মাদকাসক্তি এবং প্রযুক্তি আসক্তি – দুটোই কী এক

প্রথম আলো ট্রাস্ট আয়োজিত অনলাইন মাদকবিরোধী পরামর্শ সভার আলোচক জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আহমেদ হেলাল।

গত ১৫ জুন ২০২৩, প্রথম আলো ট্রাস্ট আয়োজিত অনলাইন মাদকবিরোধী পরামর্শ সভায় মাদকাসক্তি ও প্রযুক্তি আসক্তি নিয়ে আলোচনা হয়। সভার আলোচক জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আহমেদ হেলাল  ‘মাদকাসক্তি এবং প্রযুক্তি আসক্তি – দুটোই কী এক’ এই বিষয়ে আলোচনা করেন।

মাদকাসক্তি ও প্রযুক্তি আসক্তি দুটোই কী এক এ প্রসঙ্গে আহমেদ হেলাল বলেন, আসক্তির বিচারে মাদকাসক্তি ও প্রযুক্তি আসক্তি মস্তিষ্কে সামানভাবে কাজ করে। একই প্রক্রিয়ায় আসক্তিটা তৈরি হয়। তবে দুটোর মধ্যে একটু পার্থক্য রয়েছে। মাদকাসক্তি মূলত কেমিকেল নির্ভর আসক্তি। মাদকাসক্তির মাধ্যমে রাসায়নিক দ্রব্যের প্রতি আসক্তি তৈরি হয়। এটি আমাদের চিন্তা ও আচরণকে প্রভাবিত করে। প্রযুক্তি আসক্তির ক্ষেত্রে মস্তিষ্কে রাসায়নিক বস্তুর উপস্থিতি থাকে না কিন্তু এটিও মাদকাসক্তির মত আমাদের চিন্তা, আবেগ ও আচরণকে প্রভাবিত করে। আসক্তির দিক থেকে চিন্তা করলে মাদকাসক্তি ও প্রযুক্তি আসক্তি দুটোই এক। মাদকাসক্তি আমাদের মস্তিষ্কে কিছু রাসায়নিক পদার্থের পরিমান বাড়ায়,কমায় বা পরিবর্তন করে; মস্তিষ্ককে উদীপ্ত করে, এর ফলে বারবার একজন মানুষ মাদক গ্রহণ করে। তেমনিভাবে–  গেম হোক, মোবাইল হোক কিংবা ডিভাইসের প্রতি আসক্তি মস্তিস্ককে উদীপ্ত করে এবং প্রযুক্তির প্রতি আসক্তি তৈরি হয়।

সন্তানের প্রযুক্তি আসক্তির কারন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সন্তানেরা বাবা–মায়ের সঙ্গ চায়, তাদের কাছ থেকে গুনগত সময় চায়। কিন্তু বাবা–মায়েরা নিজেদের ব্যস্ততার কারণে অনেক সময় নিজেরাই সন্তানের হাতে বিভিন্ন ডিভাইস যেমন মোবাইল তুলে দেন। এর ফলে সন্তান বাবা–মায়ের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রযুক্তির সঙ্গে সময় কাটাতে থাকে। সন্তান নিজের চারদিকে একটা বলয় তৈরি করে। তার ভিতরে সে ডুবে যায়। প্রযুক্তির প্রতি আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। দ্বিতীয় আর একটি বিষয় শিশু কিশোরদের বাইরে খেলাধুলার সুযোগটা দিন দিন কমছে। এর ফলে শিশু–কিশোররা অন্তর্মুখী হচ্ছে, ঘরমুখী হচ্ছে, প্রযুক্তিতে আসক্ত হয়ে পড়ছে।

প্রযুক্তির ব্যবহার প্রসঙ্গে ড. আহমেদ হেলাল বলেন, প্রযুক্তি কিন্তু আমাদের সন্তানদেরকে ব্যবহার করতে দিতে হবে। কিন্তু তিনটি বিষয় মাথায় রেখে প্রযুক্তি সন্তানদের হাতে দিতে হবে। প্রথমত প্রযুক্তিটি সন্তানদের জন্য নিরাপদ কিনা, দ্বিতীয়ত এটি তার জন্য কার্যকরী কিনা তৃতীয়ত প্রযুক্তি সে যৌক্তিক সময় ধরে ব্যবহার করছে কিনা। এই তিনটি বিষয় মাথায় রেখে সন্তানকে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে দিতে হবে। প্রযুক্তি অনেকটা বিদ্যুতের মত। বিদ্যুত কিন্তু আমাদের জন্য খুব প্রয়োজন। আমি যদি বিদ্যুত স্পর্শ করি তাহলে বিদ্যুতায়িত হবে।  বিদ্যুতকে নিরাপদে ব্যাবহার করার জন্য আমরা আবরণ তৈরি করেছি, নিয়ন্ত্রনের জন্য সুইচ তৈরি করেছি। প্রযুক্তিও তেমনি; এটি ছাড়া আমাদের চলবে না কিন্তু ব্যবহারটা প্রয়োজন অনুযায়ী করতে হবে।

 সন্তানকে গুনগত সময় দেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন,  মাদক ও প্রযুক্তি থেকে দূরে রাখতে হলে বাবা–মা সন্তানদেরকে গুনগত সময় দেবেন। গুনগত সময়ের অর্থ কিন্তু বেশি সময় দেওয়া নয়। যতটুক সময় বাবা–মা সন্তানদের দেবেন সেই সময়টুকুতে যাতে পরস্পরের মধ্যে ভাবের আদান প্রদান হয়। সন্তানের মনের ভাষাটা যাতে বাবা–মা বুঝতে পারে। এর ফলে বাবা–মায়ের সঙ্গে সন্তানের বন্ধন দৃঢ় হবে। আর একটি বিষয় সন্তানকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ দিতে হবে। সকল সিদ্ধান্ত যাতে বাবা–মা সন্তানের উপর চাপিয়ে না দেয়। যে কোন সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে বাবা–মাকে সন্তানের সঙ্গে বারবার আলোচনা করতে হবে।  

 মাদকাসক্তি একটি ব্যাধি উল্লেখ করে আহমদে হেলাল বলেন সন্তান যদি কোন কারনে মাদকাসক্ত হয়ে যায় তাহলে তাকে রোগী হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। কোন কারনেই তাকে অপরাধী হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। অনেকেই লজ্জা পেয়ে সন্তানকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যায় না। এটি করা যাবে না। মাদকাসক্ত সন্তানকে কোন ভাবেই দূরে ঠেলে দেওয়া যাবে না। মাদকাসক্তি কোন অপরাধ নয় এটি একটা রোগ, এটি মনে রেখে সন্তানকে চিকিৎসার আওতায় আনতে হবে।

প্রযুক্তি আসক্তি প্রতিরোধের উপায় সম্পর্কে তিনি বলেন,  সন্তানকে প্রযুক্তি আসক্তি থেকে মুক্ত করতে চাইলে বাবা–মাকে অবশ্যই প্রযুক্তিতে দক্ষ হতে হবে। বাবা–মা প্রযুক্তিতে দক্ষ হলে তারা বুঝতে পারবে সন্তান  প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কী করছে। অনেক সময় দেখা যায় সন্তানেরা প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে গান শুনছে, কার্টুন দেখছে, ভালো সিনেমা দেখছে অর্থাৎ ভালো কনটেন্ট দেখছে কিন্তু এর ব্যাপ্তিকাল যদি দীর্ঘ হয় তাহলে এটি আসক্তির পর্যায়ে পড়ে।

প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার প্রসঙ্গে আহমেদ হেলাল বলেন, সন্তানকে আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে দেবো কিন্তু এটি ব্যবহারের জন্য পরিবারে একটা নিয়ম থাকতে হবে। একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর পরিবারের সকল সদস্যরা ডেস্কটপ বা ল্যাপটপ ব্যবহার করবে না। ঘুমাতে যাওয়ার দুই ঘন্টা আগে মোবাইল ব্যবহার বন্ধ রাখতে হবে। কমন ডেস্কটপ, ল্যাপটপ বাসার প্রাকাশ্য স্থানে রাখতে হবে। এগুলো বেডরুমের ভিতরে বা কোন গোপন জায়গায় রাখা যাবে না। প্রয়োজনে ওয়াই ফাই সংযোগ একটি নির্দিষ্ট সময়ের পর বন্ধ রাখতে হবে।  

মাদকবিরোধী পরামর্শ সভাটি একযোগে সম্প্রচারিত হয় প্রথম আলো ও প্রথম আলো ট্রাস্টের ফেসবুক ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে। সভাটি সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা।