নদীর মতো প্রবহমান এ জীবনের ছন্দে আকস্মিকভাবে ছেদ পড়তে পারে নানা কারণে। জীবন মনে হতে পারে ক্লান্তিকর, অসহনীয়। অথবা জীবনের নানা জটিলতা আতঙ্কগ্রস্ত করতে পারে আমাদের। এসব কঠিন সময়ে অনেকে মৃত্যুকে সবচেয়ে সহজ সমাধান ভেবে আত্মহত্যার মতো বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন।
১০ সেপ্টেম্বর ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন ফর সুইসাইড প্রিভেনশন’ দুনিয়াব্যাপী প্রতিবছর ‘বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস’ পালন করে। দিবসটির এ বছরের প্রতিপাদ্য হলো ‘ক্রিয়েটিং হোপ থ্রু অ্যাকশন’ যার বাংলা প্রতিপাদ্য ‘কর্মের মাধ্যমে আশার সঞ্চার’। একটা কথা আমাদের মনে রাখা জরুরি, মানুষ কিন্তু যেকোনো অবস্থায়ই বেঁচে থাকতে চায়। কারণ, মানুষ জন্মগতভাবেই বেঁচে থাকার প্রবণতার (Survival Instinct) জিনগত বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়। তাই যত মানসিক পীড়নই আসুক না কেন, সেটা মোকাবিলা করে মানুষ বেঁচে থাকতে চায়। এমনকি সন্তানের মৃত্যুশোকও আমরা ধারণ করি এবং জীবনকে সামনে এগিয়ে নিই। সুতরাং ব্যক্তি যতই দুঃসহ অবস্থার মধ্য দিয়ে যান না কেন, আত্মহত্যা কোনো অবস্থাতেই কোনো ধরনের পরিস্থিতির স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, সারা বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৮ লাখ মানুষ, অর্থাৎ প্রতি সেকেন্ডে ৪০ জন আত্মহত্যা করে। বিশ্বে এই হার ৭০ বছর ওপরের ব্যক্তিদের সবচেয়ে বেশি। যদিও বাংলাদেশসহ কিছু দেশে কম বয়সী ব্যক্তিদের মধ্যে এই হার বেশি। বাংলাদেশে গবেষণা অনুযায়ী, প্রতিবছর ১ লাখে ৩৯ দশমিক ৬ জন আত্মহত্যা করে, যার মধ্যে বিষপান এবং গলায় দড়ি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মাধ্যম। বিশ্বব্যাপী ছেলেদের মধ্যে আত্মহত্যার হার প্রায় তিন গুণ বেশি হলেও বাংলাদেশে এই হার মহিলাদের মধ্যে বেশি এবং কম বয়সী মেয়েদের মধ্যে এ হার সবচেয়ে বেশি।
কেন করে?
কেন মানুষ এমন করে, সে প্রশ্নের উওরে কোনো একক বিষয়কে দায়ী করা যায় না। বরং বলা যায়, ব্যক্তির জিনগত বৈশিষ্ট্য, মানসিক গঠন, সাংস্কৃতিক ও আর্থসামাজিক পরিবেশ এবং অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ বিষয়ের জটিল মিথস্ক্রিয়া এর জন্য দায়ী।
যদিও মানুষের যেকোনো কষ্টে বেঁচে থাকার দারুণ ক্ষমতা রয়েছে, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত অবস্থায় জীবনের চলমান কোনো সমস্যার সমাধানের কোনো পথ না পেলে মানুষ অনেক সময় এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এসব সমস্যা হতে পারে—
দীর্ঘস্থায়ী সম্পর্কজনিত জটিলতা
যেকোনো ব্যর্থতা
প্রেমে প্রত্যাখ্যান
বিচ্ছেদ
পরীক্ষায় ফল বিপর্জয়
আকস্মিকভাবে সামাজিক অবস্থান পরিবর্তন
আর্থিক অনটন, দীর্ঘস্থায়ী রোগ, পারিবারিক দ্বন্দ্ব ইত্যাদি।
তবে গবেষণায় দেখা গেছে, আত্মহত্যাকারীদের একটা বড় অংশ সে সময়ে কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকে। এর মধ্যে ত্রুটিপূর্ণ ব্যক্তিত্ব (৫০%), বিষণ্নতা (৬%), মাদকাসক্তি (বিশেষত অ্যালকোহল) (৭%) ও অন্যান্য জটিল মানসিক রোগ (সিজোফ্রেনিয়া) অন্যতম। এ ছাড়া সমস্যা মোকাবিলায় অদক্ষতা, হীনম্মন্যতা, সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বেশি থাকে।
মিডিয়া ও আত্মহত্যা
অন্যের আত্মহত্যার কথা জানা অনেক সময় নাজুক মানসিক অবস্থার ব্যক্তিদের উৎসাহিত করে। গবেষণায় দেখা গেছে, আত্মহত্যার হার সেলেব্রিটি, সমাজের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের আত্মহত্যা, জনপ্রিয় কোনো টিভি নাটক বা সিনেমায় এ ধরনের ঘটনা দেখানোর পর অনেক বেড়ে যায়। এ ধরনের খবর মিডিয়াতে কীভাবে, কতটা বিস্তারিত প্রচারিত হচ্ছে, সেসবের ওপর আত্মহত্যার হার বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া নির্ভরশীল।
আত্মহত্যা নিয়ে কিছু ভুল ধারণা এবং প্রকৃত তথ্য
ব্যক্তির সঙ্গে আত্মহত্যা নিয়ে কথা বললে এসব ঘটনাকে উসকে দেওয়া হয়।
প্রকৃতপক্ষে দেখা গেছে, যারা আত্মহত্যার চিন্তা করছে, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করলে তাদের মনের ভার লাঘব হয় এবং এই সাহায্যের হাত ধরতে চায়।
যারা মুখে আত্মহত্যার কথা বলে বা হুমকি দেয়, তারা কখনোই আত্মহত্যা করবে না।
কিন্তু গবেষণায় দেখা যায়, আত্মহত্যার আগে দুই-তৃতীয়াংশ ব্যক্তি এ বিষয় নিয়ে কথা বলেছে এবং এক-তৃতীয়াংশ ব্যক্তি সুনির্দিষ্টভাবে আত্মহত্যার ইচ্ছার কথা বলেছে।
আত্মহত্যার কথা বলা বা চেষ্টা করা মনের তীব্র কষ্টেরই একরকম বহিঃপ্রকাশ, যা শুধু মনোযোগ আকর্ষণের জন্য নয়। সুতরাং কখনোই এটা উপেক্ষা করা উচিত নয়।
আত্মহত্যা করতে গিয়ে বেঁচে যাওয়া ব্যক্তি এর পুনরাবৃত্তি করবে না।
কিন্তু ৪০-৬০ শতাংশ আত্মহত্যাকারী সাধারণত আগেও চেষ্টা করেছে।
ছয়জনের মধ্যে একজন এক বছরের মধ্যে পুনরায় চেষ্টা করে।
যারা আত্মহত্যা করে ফেলে, তারা কোনোভাবেই অন্যকে জানায় না বা কোনো সর্তকসংকেত রাখে না।
প্রকৃতপক্ষে যারা আত্মহত্যা করে, তারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনেকেই সর্তকসংকেত রেখে যায়।
আত্মহত্যার সতর্কসংকেত
যেকোনো সুইসাইড নোট
একবার বা বেশ কয়েকবার আত্মহত্যার চেষ্টা
আত্মহত্যার কথা বলা বা হুমকি দেওয়া
বিষণ্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তি
নানা কাজের মধ্যে আত্মহত্যার কথা প্রকাশ করা (যেমন লেখা, ছবি, গান, কথা ইত্যাদির মাধ্যমে)
ব্যাখ্যাতীত আচরণ (অনেক দিন ধরে ঘুমের ওষুধ জমিয়ে রাখছে, হঠাৎ উইল করে ফেলা, পছন্দের জিনিসপত্র অন্যকে দান করে দেওয়া, প্রিয়জনের কাছ থেকে মাফ চেয়ে নেওয়া ইত্যাদি)
আত্মহত্যার পরিকল্পনা করা ব্যক্তি—
অনেক দিন ধরে ঘুমের ওষুধ জমিয়ে রাখছে,
পছন্দের জিনিসপত্র অন্যকে দান করে দেওয়া,
হঠাৎ সবার কাছ থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা ইত্যাদি
আত্মহত্যাপ্রবণ/ নিজেকে আঘাতকারী ব্যক্তি
অনেকের মধ্যে বারবার আত্মহত্যার চেষ্টা, যেমন হাত কাটা, ঘুমের ওষুধ খাওয়া ইত্যাদি থাকে। অনেক ক্ষেত্রে এসব চেষ্টা অনেক পরিকল্পনামাফিক না করলেও এদের মধ্যে অনেকে (২০০ জনের মধ্যে ১ জন এবং ৪০ জনের মধ্যে ১ জন) এক বছরের মধ্যে আত্মহত্যা করে থাকে। এ ধরনের প্রবণতার উদ্দেশ্য থাকে—
মৃত্যুর উদ্দেশ্যে
বর্তমান সমস্যা থেকে পালানোর উদ্দেশ্যে
প্রিয়জনের আচরণ পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে
অন্যদেরকে নিজের চরম অবস্থান জানানোর উদ্দেশ্যে
প্রিয়জনকে শিক্ষা দেওয়া বা অপরাধ বোধ করানো
পরোক্ষভাবে অন্যের সাহায্য চাওয়া
আত্মহত্যার সতর্কসংকেত থাকলে প্রিয়জনেরা কী করবেন?
উপরোক্ত যেকোনো সতর্কসংকেত পরিবারের কারও মধ্যে দৃশ্যমান হলে দেরি না করে মানসিক রোগবিশেষজ্ঞের/মনোবিদের কাছে পরামর্শের জন্য যান। মনে রাখবেন, মানসিক বিপর্যস্ত অবস্থায় ব্যক্তি আত্মহত্যা করে থাকে, যা সম্পূর্ণ প্রতিরোধযোগ্য।
ব্যক্তির সঙ্গে পরিবার বা কাছের মানুষ সরাসরি কথা বলুন, তার কষ্টের কথা বা কী নিয়ে সে চাপ বোধ করছে, সেটা জানতে চান। তার যেকোনো সমস্যায় আপনি যে তার পাশে আছেন, সেটা জানান।
কোনো অবস্থায়ই তাকে একা রাখবেন না, বরং তার প্রতি সার্বক্ষণিক নজর জরুরি
আত্মহত্যা করতে পারে, এমন উপাদান (ছুরি, কাচি বা যেকোনো ধারালো বস্তু, কীটনাশক, ঘুমের ওষুধ, লম্বা কাপড়, দড়ি, পিস্তল ইত্যাদি) ব্যক্তির কাছ থেকে সরিয়ে ফেলুন।
আত্মহত্যা প্রতিরোধে পরিবারের ভূমিকা
ছোটবেলা থেকেই সন্তানপালনের পদ্ধতি এমনভাবে হওয়া উচিত, যাতে সে যেকোনো মানসিক চাপ ভালোভাবে মোকাবিলা করতে পারে। ব্যক্তির আত্মবিশ্বাস, সামাজিক দক্ষতা, ইতিবাচক চিন্তাপদ্ধতি আত্মহত্যার মতো বিধ্বংসী সিদ্ধান্ত নিতে বাধাগস্ত করে।
সুতরাং মা–বাবার উচিত সন্তানপালনের ক্ষেত্রে
সাফল্যের সঙ্গে সঙ্গে ব্যর্থতা সহজভাবে গ্রহণ করতে শেখানো
কোনো ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত আচরণ বা জেদে প্রশ্রয় না দেওয়া এবং সম্পূর্ণ উপেক্ষা করা। সন্তান যা চায়, তা না দিয়ে সীমারেখা টানা।
সন্তানকে সামাজিকভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলা, যাতে সে জীবনে যেকোনো জটিলতা বা চাপ দক্ষভাবে মোকাবিলা করতে পারে। এ ক্ষেত্রে সামাজিকভাবে মেলামেশা, বেশি বন্ধুবান্ধব রাখা, খেলাধুলা, বা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করা।
শিশু-কিশোরদের অতিরিক্ত মুঠোফোনের ব্যবহার সীমিত করুন
আত্মহত্যার চিন্তা এলে কী করবেন?
জীবনে আবশ্যিকভাবে আমরা সবাই কখনো ভালো, কখনো খারাপ সময়ের মধ্য দিয়ে যাই। তাই মনে রাখুন, বর্তমানের খারাপ সময়ও কোনো অবস্থাতেই চিরস্থায়ী নয়। আত্মহত্যার মতো চিন্তা এলে ‘থামুন’, কয়েক মুহূর্ত ভাবুন, নিজেকে আরেকবার সুযোগ দিন।
আপনার বর্তমান সমস্যা সমাধানে বা আপনার মানসিক কষ্ট কমানোর জন্য সাহায্য নিন মানসিক রোগবিশেষজ্ঞের।
বিশ্বস্ত কারও কাছে মনের কষ্টের কথা বলুন। আবেগের প্রকাশ আপনার মনের ভার লাঘব করবে, দুঃসময়ে অন্যের মনোযোগ আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়াবে, অন্যের আশ্বাস আপনার বিশ্বাস ফিরে পেতে সাহায্য করবে। সর্বোপরি আপনার এই কঠিন দিশাহারা অবস্থায় একধরনের দিকনির্দেশনা পাবেন।
যে নেতিবাচক চিন্তাগুলো আপনাকে আচ্ছন্ন করে আছে, সেগুলো পাশ কাটিয়ে আপনার জীবনের ইতিবাচক বিষয়গুলোর দিকে তাকান (যেমন বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের যারা আপনাকে ভালোবাসে, শারীরিক সুস্থতা ইত্যাদি)। ইতিবাচক চিন্তা আপনার মনে সাহস সঞ্চার করবে।
নিজেকে বারবার আশস্ত করুন যে জীবনের খারাপ সময়টা শুধু একটা সাময়িক অবস্থা এবং কখোনোই ‘শেষ পরিণতি’ নয়। জীবনের কোনো কিছুই যেমন স্থায়ী নয়, তেমনি এই খারাপ সময়টাও অবশ্যম্ভাবীভাবে একসময় শেষ হবে।
যে কষ্ট আপনাকে এই মুহূর্তে আচ্ছন্ন করে রেখেছে, একসময় সেই কষ্টের গুরুত্ব হালকা হয়ে যেতে পারে।
একজন ব্যক্তি একই সঙ্গে একক এবং অনেকের সম্মিলিত রূপ। প্রতিটি আত্মহত্যায় কোনো না কোনোভাবে আক্রান্ত হন তার সঙ্গে যুক্ত আরও অনেকে। প্রত্যেকের জায়গা থেকে আমাদের নিজস্ব চেষ্টার সম্মিলিত রূপ প্রতিরোধ করতে পারে আত্মহত্যার মতো একটি আত্মধ্বংসী ঘটনাকে।
লেখক: মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ, সহযোগী অধ্যাপক (সাইকিয়াট্রি), জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল, ঢাকা।