আত্মহত্যা প্রতিরোধে আশা জাগিয়ে রাখতে হবে ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তির মনে

আত্মহত্যাপ্রবণ কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ বন্ধু বা স্বজনের পাশে কার্যকরভাবে দাঁড়াতে হবে―এটাই আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবসের প্রধান আহ্বান। আর এ জন্য আন্তর্জাতিক আত্মহত্যা প্রতিরোধ সংস্থা ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যৌথভাবে ২০২১ থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত বিশ্ব আত্মহত্যা প্রতিরোধ দিবস উপলক্ষে ত্রিবার্ষিক প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করেছে—‘Creating hope through actions: জীবন সম্বন্ধে তাদের আশা জাগিয়ে রাখতে হবে’। প্রতিপাদ্যের সফল প্রয়োগের জন্য নানা উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। তাদের  সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সুযোগ ঠেকাতে হবে। নিজেকে গুটিয়ে রাখার সুযোগ দেওয়া যাবে না। ক্রাইসিস কাটিয়ে ওঠা পর্যন্ত কেউ না কেউ সঙ্গে থাকতে হবে। পড়াশোনা, কর্মক্ষেত্র কিংবা সামাজিক অনুষ্ঠান থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়া রোধ করতে হবে, একাকী থাকার সুযোগ দেওয়া যাবে না। সহমর্মী হয়ে তাদের কথা শুনতে হবে। সমস্যাটা শনাক্ত করতে হবে এবং তা সমাধানে সহযোগিতা করতে হবে। মনে রাখা দরকার, আত্মহত্যা কোনো রোগ নয়, উপসর্গ। আত্মহত্যার আইডিয়া, পরিকল্পনা কিংবা অ্যাটেমপ্ট গ্রহণ করার মতো চূড়ান্ত পর্যায়ে চলে যেতে পারে পরিকল্পনা গ্রহণকারী আত্মহত্যাপ্রবণ ব্যক্তি। এই প্রক্রিয়ায় কোনো না কোনোভাবে সে ইঙ্গিত দিয়ে থাকে অথবা সুইসাইড নোট লিখে রাখে। 

এ ধরনের আলামত পেলে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। সর্বোচ্চ চিকিৎসার জন্য মনোরোগ-বিশেষজ্ঞদের কাছে যেতে হবে। মনে রাখা দরকার, আত্মহত্যা প্রতিরোধযোগ্য একটি উপসর্গ, রোগ নয়। এর আড়ালের রোগ এবং সমস্যা শনাক্ত করার জন্য অবশ্যই মনোরোগ চিকিৎসাসেবায় সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে। জরুরি হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে যেমন মানুষ মারা যায়, আত্মহত্যার চিন্তাভাবনা, পরিকল্পনা তার চেয়েও বেশি জরুরি। আত্মহত্যাকারীদের এক মন মরতে চাইলেও অন্য মন বাঁচতে চায়। এ জন্য উপযুক্ত সময় তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। আত্মহত্যার আগেই কাজটি করা সবার মানবিক দায়িত্ব। আত্মহত্যার পর মায়াকান্না করে লাভ নেই।

অনেকে মনে করেন সুইসাইডের বিষয়ে কথা বললে তাদের মাথায় আত্মহননের চিন্তা উসকে দেওয়া হয়, কিন্তু গবেষণায় তা প্রমাণিত হয়নি। বরং নন-জাজমেন্টাল ভাবে তাদের কথা শোনার মাধ্যমে মর্মযাতনা কমিয়ে দেওয়া যায়, কখনোই তা উসকে উঠে না ভুক্তভোগীর মনে।

সাম্প্রতিক কালের কয়েকটি আত্মহত্যা ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায় মুঠোফোন কিনে না দেওয়ায় আত্মহত্যা করছেন তরুণ-তরুণী। ভালোবাসার পরিণয়ে ব্যর্থ হয়ে এক রশিতে প্রেমিকযুগল আত্মহত্যা করেছেন, জিপিএ-৫ না পেয়ে কিশোর-কিশোরীরা আত্মহত্যা করছে। বেশ কয়েক বছর আগে আমরা দেখেছি, তিন সন্তানকে হত্যার পর আত্মহত্যা করেছেন মা। অপবাদ সইতে না পেরেও আত্মহত্যার মতো ঘটনা ঘটছে। পরকীয়া বিষয়ে জানার পর স্ত্রীকে খুন করে স্বামী আত্মহত্যা করেছেন, স্ত্রীকে হত্যার পর কবরের পাশে স্বামীও আত্মহত্যা করেছেন, অমতে বিয়ে দেওয়ার কারণে ধর্ষণের শিকার হয়ে কিংবা ইভটিজিংয়ের কারণেও অনেকে আত্মহত্যা করছে, বাল্যবিয়ে ঠেকাতে না পেরে অনেকে জীবন দিয়ে ফেলেছে―এ ধরনের অসংখ্য কারণ সমাজে ঘটছে, পত্রিকার পাতায় তা প্রকাশিত হচ্ছে। তাৎক্ষণিক আমাদের বুকে কাঁপন ধরে যায়, আবার ভুলে যাই, সেসব ঘটনার পেছনের মর্মন্তুদ কাহিনি, সয়ে যায় সব। স্বজনদের মনে থেকে যায় দগদগে ঘা। তারা বেঁচে থেকেও মরে থাকেন, আমৃত্যু যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে একসময় নিজেও চলে যান পরপারে। কিন্তু স্বজনদের তো বটেই, বিশ্বের প্রত্যেক নাগরিককে মনে রাখতে হবে, কেউ আত্মহত্যার কথা বললে, আত্মহত্যা করব বলে থ্রেট করলে বা ভয় দেখালে, তা কোনোভাবেই অবজ্ঞা করা উচিত নয়, অবহেলার চোখে বিবেচনা করা চলবে না; বরং নিজের বিচার-বিবেচনাবোধ আড়ালে রেখে তার কথা ও মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে, প্রাণ উজাড় করে তাকে সব কথা বলার পরিবেশ করে দিতে হবে। আত্মহত্যার বিষয়ে তার কগনিশন বা খুঁটিনাটি  চিন্তা ও আবেগের বিষয় বলার জন্য উদ্বুদ্ধ করতে হবে। তার আবেগ বুঝতে হবে। আরও মনে রাখতে হবে, আত্মহত্যার পেছনের মানসিক রোগটা শনাক্ত করে সর্বোচ্চ চিকিৎসা গ্রহণ করার উদ্যোগ নিতে হবে।

সবার পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষমতা সমান নয়। কেউ অল্পতে ভেঙে পড়ে আবার কেউ সহজে ভেঙে পড়ে না। যারা ভেঙে পড়ে না, তারা কঠিন যন্ত্রণা পেয়েও আত্মহত্যার দিকে এগোয় না। কিন্তু যারা ভেঙে পড়ে, তাদের পরিস্থিতি মোকাবিলা করার ক্ষমতা কম। এ জন্য ‘কপিং ক্যাপাবিলিটি’ বাড়ানোর জন্য অবশ্যই তাদের মনোরোগ চিকিৎসাসেবা গ্রহণ করতে হবে। 

প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন আত্মবিশ্বাসী, আত্মপ্রত্যয়ী, আত্মমর্যাদাশীল শিশু মনস্তত্ত্ব গড়ে তোলা। এ জন্য পারিবারিক পরিবেশে শিশু লালন-পালনের দিকে নজর দিতে হবে। শিশুকে আত্মবিশ্বাসী করে তোলার জন্য মা-বাবাকে পর্যাপ্ত ধারণা লাভ করতে হবে এবং সেই ধারণার সফল ব্যবহার করতে হবে। শিশুকে আত্মবিশ্বাসী করে গড়ে তোলা গেলে পরবর্তী জীবনে কঠিন ঘটনার মুখোমুখি হলে তারা ভেঙে পড়ে না, মাথা উঁচিয়ে চলতে পারে, সমস্যা  জয় করতে পারে।

পরীক্ষায় খারাপ করা, ভালোবাসার ব্যর্থতা ও জটিলতা, বৈবাহিক অশান্তি, অবৈধ গর্ভধারণ, শ্বশুরবাড়ির পরিবেশ, সম্পর্কের টানাপোড়েন, নৈতিক অবক্ষয়, পরকীয়া, আত্মসামাজিক হতাশা, অর্থনৈতিক দুরবস্থা, বেকারত্ব, যোগ্যতা অনুযায়ী কাজ না পাওয়া, বৈষম্যের শিকার হওয়া, ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়া  মানুষের মনে হতাশা তৈরি করে। এসব তথ্য বিশ্লেষণ করে বলা যায়, ছেলে-বুড়ো, নারী-পুরুষ, শিক্ষিত-অশিক্ষিত কেউ আত্মহত্যাপ্রবণতার ঝুঁকির বাইরে নয়। কিন্তু সেই অনুযায়ী নেই প্রতিরোধ। আত্মহত্যার ঝুঁকি মোকাবিলায় সচেতনতার বিকল্প নেই। এর অভাবে ঝরে পড়ছে মূল্যবান জীবন। তবে মনে রাখা দরকার, আমাদের দেশের নারীদের আত্মহত্যার হার বেশি। কিন্তু উন্নত দেশে পুরুষের হার বেশি। 

বিষাদ রোগ, মাদকাসক্তি এবং প্রবল আবেগপ্রবণ ব্যক্তিদের মধ্যে ১৩ শতাংশের আত্মহত্যার প্রবণতা থাকে। যথাযথ মানসিক স্বাস্থ্যসেবার মাধ্যমে এ ধরনের মানবিক বিপর্যয় রোধ করা সম্ভব। 

বায়ো-সাইকোসোশ্যাল ঝুঁকিপূর্ণ কারণ বিশেষত মানসিক রোগ, যেমন মুড ডিজঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়া, উদ্বেগ রোগ এবং কিছু ব্যক্তিত্বের সমস্যা, অ্যালকোহলিজম, মাদকাসক্তি, নৈরাশ্য, ইমপান্সিভ অ্যাগ্রেসিভ আচরণ, মানসিক জখমের মতো ঘটনা, পরিবারে আত্মহত্যার  ইতিহাস, বড় ধরনের শারীরিক রোগ―এসবকে গুরুত্ব দিয়ে সর্বোচ্চ মানসিক স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে হবে। 

আত্মহত্যা প্রতিরোধে বিষয়টি জরুরি

সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে আত্মহত্যা প্রতিরোধের ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে হবে। কথাসাহিত্যিকেরাও তাঁদের গল্প-উপন্যাসে আত্মহত্যাবিরোধী আখ্যান উপহার দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করে তুলতে পারেন। কবিতার ছন্দে হতাশাগ্রস্ত তরুণ প্রজন্ম যেন উজ্জীবিত হতে পারে তার জন্য কবিদের প্রতিও আহ্বান জানাই। 

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও মনোশিক্ষাবিদ,

সাবেক পরিচালক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট।