ভালোবাসার কারণেই স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছি

মাদকের ভয়াল থাবা থেকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসা মাহমুদুর রহমান সজীব।

নেশার চোরাস্রোতে তলিয়ে যেতে থাকা মাহমুদুর রহমান সজীবকে টেনে তুলেছেন তাঁর মা শাহীনুর সুলতানা। প্রায় ১২ বছর মাদকের সংস্পর্শে ছিলেন সজীব। পরিবার, শিক্ষক, ডাক্তার ও প্রথম আলো মাদকবিরোধী পরামর্শ সভার সহায়তায় বর্তমানে তিনি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন। প্রথম আলো ট্রাস্টকে দেওয়া ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে মাদক থেকে মুক্ত হওয়ার গল্প বলেছেন সজীব।

কীভাবে আসক্তি শুরু হলো?

স্কুল ও কলেজজীবনে আমার তেমন একটা স্বাধীনতা ছিল না। যখন বুয়েটে নেভাল আর্কিটেকচার অ্যান্ড মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তি হলাম, তখন একটা স্বাধীনতা পেলাম। আমার বাসা মিরপুরে। একদিন মিরপুরের একটি পরিচিত মাদক স্পটে গেলাম। ওখানে দেখলাম অনেক লোক গাঁজা খাচ্ছে। ‘গাঁজা খেলে অন্য জগতে যাওয়া যায়’—এমন কথা শুনলাম। কৌতূহল থেকেই গাঁজা নিলাম। তারপর একটা ‘ভালো লাগা’ কাজ করতে থাকল। ধীরে ধীরে আসক্ত হয়ে পড়লাম। বুয়েটে পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি করতাম। টিউশনির টাকাতেই নেশার টাকা জোগাড় হতো।

 বুঝতে পারতেন যে আপনি আসক্ত?

গাঁজা না খেলে খারাপ লাগত। নেশার মধ্যে গাঁজাটা বেশ সহজলভ্য। তাই নিয়মিত গাঁজা নেওয়াটা সহজ ছিল। কিন্তু বুঝতে পরছিলাম না আমি আসক্ত হয়ে পড়েছি।

পরিবার কখন বুঝতে পারে আপনি আসক্ত?

বাসার কারও কথা শুনতাম না, রাত করে বাড়ি ফিরতাম, কখনো ফিরতাম না, খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো করতাম না—এসব লক্ষণ দেখেই পরিবার বুঝতে পেরেছিল আমি মাদকাসক্ত।

কে উদ্যোগ নিলেন চিকিৎসার?

আমাদের বাসায় প্রথম আলো পেপার রাখা হতো। ২০০৫ কিংবা ২০০৬ সালের শুরুর দিকে ঘটনা। আমার মা প্রথম আলো পেপারে মাদকবিরোধী পরামর্শ সভার বিজ্ঞাপন দেখে পরামর্শ সভায় যান। ওখানে ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল ও ডাক্তারদের কথা শুনে মা বুঝতে পেরেছিলেন, আমাকে সময় দিলে, ডাক্তারদের পরামর্শ শুনলে আমাকে সুস্থ করা যাবে। মা অনেক কষ্ট করেছেন। লেগে ছিলেন। ‘আপন নিবাস’–এ পনেরো মাস চিকিৎসা করিয়েছেন। আমার সুস্থ হতে প্রায় ১২ বছর সময় লেগেছে। আমি এখনো ওষুধ খাচ্ছি।

স্বাভাবিক জীবনে ফেরার চিন্তা এল কী করে?

ভালোবাসার কারণেই আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছি। তখন আমি পুরোপুরি আসক্ত। একদিন বুয়েটে আমাদের ডিপার্টমেন্টে গেছি। তখন আমাদের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন ড. রফিকুল ইসলাম স্যার। তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে ভালোবেসে বললেন, ‘কথা দাও কখনো আর মাদক নেবে না।’ এই যে তাঁর মতো একজন বড় মাপের মানুষ আমাকে ভালোবেসে মাদকের পথ থেকে ফেরার কথা বললেন, এটা আমার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছে।

পড়াশোনা শেষ করে কী করলেন?

আমার পড়াশোনা শেষ হয়েছে ২০১৬ সালে।  প্রথমে আমি একটা শিপ ডিজাইনিং ফার্মে যোগ দিই।এখন আমি ওয়ালটনে চাকরি করছি। ওয়ালটনের মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে যুক্ত আছি।

যাঁরা আসক্ত, তাঁদের উদ্দেশে কিছু বলতে চান? তাঁদের পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশে কিছু বলতে চান?

সংসার কিংবা পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধটা অনুভব করতে পারলে মাদকের পথ থেকে ফিরে আসা সম্ভব। রাগারাগি করে কাউকে মাদকের পথ থেকে ফেরানো সম্ভব নয়। এ প্রসঙ্গে আমার নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া একটি ঘটনা বলছি, এক পর্যায়ে আমি গাঁজা নেওয়া বন্ধ করেছিলাম কিন্তু পরিবারের কেউ কিছুতেই বিশ্বাস করছিলেন না। একদিন এ নিয়ে বাসায় মা রাগারাগি করেন। এর ফলে গাঁজা ছেড়ে দেওয়ার পরও অভিমান থেকে আবার গাঁজা নেওয়া শুরু করি। তাই রাগ না করে  মাদকাসক্তের প্রতি পরিবারের সদস্যদের সহনশীল হতে হবে। ভালোবাসা দিয়েই মাদকের পথ থেকে যে কাউকে ফেরানো সম্ভব।