মাদকাসক্তি এমন একটি মানসিক রোগ বা ব্যাধি, যা ‘অন্ধের হাতি দেখার মতো’ অবস্থায় আমাদের দাঁড় করায়। কেউ কেউ বলেন, মাদকাসক্তি শুধু সামাজিক, নৈতিক, পারিবারিক, অর্থনৈতিক কিংবা রাজনৈতিক সমস্যা। অথচ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং DSM-5 অনুযায়ী এটি এমন একটি পুনঃপতনশীল চিকিৎসাযোগ্য মানসিক রোগ, যেখানে মস্তিষ্কের দৃশ্যমান গাঠনিক পরিবর্তন হয় এবং এর কারণ একাধারে বংশগত, মনস্তাত্ত্বিক ও সামাজিক।
পরিবারের কোনো সদস্য যখন এই রোগে আক্রান্ত হয়, তখন তার প্রকাশ এতই ধীরে হয় যে সহজে কারও চোখে ধরা পড়ে না। মাদকাসক্তির শুরুর দিকের সূক্ষ্ম লক্ষণ এবং মানসিক রোগ হিসেবে অস্বীকার করার নেতিবাচক সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গির কারণে গুরুতর পর্যায়ে যাওয়ার আগে আমরা টের পাই না। মন যেহেতু জানে না বা মানে না, তাই সবকিছু চোখের সামনে দৃশ্যমান থাকলেও রোগীর পাশাপাশি পরিবারের অন্য সদস্যরাও কিছু বোঝেন না। তাই বাস্তবতা অস্বীকার করে বেশির ভাগ সময় পরিবার বলে, ‘না, এটা অসম্ভব। আমার পরিবারের কেউ কোনো দিন মাদকাসক্ত হতেই পারে না।’ সবকিছু ‘খারাপ’ বন্ধুদের দোষ। যে খারাপ বন্ধুদের আমরা দায়ী করি, তাদের মা–বাবাও আবার উল্টোভাবে একই কথা বলেন।
যা–ই হোক, প্রাথমিক অবিশ্বাস শেষে চিকিৎসা হিসেবে সবার আগে আসে তিনটি ‘ব’। বিয়ে, বিদেশ কিংবা ব্যবসা। অর্থাৎ অভিভাবকেরা বিশ্বাস করেন, ‘বয়সের দোষ, বয়স বাড়লে, বিয়ে দিলে, সন্তানের বাবা/মা হলে নাটক-সিনেমার মতো সব ঠিক হয়ে যাবে।’ সামর্থ্য অনুসারে অনেকেকই দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। কেউ ব্যবসার পুঁজি দেন, চাকরি জোগাড় করে দেন। এরপর যখন বিয়ে ভাঙে, বিদেশ থেকে ফেরত আনতে হয়, ব্যবসায় লালবাতি জ্বলে, চাকরি হারায় কিংবা রোগীর হাতে শারীরিক আক্রমণের শিকার হন, তখন অভিভাবকেরা আমাদের মতো মনোরোগবিশেষজ্ঞদের কাছে রোগীকে নিয়ে আসেন। মাদকাসক্তির কারণে রোগীর বলা কথা, যেমন ‘আমার কোনো সমস্যা নেই, শুধু ওটা করলে আমি মাদক ছেড়ে দেব’, ‘আমি না চাইলে পৃথিবীর কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট আমাকে ভালো করতে পারবে না’, ‘আমি চাইলে যেকোনো সময় মাদক ছেড়ে দিতে পারি, চাইছি না, তাই ছাড়ছি না’, ‘ওই যে তিন সপ্তাহ কোনো মাদক নিইনি’, ‘আমাকে জোর করে ভর্তি করলে আমি আত্মহত্যা করব’ ইত্যাদির ফাঁদে পড়ে যান। নিজেদের অসহায়ত্ব বর্ণনা শেষে প্রায় সবাই আমাদের পরামর্শ ও উপদেশও দেন। ‘কীভাবে চিকিৎসা করতে হবে’, ‘ওকে এক–তিন বা দশ মাস আপনার কাছে রাখেন’, ‘আপনি তো জানেন না ও কী রকম’, ‘আপনি ওকে একটু বলে দেবেন ও যেন এটা করে-ওটা করে’ ইত্যাদি।
চিকিৎসার জন্য প্রথমবার ভর্তি শেষে মাদকাসক্ত ব্যক্তি বাড়ি ফেরার পর রোগের ধর্ম অনুসারে ‘রিল্যাপস’ করে, অর্থাৎ পুনরায় মাদক নেওয়া শুরু করে, তখন পরিবার একেবারে ভেঙে পড়েন। শুরু হয় দোষারোপের দুষ্ট চক্র।
বাস্তবতা হলো মাদকাসক্তি ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপের মতোই নিয়ন্ত্রণযোগ্য একটি রোগ, যার চিকিৎসা আক্ষরিক অর্থেই দীর্ঘমেয়াদি। জীবনে প্রথমবার মাদক নেওয়া থেকে শুরু করে মাদকাসক্ত রোগীতে পৌঁছাতে যেমন দীর্ঘ সময় লাগে, তেমনি সামগ্রিক সুস্থতা অর্জন করতেও প্রয়োজন দীর্ঘ ‘সময়’। এর কোনো নাটকীয় ‘নিরাময়’ বা ‘কিউর’ নেই, ‘চিকিৎসা’ আছে। মাদকাসক্তদের চিকিৎসার সামগ্রিক উদ্যোগ না নিয়ে কেমন বাংলাদেশ আশা করি আমরা? কী, কীভাবে, কখন, কাদের মাধ্যমে চিকিৎসা করব, চিকিৎসার বৈজ্ঞানিক মান নির্ধারণে জাতীয়ভাবে সপ্তাহব্যাপী বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ, রোগী, অভিভাবকদের নিয়ে একসঙ্গে বসে পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে না পারলে আমাদের ভবিষ্যৎ ব্ল্যাকহোলের মতোই অন্ধকার।
লেখক: রেসিডেন্ট সাইকিয়াট্রিস্ট, কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র, ঢাকা।