সামনে থেকে কৌশলে সরে যেতে হবে। এটি কার্যকরী একধরনের দক্ষতা।

মাদকের পরিবর্তে অন্য বিষয় নিয়ে কথা বলা বা অন্য কোনো কাজে মনোযোগ সরিয়ে নিতে হবে। যেমন আমি ক্ষুধার্ত, চলো আমরা বাসায় গিয়ে নাশতা করি।

রসবোধ ব্যবহার করে মাদকসেবী ও মাদক ব্যবসায়ীদের আহ্বানকে ‘না’ বলতে হবে। নির্ভর করে ব্যক্তির কৌতুকাশ্রয়ী রসবোধের ওপর।

মাদকসেবী, মাদক ব্যবসায়ী এবং মাদক পাওয়া যায়, এমন স্থান এড়িয়ে চলতে হবে।

মাদক গ্রহণ করে না, এ ধরনের ভালো বন্ধুর সংখ্যা বাড়ানো এবং তাদের সঙ্গে বেশি সময় কাটানোর অভ্যাস তৈরি করতে হবে।

সুস্থ বিনোদন, সৃজনশীল বা সমাজসেবামূলক কাজে নিজেকে জড়ালে মাদকাসক্তজন কিংবা মাদক ব্যবসায়ীও অশুভ পথে টেনে নিতে পারে না সুবোধ ও নরম প্রকৃতির কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীকে।

যেসব পরিস্থিতিতে নতুন করে বা পুনরায় মাদক নেওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে যেমন যেকোনো উৎসব উদ্‌যাপন (ঈদ, থার্টি ফার্স্ট নাইট, পয়লা বৈশাখ, জন্মদিন ইত্যাদি); একাকিত্ব; যেকোনো ধরনের ব্যর্থতা বা কোনো কিছু হারানো (পরীক্ষায় অকৃতকার্যতা, বিবাহবিচ্ছেদ, সম্পর্কচ্ছেদ, কারও মৃত্যু ইত্যাদি); হতাশা, বিষণ্নতা, ক্রোধ, ঘুমের সমস্যা, যৌন সমস্যা, হাতে প্রচুর টাকা চলে আসা, মাদক সম্পর্কিত ভুল ধারণা; মাদকের সহজপ্রাপ্যতা এবং মাদকাসক্ত ব্যক্তির সঙ্গ ইত্যাদি বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।

‘আমি নেশা করব না’, ‘পরখ করে দেখি কী মজা লুকিয়ে আছে’, ‘অল্পস্বল্প নিই’, ‘ইচ্ছা হলে খাব’, ‘ইচ্ছা হলে ছেড়ে দেব’, ‘মাদক আমাকে আসক্ত করতে পারবে না’—এ ধরনের চিন্তা শাসন করে নিজেকে মাদকমুক্ত রাখার জন্য বাড়াতে হবে অগ্রিম সচেতনতা। মনে রাখতে হবে, এ ধরনের ভাবনা চোরাবালিতে ডুবে যাওয়া কিংবা ফাঁদে আটকে পড়ার প্রাথমিক মননশীল ধস। এসব পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে সঠিক উপায়ে ‘না’ বলার দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে ব্যক্তি নিজেকে মাদক থেকে দূরে রাখতে পারে।

কেউ মাদক নেওয়ার জন্য আহ্বান করলে নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করতে হবে—‘কেন একটি রাসায়নিক পদার্থ ঢোকাব নিজের দেহে?’ ‘রাসায়নিক বিক্রিয়া তো বদলে দিতে পারে দেহ-মন, নিজের মস্তিস্কে ঢুকিয়ে দিতে পারে রাসায়নিক বোমা।’ ‘আপন দেহকে কেন কৌতূহল মিটানোর হোস্ট বানাব, কেন হব গিনিপিগ?’ ‘নিজেকে কেন বানাব মানববোমা?’

পরিস্থিতি থেকে দূরে সরে আসার সময় বাধা পেলে বিতর্কে না জড়িয়ে মনে মনে ভেবে নেওয়া প্রশ্নগুলো প্রয়োজনে দৃঢ়তার সঙ্গে তুলে ধরে সরে আসতে হবে আহ্বানকারীর সামনে থেকে।

মূল কথা, বাড়াতে হবে আত্মবিশ্বাস। যার আত্মসম্মানবোধ আছে এবং যে নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য সচেতন ও জীবন সম্বন্ধে আশাবাদী, সহজে কাবু করা যায় না তাকে। এমনই ব্যক্তিত্বের ভিত নির্মাণ করতে হবে, যেন অন্যরাই নিজস্ব আলোয় আলোকিত হয়, ভুলপথযাত্রী যেন তাকে টেনে নিতে না পারে অশুভ পথে।

মনে রাখা দরকার, প্রত্যেক ব্যক্তি এবং তাদের ব্যক্তিত্বের গঠন আলাদা। ওপরে আলোচিত কোনো একটা টিপস হয়তো কোনো একজনের জন্য কাজ করবে, আবার সেই টিপসটা অন্যের জন্য কাজ না-ও করতে পারে। টিপসগুলোর মধ্যে থেকে নিজের জন্য প্রযোজ্যটিই বাছাই করতে হবে, যেন সেটা সহজে ব্যবহার করে স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে মাদকসেবীর আহ্বানকে প্রতিরোধ করা যায়।

প্রয়োজনে কোনো মনোচিকিৎসক, চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী কিংবা প্রশিক্ষিত কাউন্সেলরের সেশনে বসে অনুশীলনের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস ও মাদককে ‘না বলা’র দক্ষতা অর্জন করতে হবে।

 সন্তানের ‘না বলা’র দক্ষতা অর্জনে মা-বাবার ভূমিকা

শিশুকাল থেকে সন্তানের মধ্যে ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের বীজ রোপণ করতে হবে।মা-বাবাকে মনে রাখতে হবে শিশুরা সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেয়ে থাকে খেলাধুলার মধ্য দিয়ে। শিশু বড় হয়, ধীরে ধীরে খেলতে শেখে। খেলার মধ্যে থাকে হারজিত। জয়ের মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস বাড়ে। হার আসতে পারে জীবনে, হারকেও সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে—এ বোধও শক্ত হয় খেলার মাঠে। কিন্তু খেলাধুলার সুযোগ না পেলে, দক্ষতা অর্জনের সুযোগ থাকে না, হীনম্মন্যতার বীজ রোপিত হয়ে যায় শিশুকাল থেকে।

মা-বাবার উচিত শিশুর ব্যক্তিত্ব এমনভাবে গড়ে উঠতে সহয়তা করা, যেন সে আত্মপ্রত্যয়ী-আত্মবিশ্বাসী হতে পারে। এ জন্য শিশুর সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি করতে হবে, সমালোচনা না করে যৌক্তিক বিষয়ে ‘হ্যাঁ’ বলার অভ্যাস করতে হবে। শিশুর আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ গড়ে তোলার জন্য লক্ষ্য হতে হবে বাস্তবসম্মত, যোগ্যতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। চাহিদার সীমানা উঁচু হলে সীমানা ডিঙানো কঠিন হবে, আত্মবিশ্বাসের ভিত ভেঙে যেতে পারে—মনে রাখতে হবে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি।

সৎ থাকতে হবে শিশুর সঙ্গে, শ্লেষাত্মক বাক্য ব্যবহার না করে, সব সময় হাসিমুখে আশ্বস্ত করতে হবে, প্রশংসা করতে হবে শিশুর। ভালো কাজে প্রশংসা করে উৎসাহ দেওয়া, অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণে যথাসম্ভব মনোযোগ না দেওয়ার অভ্যাস রপ্ত করতে হবে মা-বাবাকে।

 শিশুর মননে ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের বীজ রোপণ করতে হলে নিচের প্রতিটি বিষয়ের প্রতি নজর রাখতে হবে

যেসব পরিবেশ-পরিস্থিতি নেতিবাচক ধারণা গড়ে তুলতে পারে, সেই ক্ষেত্রগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে মা–বাবাকেই।

নিজের প্রতি শিশুর ব্যক্তিগত ধারণাটি একবার গড়ে উঠলে কিংবা ব্যক্তিত্বে একবার নেতিবাচক ছাপ বসে গেলে পাল্টানো যায় না। ভুল ধারণা গড়ে ওঠার পর শুদ্ধ করার জন্য জোর করে লাভ নেই। ভুল ধারণা গড়ে ওঠার আগেই সতর্ক থাকতে হবে।

বাবা–মায়েরা নিজেদের মনমেজাজ, আচরণের প্রতি নজর দেওয়া উচিত। নিজেদের ব্যক্তিত্বের আদলটি শিশুকে বেশি প্রভাবিত করে। মনে রাখতে হবে, অনুকরণ করে বাজে বৈশিষ্ট্য শিখে ফেলবে শিশু।

অসংযত কিংবা অশোভন আচরণের সমালোচনা, বকাঝকা কিংবা শাস্তি প্রয়োগের প্রতি নজর না দিয়ে শিশুর ভালো কাজের প্রশংসা করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। যেকোনো ছোটখাটো সফলতার জন্যও সঙ্গে সঙ্গে গিফট বা উপহার দিয়ে শিশুকে উৎসাহিত করতে হবে। কেবল দামি উপহারেরই প্রয়োজন নেই। আদর দিয়ে প্রশংসা বাক্যও হতে পারে একটি উপহার। কিন্তু প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। যৌক্তিক দাবি পূরণ করলেও অযৌক্তিক দাবি এড়িয়ে যেতে হবে কৌশলে।

ভুল করার পর সমালোচনা না করে কীভাবে শুদ্ধভাবে করা যায়, দেখিয়ে দিতে হবে। প্রয়োজনে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। উৎসাহ দিতে হবে।

এ ধরনের বৈশিষ্ট্য নিয়ে বেড়ে ওঠা শিশুরা অশুভ আহ্বানকারীকে ভবিষ্যতে ‘না-বল’তে পারবে। নিজেকে মাদকমুক্ত রাখতে পারবে।

পরিবারই হোক সুন্দর ব্যক্তিত্বের কাঠামো গড়ে তোলা ও পরিচর্যার কেন্দ্রস্থল।