শিশুর মানসিক বিকাশ ও পারিবারিক অশান্তি : মাদকের প্রভাব
প্রথম আলো ট্রাস্টের একটি নিয়মিত আয়োজন মাদকবিরোধী পরামর্শ সভা। গত ২০ মার্চ ২০২৩, প্রথম আলো ট্রাস্ট আয়োজিত অনলাইন (১৬৩ তম) মাদকবিরোধী পরামর্শ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার আলোচক কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের মনোবিদ ডা. রাহেনুল ইসলাম ‘শিশুর মানসিক বিকাশ ও পারিবারিক অশান্তি : মাদকের প্রভাব’ এই বিষয়ের উপর আলোচনা করেন।
ডা. রাহেনুল ইসলাম শিশুর সজ্ঞা প্রসঙ্গে বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী ১৮ বছর নিচে যারা অবস্থান করছেন তাদেরকে আমরা শিশু বলে থাকি। এই ১৮ বছরের নিচে যারা অবস্থান করছেন তারা কিন্তু সব সময় একই ধরণের আচরণ করে না। একটি শিশু ১০ বছর বয়সে একরকম আচরণ করবে, ১২ বছর যখন পার হচ্ছে তখন আর একরকম আচরণ করবে আবার যখন ১৫ বছর অর্থাৎ বয়োঃসন্ধিতে অবস্থান করছে তখন কিন্তু আর এক ধরনের আচরন করবে। যে শিশুটি ছোটবেলা থেকে গান শিখছে তার মস্তিষ্কের বিশেষ অংশটি বিকশিত হচ্ছে। অন্যদিকে যে শিশুটি গান শিখছে না তার কিন্তু মস্তিষ্কের বিশেষ অংশটি বিকশিত হবে না।
শিশু–কিশোরদের আসক্তি প্রসঙ্গে রহেনুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে সময়ে শিশু–কিশোররা ইয়াবা–গাঁজাসহ বিভিন্ন ধরণের মাদকে আসক্ত হচ্ছে। এর ফলে পরিবার, সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষ উৎকন্ঠিত। কিন্তু শিশু–কিশোররা কিন্তু একই সময়ে মোবাইলেও আসক্ত হয়ে পড়ছে এতে কিন্তু আমরা তেমন বেশি উৎকন্ঠিত নই। কিন্তু বিজ্ঞানসম্মতভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় মাদক ও প্রযুক্তি আসক্তি শিশু–কিশোরদের প্রায় একই ধরণের ক্ষতি করে।
সন্তান লালন–পালন প্রসঙ্গে ডা. রাহেনুল ইসলাম বলেন, বাবা–মায়ের কাছে সন্তান লালন পালন আগে সহজ ছিল; কেননা আমরা একসময় যৌথ পরিবারে বসবাস করতাম। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় পরিবারগুলো ছোট হয়েছে ফলে সন্তান লালন–পালন বর্তমানে একটা চ্যালেঞ্জিং ব্যপার। জীবন–জীবিকার প্রয়োজনে বাবা–মা দুইজনকেই কর্মক্ষেত্রে সময় দিতে হচ্ছে। কাজের প্রয়োজনে ডিজিটাল ডিভাইসের ব্যবহার বেড়েছে বহুগুন। শিশুরা বলতে গেলে ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর থেকেই প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে। শিশু যখন কাঁদছে তখন বাবা–মা তার হাতে মোবাইল তুলে দিচ্ছে। এর ফলে শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধিবৃত্তিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। শিশুরা কিন্তু বাবা–মাকে অনুকরণ করে। বাবা–মা যেভাবে রাগ করে, হতাশা প্রকাশ করে কিংবা মিথ্যা বলে শিশুও কিন্তু তাই করবে। একটি বিষয় আমাদের মনে রাখতে হবে সুখি বাবা–মা মানেই হচ্ছে সুস্থ শিশু। বাবা–মা যদি দাম্পত্য জীবনে দ্বন্দে জড়ান কিংবা শারীরিক বা মানসিক ভাবে অসুস্থ থাকেন তাহলে তা শিশুর স্বাভাবিক বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে। একটি শিশু সব থেকে বেশি সময় থাকেন পরিবারের সঙ্গে। পরিবারিক সংস্কৃতির দ্বারা শিশু সব থেকে বেশি প্রভাবিত হন। শিশু লালন পালনে বাবা–মাকে শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হবে, প্রযুক্তি ব্যাবহারে সংযত হতে হবে। পরিবারে ইতিবাচক সংস্কৃতির চর্চা করতে হবে। শিশু কিংবা সব বয়সি মানুষের ক্ষেত্রে ঘুম থেকে উঠার একটি নির্দিষ্ট সময় থাকতে হবে। শিশুদের কিন্তু বার বার খিদে পায়। তাই শিশুর সময় অনুযায়ী খাবার দিতে হবে। পুর্ণবয়স্ক মানুষের ক্ষেত্রেও খাবার সময় নির্দিষ্ট থাকতে হবে। নিজেকে সময় দিতে হবে। প্রতিদিনের রুটিন কাজের বাইরে নিজেকে ১৫ থেকে ২০ মিনিট সময় দিতে হবে। অতিথি আপ্যায়নের যে সংস্কৃতি আমাদের সমাজে ছিল সেটি কিন্তু করোনার পর থেকে প্রায় লুপ্ত হয়েছে। শিশুর সমাজিকীকরণের ক্ষেত্রে আত্নিয়–স্বজনের বাসায় যাওয়া, নিজের বাসায় আমন্ত্রন জানানোর চর্চা বাড়াতে হবে।
শিশু–কিশোরদের মাদক ও প্রযুক্তি আসক্তির লক্ষণ প্রসঙ্গে রাহেনুল ইসলাম বলেন যদি আমরা দেখি সন্তানের বন্ধু হঠাৎ করে পরিবর্তন হচ্ছে, রাত জাগছে, সকালে উঠতে পারছে না, পোশাক–পরিচ্ছেদ পরিচ্ছন্ন থাকছে না, মিথ্যা বলছে, পরিবারের দামি জিনিসপত্র হারিয়ে যাচ্ছে, বাথরুমে বেশি সময় কাটাচ্ছে, খিটখিটে মেজাজের হয়ে যাচ্ছে– এ ধরণের লক্ষণ দেখা দিলে সন্তানের সঙ্গে একান্তে কথা বলুন। সন্তানকে সরাসরি তার সমস্যার বিষয়ে অবহিত করুন। আলাপ আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান না হলে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সাহায্য নিন।