‘শৃঙ্খল ভাঙার আহ্বান: সবার জন্য প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও নিরাময়’
আজ ২৬ জুন, আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস ২০২৫। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘শৃঙ্খল ভাঙার আহ্বান: সবার জন্য প্রতিরোধ, চিকিৎসা ও নিরাময়’। দিবসটি উপলক্ষে প্রথম আলো ট্রাস্টের উদ্যোগে ২১ জুন প্রথম আলো কার্যালয়ে মুক্ত সংলাপের আয়োজন করা হয়। মুক্ত সংলাপ নিয়ে বিশেষ আয়োজনে আগত অতিথিদের আলোচনা নিয়ে বিশেষ ক্রোড়পত্র।
মো. হাসান মারুফ
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক
সব জেলা ও বিভাগীয় শহরে আমাদের অফিস রয়েছে। কিন্তু আমাদের মোট লোকবল হলো ১ হাজার ৬২২ জন। এই অপ্রতুল লোকবল দিয়ে ভারত ও মিয়ানমারের এত বিশাল সীমান্ত অঞ্চল নজরদারি করি। আমরা নির্ভর করি আমাদের অন্যান্য বাহিনীর ওপর। আমরা চেষ্টা করছি তবে মাদক প্রতিরোধের ক্ষেত্রে পারিবারিক শিক্ষা ও অনুশাসন খুবই জরুরি। সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রথম আলো ও বন্ধুসভা যেমনটা করছে। আমরাও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছি, শিক্ষার্থীদের সচেতন করার চেষ্টা করছি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী শুধু আইন প্রয়োগ করতে পারে; কিন্তু মূল পরিবর্তনটা আসতে হবে পরিবার থেকে।
আশিক সাঈদ
পুলিশ সদর দপ্তরের স্পেশাল ক্রাইম ম্যানেজমেন্টের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ মহাপরিদর্শক
বাংলাদেশ পুলিশের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৮-২৩ সাল পর্যন্ত মাদকের মামলা কমে এসেছে, তবে আপনাদের আলোচনায় বোঝা যায় যে মাদকের বিস্তার ও ভয়াবহতা কমেনি। মাদকসেবী ও মাদক পরিবহনকারীদের বিরুদ্ধেই শুধু মামলা হচ্ছে এবং তাঁদের বিচারের আওতায় আনা হচ্ছে; কিন্তু পৃষ্ঠপোষকেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছেন। এ ক্ষেত্রে আমাদেরও গাফিলতি আছে। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ পুলিশের মধ্য সমন্বয় আরও জোরালো করা গেলে মাদকের ভয়াবহতা নিয়ন্ত্রণে সুফল আসবে।
আফজাল হোসেন
অভিনেতা
আমি বিশ্বাস করি, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আত্মনিয়ন্ত্রণ। মানুষের বোঝা উচিত আমি কে, আমি জগতে কেন এসেছি, আমি নিজের কাছে সম্মানিত কি না। মাদক হোক বা অন্য কিছু হোক, সব ক্ষেত্রেই আত্মনিয়ন্ত্রণ করা জানতে হয়। মানুষের সেই যোগ্যতা থাকতে হয় যে সব সময় ‘না’ বলে নয়, বরং নিজের একটা অস্তিত্ব তৈরি করতে হয়, যে অস্তিত্বকে মানুষ সমীহ করবে। আমাদের দেশে দীর্ঘ সময় সবচেয়ে বেশি অবহেলিত থেকেছে সংস্কৃতিচর্চা। আপনারা খেয়াল করে দেখবেন, আমাদের অধঃপতনের মূল কারণ হলো আমরা সংস্কৃতিচর্চার মধ্যে নেই।
আদিল হোসেন নোবেল
মডেল ও অভিনেতা
২০০৩ সালে যখন মাদকবিরোধী যাত্রা শুরু করেছিলাম, আমাদের তখন প্রচুর অ্যাকটিভিটি হতো। সেই সময়ে আমাদের করা কাজের মধ্যে কোনো ঘাটতি থাকলে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমানের উদ্যোগগুলো আরও সুনিপুণভাবে পালন করতে পারি। আমাদের দেশের রিহ্যাব সেন্টারগুলোয় প্রায়ই দেখা যায় যে আসক্তি থেকে বের হয়ে আসার পরও বারবার আসক্ত হয়ে পড়ে। কাঠামোগত এই সমস্যার দিকে আমাদের নজর দেওয়া উচিত। মাদকাসক্তি থেকে সম্পূর্ণভাবে ফিরে এসে সফলভাবে জীবন যাপন করা ব্যক্তিকে নিয়ে পুনর্বাসনের কাজ করানো যেতে পারলে একটি ভালো পদক্ষেপ হতে পারে।
অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক
বর্তমান সময়ে মাদকবিরোধী কার্যক্রমে আমরা দুইভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নিতে পারি। প্রথমত, নতুনদের সঠিক তথ্য দিয়ে কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে রক্ষা করা। তাঁদের জানানো ও বোঝানো যে মাদকের মধ্যে থাকা নানান রাসায়নিক পদার্থ মগজের কোষের কার্যক্ষমতায় যে ব্যাঘাত ঘটায় তা আমাদের জিন পর্যন্ত চলে যায় এবং আমরা নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি। দ্বিতীয়ত, যাঁরা ইতিমধ্যে আক্রান্ত হয়ে গেছেন, তাঁদের নিরাময়ের জন্য সম্পূর্ণ আলাদা একটি বিভাগ প্রতিষ্ঠা করা। যেখানে মাদকদ্রব্যজনিত মানসিক রোগ এবং মানসিক সমস্যাজনিত মাদকাসক্ত উভয়ের চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকবে। বিশ্বব্যাপী এই সমস্যার সমাধানে আমাদের সবাইকে আত্মসচেতনতার মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে।
ব্রাদার লিও প্যারেরা
অধ্যক্ষ, সেন্ট যোসেফ উচ্চবিদ্যালয়
রাস্তাঘাটে চলাচলের সময়ে মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের একটি বড় অংশ চোখে পড়ে যারা কিনা কোনো প্রতিষ্ঠানের আওতায় পড়ে না। তাদের উদ্দেশ্যে মাদকবিরোধী কার্যক্রমগুলো আরও জোরালোভাবে করা উচিত। পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে যদি শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে একজন করে উপদেষ্টা দেওয়া হয় এবং একটি ডেটাবেজ তৈরি করা যায় যেখানে মাদক থেকে ফিরে আসা ও সুস্থ হওয়া ব্যক্তিদের তথ্য থাকবে, সুস্থ হওয়ার পর কে, কোথায় আছেন বা পরবর্তী সময়ে আবার তাঁদের কোনো সাহায্যের প্রয়োজন হয়েছে কি না, তার রেকর্ড রাখা গেলে আমাদের মাদকাসক্তির পরিস্থিতি বুঝতে সহায়তা করবে।
জোবেরা রহমান লিনু
সাবেক টেবিল টেনিস খেলোয়াড়
আমাদের জীবনে সবচেয়ে বড় জায়গা হচ্ছে পরিবারে। ছোটবেলায় কোনো শিশুর মনোজগতে যদি ভালো ও মন্দের বিষয়টা ঢুকিয়ে দেওয়া যায়, সে কখনো মন্দ পথে পা বাড়াবে না। তা ছাড়া পরিবার থেকে যদি আমরা সঠিক শিক্ষাটা পাই, ভালো–মন্দ বুঝতে শিখি, তাহলে কোনো বস্তু বা কারও দ্বারা সহজেই প্রভাবিত হওয়া থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এর ব্যতিক্রম তো আছেই। অনেক সময় দেখা যায় যে বন্ধুর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে খারাপ পথে পা বাড়ায়। তাই বন্ধু নির্বাচনে সজাগ থাকতে হবে। সর্বোপরি পরিবারের প্যারেন্টিং ভালো হলে সন্তান মাদকাসক্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে।
নিশাত সুলতানা
ডিরেক্টর (ইনফ্লুয়েন্সিং, ক্যাম্পেইন অ্যান্ড কমিউনিকেশন), প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
আমি আমার কিশোর ছেলেকে যখন জিজ্ঞেস করি, কেন কারও মাদকের প্রতি আসক্ত হওয়া ঠিক নয়, সে আমাকে দুটি কারণের কথা বলে। এক. জীবন একটাই এবং এই জীবনে সুস্থ হয়ে বেঁচে থাকাটা খুব জরুরি। দুই. মাদকাসক্ত ব্যক্তিকে সবাই এড়িয়ে চলে, তারা ছোট–বড় অনেক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়। আমার ছেলের এই বার্তা আমি সবার কাছে পৌঁছে দিতে চাই। এর সঙ্গে আমি বলব, মাদকসংক্রান্ত চারটি বিষয়ে জোর দিতে হবে: মাদকের জোগান হ্রাস করা, সচেতনতা বাড়ানো, রোগী হিসেবে আচরণ করা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা। মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের আইনগত, আর্থিক ও চিকিৎসাসেবা দিয়ে সহায়তা করতে পারলে একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ আমরা দাঁড় করাতে পারব।
ডা. মেখলা সরকার
মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ
যেকোনো আসক্তি তখনই হয় যখন ইচ্ছাকৃত একটি ব্যবহার অনুগত ব্যবহারে পরিণত হয় এবং আমাদের মস্তিষ্কে কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে। এসব আসক্তির উৎপত্তির কারণ, শিশুদের কৈশোর বা বয়ঃসন্ধিকালে নানা মানসিক জটিলতা এবং বিভিন্ন ধরনের চাপ। উঠতি বয়সে মানুষের মধ্যে অতিসক্রিয়তা কাজ করে। মা–বাবা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে চেষ্টা করতে হবে, শিশুরা যেন মাদকাসক্তির পাশাপাশি ইন্টারনেট ও গেমিং আসক্তি থেকেও রক্ষা পায়। বিভিন্ন খেলাধুলা এবং সাংস্কৃতিক ও সৃজনশীল কার্যক্রমের মাধ্যমে তাদের সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে। অভিভাবকেরা যদি সঠিক প্যারেন্টিংয়ে সন্তানকে তদারক করেন, তাহলে যেকোনো আসক্তিকে দূরে রাখা সম্ভব ।
নাজমুল পলাশ
সহকারী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিসেবে খুব কাছ থেকে বর্তমান জেন–জি প্রজন্মকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ পাই। বিভিন্ন মফস্সল এলাকা ও প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষে এসে হলে সিটের অভাব, কারিকুলামে অভ্যস্ত হয়ে ওঠার কঠিন পথ, নতুন পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার চাপসহ নানা জটিলতায় তাদের পরীক্ষার ফলাফল খারাপ হয়। ছাত্রদের একটা বড় অংশ মাদক সেবনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় নবীনবরণ অনুষ্ঠানে মাদকদ্রব্য ক্রয়-বিক্রয় ও সেবনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার পরিণতি নিয়ে সতর্ক করা যেতে পারে। একজন করে মনোবিজ্ঞানী এবং প্রতিটি বিভাগে একজন ছাত্র উপদেষ্টা নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে।
ফ্লোরেন্স গোমেজ
অধ্যক্ষ, ওয়াইডব্লিউসিএ উচ্চমাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়
আমাদের সন্তানদের শুধু পড়ালেখার প্রতি চাপ না দিয়ে যদি তাদের প্রতিভাগুলো বের হয়ে আসার মতো সুযোগ করে দিতে পারি, তাহলে তারা নিজেদের গুণাবলি ও দক্ষতার বিকাশ ঘটিয়ে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধির মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণে বিকশিত হতে পারে। প্রত্যেক শিক্ষক যদি আমরা শিক্ষার্থীদের আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পারি, তাহলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে যে সমস্যাগুলো আছে বা চাপ রয়েছে, তা আমরা কমিয়ে আনতে পারব। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই অভিভাবক ও শিক্ষকদের বন্ধুত্বপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে ভালো ও মন্দের মধ্যে তফাত করা শেখাতে হবে।
ড. শাহ আহমেদ
ডিন, স্কুল অব আর্টস অ্যান্ড সোশ্যাল সায়েন্স, উত্তরা ইউনিভার্সিটি
সাম্প্রতিক সময়ে অটো পাসের বিষয়টি ওপর থেকে দেখে বোঝা যায় না যে এর ভয়াবহ একটি প্রভাব সমাজে পড়ছে। অটো পাসে বের হয়ে আসা ছেলেমেয়েরা সঠিক একাডেমিক শিক্ষার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পড়াশোনায় পিছিয়ে পড়ছে। পরীক্ষার খারাপ ফলে হতাশ হয়ে অনেকেই ঝুঁকে পড়ছে মাদকে দিকে। এই প্রজন্মের মাদকগুলোর ধরনও আলাদা এবং প্রচুর সহজলভ্যও বটে, যার ফলে মাদকদ্রব্য হাতে পাওয়া কোনো বড় ব্যাপার নয়। আশা করি, প্রশাসন এই ব্যাপারে আরও নজর দেবে।
ডা. আহমেদ হেলাল
মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ
মাদকাসক্তি একটি সমস্যা, কিন্তু বিজ্ঞানের ভাষায় এটি একটি দীর্ঘস্থায়ী পুনরাবৃত্তিমূলক মস্তিষ্কের রোগ, যার সঠিক চিকিৎসা প্রয়োজন। বর্তমান সময়ে ৯ থেকে ১০ বছরের শিশুদেরও দেখা যাচ্ছে মাদক সেবন করতে। এই মহামারি ঠেকাতে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় মাদক সম্পর্কে বিস্তারিত এবং মা–বাবাদের পারিবারিক শিক্ষার ওপর নজর দিতে হবে, যাতে শিশু-কিশোরেরা হাতের নাগালে মাদক পেলেও তার দিকে ঝুঁকে না পড়ে। সম্প্রতি মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর থেকে চমৎকার একটি জাতীয় নির্দেশনা প্রণয়ন করা হয়েছে। নির্দেশনাটিকে ব্যবহার উপযোগী করা গেলে খুব কাজে দেবে ।
ড. ফারিয়া রাব্বী
সহকারী অধ্যাপক, সিটি ইউনিভার্সিটি
মাদক সেবনের বর্তমান পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে আমাদের শুধু শিক্ষার্থীদের নয়, শিক্ষকদেরও কাউন্সেলিং করতে হচ্ছে। আমার মনে হয়, বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য এত বেশি সুলভ যে স্বল্প আয়ের মানুষেরাও প্রতিদিন মাদক সেবন করতে পারছে। হাসপাতালের একজন ওয়ার্ড বয়, যার মাসিক আয় হয়তো ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা এবং সেও প্রতিদিন মাদক নিচ্ছে। আমরা প্রতিদিনই ধরছি, কাউন্সেলিং করছি। কিন্তু খুব বেশি যে পরিবর্তন হচ্ছে, সেটাও নয়। ছাত্রছাত্রীরা, যাদের আয়ের ব্যবস্থা নেই, তারাও পারছে। মাদকদ্রব্যের এই সহজলভ্যতার দিকে আমাদের একটু নজর দেওয়া উচিত।
আহসান রনি
নির্বাহী পরিচালক, মিশন গ্রিন বাংলাদেশ
আমরা যারা বিভিন্ন সামাজিক কাজের সঙ্গে সংযুক্ত, তাঁরা কোনোভাবেই মাদকের সঙ্গে যুক্ত নই। আমাদের ইতিবাচক গণ্ডি বাড়ানোর দিকে জোর দিতে হবে। আমরা কীভাবে এসব পরিধি আরও বাড়াতে পারি, সে ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করতে হবে। যুবকদের আরও কীভাবে সামাজিক কাজে সম্পৃক্ত করা যায়, সেটা ভেবে দেখতে হবে। মাদকাসক্তি যে খারাপ, এটা যুবসমাজকে বোঝানো গেলে মনে হয় ব্যাপারটা কিছুটা কমানো যাবে। যারা নতুন সরকারে আসবে, তারা যেন মাদকাসক্তির বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেয়, আমি সেই আহ্বান জানাচ্ছি।
ডা. ফারজানা রহমান
সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট
আমি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই মাদকাসক্ত নারীদের দিকে। নারীদের মধ্যে মাদকাসক্তির প্রভাবে স্ট্রোক, ক্যানসার, যৌনবাহিত রোগ, বন্ধ্যত্ব ও সন্তান বিকলাঙ্গ হওয়ার ঝুঁকি ব্যাপক বেড়ে যায়। মাদকাসক্তি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি, মনুষ্যত্ব, ব্যক্তিত্ব, বিচার-বিবেচনা বোধ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের দক্ষতায় ব্যাঘাত ঘটিয়ে আমাদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা এমনকি অন্যকে হত্যার প্রবণতাও বাড়িয়ে দেয়। এই ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একটি দল সর্বক্ষণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
খন্দকার আসাদুজ্জামান জুয়েল
কাউন্সেলর ও উন্নয়ন, আপন নিবাস
বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটি মানুষ মাদকাসক্ত। এটা সবার চিন্তায় নেওয়া উচিত। আমাদের সেন্টারে সাড়ে ছয় বছরের এক শিশু চিকিৎসাধীন আছে। সে সিগারেট ও ড্যান্ডি খেত। সে তার শিশুকালটাই পেল না। প্রথম আলো বহুদিন ধরে মাদকবিরোধী আন্দোলন করে আসছে। এর ফলে অভিভাবকেরা বলতে শিখেছেন যে আমার সন্তান মাদক গ্রহণ করে। আগে কিন্তু তাঁরা গোপন করতেন। এখন বলছেন। ফলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ হচ্ছে। আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিয়মিত কাউন্সেলিং যুক্ত করার পক্ষে বিশেষ জোর জানাচ্ছি।
ডা. সাকিয়া হক
প্রতিষ্ঠাতা, ভ্রমণকন্যা
বড় শহরগুলোর মাদকবিরোধী কার্যক্রম থেকে দৃষ্টি একটু ঢাকার বাইরের জেলা সদরগুলোর দিকে নিয়ে আসতে চাই। এসব এলাকায় ঢাকা শহরের মতো সুবিধা একদম নেই। এমনকি মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের মৌলিক চিকিৎসা হিসেবে যেসব প্রতিষেধক দেওয়া হয়ে থাকে, এসব এলাকায় সেগুলোর অনেক ঘাটতি রয়েছে। হাসপাতালগুলোয় রয়েছে মনোবিজ্ঞানীর অভাব, যার কারণে না পারছি ঠিকমতো শারীরিক চিকিৎসা দিতে, না পারছি মানসিক চিকিৎসা দিতে। এদিকটায় আমাদের কাজ করার অনেক সুযোগ রয়েছে।
দীপ্তি সরকার
উপদেষ্টা, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা
আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছি। এখানে ‘পিস ক্যাফে’ আছে যেখানে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য ও মাদকাসক্তির বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হয়। এখানে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যুক্ত হয়েছে, তারা মানসিক স্বাস্থ্য ও মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করছে। তবে ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার একজন উপদেষ্টা হিসেবে আমি বন্ধুসভা ও প্রথম আলোর মাধ্যমে অনুরোধ করব, একটা প্রতিনিধিদল তৈরি করার জন্য যারা ঢাকার বাইরে প্রতিটি জেলায়, গ্রামে গিয়ে মাদক ও মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা করবে, সচেতনতা তৈরি করবে।
ডা. মানসী সাহা
প্রতিষ্ঠাতা, ভ্রমণকন্যা
সংগঠনে কাজের সুবাদে দেখেছি, সুযোগের অভাব হোক বা প্রতিযোগিতার কারণে হোক নানান কারণে এখনকার তরুণেরা তাঁদের জীবনে বিনোদনের মাধ্যম খোঁজেন। সহজলভ্য হওয়ায় ধূমপান থেকে শুরু করে যেকোনো পর্যায়ের মাদক তাঁরা বেছে নেন মানসিক প্রশান্তির জন্য। তরুণদের নিয়ে আমরা যাঁরা কাজ করি তাঁরা মাদকের চাহিদা কমিয়ে আনতে কাজ করতে পারি। সামাজিক নানা কাজে, বিভিন্ন ক্লাব বা সংগঠনের মাধ্যমে তরুণদের যদি আমরা যুক্ত করতে পারি তাহলে কৃত্তিম বিনোদনের জন্য তাঁরা মাদকে আসক্ত হবেনা। মাদকাসক্তদের প্রতি ‘সোশ্যাল স্টিগমা’ দূর করে সহযোগিতা করতে হবে।
ফারহানা ইসলাম
এক্সটারনাল কমিউনিকেশন অ্যাসোসিয়েট, কাশফুল ফাউন্ডেশন
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাঁরা মাদকাসক্ত, তাঁদের সমাজ থেকে আলাদা করে না দেখে যদি প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে নিয়োজিত কাউন্সেলর দ্বারা কাউন্সেলিং দেওয়া যায়, তাহলে তাঁদের একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে ওঠার সুযোগ থাকে। বর্তমান সময়ের পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ডোপ টেস্ট অনিবার্য, কিন্তু সেই টেস্টে পজিটিভ আসা শিক্ষার্থীদের আমাদের তত্ত্বাবধানে রাখা উচিত। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্যাম্পাসে যদি ধূমপান নিষিদ্ধ করা যায়, তাহলে ভালো কিছু হতে পারে।
মাহমুদা মহসিনা
সভাপতি, ঢাকা মহানগর বন্ধুসভা
অভিবাবক হিসেবে আমি আমার নিজের আচরণের দায়িত্ব নেব, তারপর সন্তানকে বলব। আমি আমার নিজের রোল মডেল যেন নিজে হই। আমি যদি স্থির করি, আমি নিজে মাদক নেব না, মুঠোফোন বা ডিভাইস ব্যবহার করব না। এটা করা গেলে সন্তানকে ‘না’ বলা সহজ হবে। সন্তানও আপনার কাছ থেকে শিখবে। যখন সন্তান দেখে যে শুধু তাকেই ‘না’ বলা হচ্ছে, কিন্তু মা–বাবা ঠিকই মুঠোফোন বেশি ব্যবহার করছেন, তখন সন্তানও কথা শোনে না। সুতরাং পরিবর্তনটা পরিবারের ভেতর থেকেই আসতে হবে। আগে নিজেকে ‘না’ বলতে হবে।
রেহানা আক্তার
শিক্ষক, সাউথ ব্রিজ স্কুল, উত্তরা শাখা
পরিবারের পরে একজন শিক্ষকই একটা বাচ্চাকে সরাসরি দেখার সুযোগ পায়। সেই হিসেবে একটি শিশুর জীবনে নানাভাবে ভূমিকা রাখার সুযোগ আমাদের থাকে। শিক্ষক হিসেবে প্রতিনিয়ত শিশুদের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হয়। ফলে পর্যবেক্ষণ করার অনেক সুযোগ আছে। শিক্ষার্থীদের মাদক ও বিভিন্ন আসক্তি সম্পর্কে সচেতন করার কাজটি আমরা শিক্ষকেরা করতে পারি। কোনো শিক্ষার্থীকে দেখে যদি মনে হয় যে সে মাদকের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ছে, তাহলে তার অভিভাবককে জানানো উচিত। মাদকে জড়িয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে। সম্মিলিত প্রচেষ্টা নিয়ে এগোতে হবে। পরিবারের মানুষজনকে সচেতন হতে হবে।
মুনির আহমদ খান
ইউনিট্রেন্ড লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও ক্রিয়েটিভ চিফ
মাদক একটা জাতীয় সমস্যা। আমাদের এ ক্ষেত্রে আইন রয়েছে, কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। মূল হোতাকে না ধরলে কখনোই মাদক নির্মূল করা সম্ভব হবে না। প্রতি দুটি পরিবারে যদি একজন করেও মাদকাসক্ত থাকে, তাহলে এটা ক্যানসারের চেয়েও ভয়াবহ সমস্যা। এটাকে এখনই একটা জাতীয় সমস্যা বলে ঘোষণা করা উচিত। আমার মনে হয়, প্রথম আলোর সঙ্গে শুধু এই রুমের মধ্যে না অন্যান্য গণমাধ্যমের সাহায্যে এ বিষয়ে সরকারকে সচেতন করা দরকার, যাতে সরকার এটাকে প্রধান সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করে দেশ ও জাতির কল্যাণে কঠোর আইন প্রণয়ন করে। সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তিকে একটা দায়বদ্ধতার মধ্যে আনা দরকার।
আনিসুল হক
ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, প্রথম আলো
২৬ জুন আন্তর্জাতিক মাদকবিরোধী দিবস উপলক্ষে প্রথম আলো ট্রাস্ট মুক্ত সংলাপের আয়োজন করেছে। ১৯৯৮ সালে প্রথম আলো শুরু হওয়ার পর থেকেই সংবাদ প্রকাশের পাশাপাশি সামাজিক নানা কার্যক্রম শুরু করলাম আমরা। সমাজের কিছু চিন্তাশীল মানুষ আমাদের বলতে শুরু করলেন, ‘ছেলেমেয়েরা মাদকাসক্ত হয়ে যাচ্ছে, এর বিরুদ্ধে আপনারা কিছু করেন।’ প্রথমবারের মতো ২০০৩ সালের মে মাসে আমরা প্রথম আলো মাদকবিরোধী আন্দোলন শুরু করি। সে সময় যাঁরা আমাদের পাশে ছিলেন, তাঁরা আজও বটবৃক্ষের মতো আমাদের পাশে আছেন। সবার সহযোগিতায় আমরা নিয়মিত মাদকবিরোধী নানা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আজকের মুক্ত সংলাপ তারই অংশ।
আরও মতামত তুলে ধরেন :
হিমু পরিবহনের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবীব, প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আহমদুল হাসান, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী মাহিয়ান ইসলাম, আশরাফুল হোসেন ও সুমাইয়া খন্দকার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রোভার স্কাউট গ্রুপের আব্দুল মুমিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইয়াজ কবির, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালস থেকে সাকিব আল হাসান, কিশোর আলোর স্বেচ্ছাসেবক রেজওয়ানা পুষ্প, নর্দান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. মঈন প্রমুখ। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগর বন্ধুসভার সাংগঠনিক সম্পাদক অনিক সরকার, হিমু পরিবহনের তাহজিব আহমেদ ও ইয়াকুবুল হাসান রুপম, শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির শিক্ষার্থী ইফরাত হোসেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রিফাত আল জাবেদ, সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব, সাউথ-ইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী মো. মিরাজ আলম, গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহরাব হোসেন জিসান, কিশোর আলোর স্বেচ্ছাসেবক আসহাবিল ইয়ামিন, তাসফিয়া হক, রেহানা আসপিয়া, ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী আজিম শেখ, ঈমান ইফতেখার, মো. জামিরুল ইসলাম ও শফিউল আলম তানিম, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব গ্লাস অ্যান্ড সিরামিকসের শিক্ষার্থী মাসফিয়া ইসলাম মীম, সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী জান্নাতুল তাসনিম এবং ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী মো. তাহজীব ।
সুপারিশগুলো:
মাদকাসক্ত ব্যক্তিদের অপরাধী হিসেবে না দেখে রোগী হিসেবে দেখে তাঁদের যথাযথ চিকিৎসা ও যাবতীয় সহায়তা দেওয়া।
মাদককে জাতীয় সমস্যা চিহ্নিত করে কাঠোর আইন প্রণয়ন করা এবং মাদক নিয়ন্ত্রণের জন্য আলাদা ইউনিট গঠন করা উচিত।
মাদকের ব্যবহার বন্ধ করতে শুধু মাদক ব্যবহারকারীদের বিচারের আওতায় না এনে পৃষ্ঠপোষক ও মূল হোতাদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
অভিভাবক ও শিক্ষকদের আত্মসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে এবং ছোটদের প্রতি সহানুভূতিশীল থেকে তাদের সঠিক পথে চলার দিকনির্দেশনা দিতে হবে।
শিশু–কিশোর থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছাত্রছাত্রীদের সঠিক তথ্য দিয়ে সচেতন করতে হবে, কাউন্সেলিং করতে হবে এবং তত্ত্বাবধানে রাখতে হবে।
নৈতিক মূল্যবোধ,সৃজনশীল ও সামাজিক কাজকর্ম এবং পাঠ্যক্রমবহির্ভূত নানা ধরনের কার্যক্রমের মাধ্যমে তরুণদের ব্যক্তিত্ব বিকশিত করে তাঁদের মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে হবে।
বিভাগীয় শহরের পাশাপাশি জেলা শহরগুলোয়ও মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
নির্বাচনী ইশতেহারে মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে।