সন্তান বড় হওয়ার আগ পর্যন্ত তাকে পরিবার থেকে মাদকের কুফল সম্পর্কে কিভাবে জানানো যায়?
ডা. মোহাম্মদ জোবায়ের মিয়া: আসলে পরিবার থেকেই তো আমাদের শিক্ষা নিতে হবে। আমাদের লার্নিং প্রসেসটা তো পরিবার থেকেই শুরু হয়। আমাদের পারিবারিক মর্যাদাবোধ, সামাজিক বিধিনিষেধ বা আচার আচরণ এবং সেই সঙ্গে আমাদের ভালোমন্দ বিষয়গুলো আমরা পরিবার থেকেই শিখি। খারাপ বিষয়গুলো প্রতিরোধ করার ব্যাপারটা পরিবার থেকেই আসতে হবে। আসলে পরিবারে আমাদের শিশুরা যখন স্কুলে পড়ে অর্থাৎ প্রথম শ্রেণি থেকে পঞ্চম শ্রেণি একদম শিশুকাল। আর এই সমটাতেই তারা সবচেয়ে বেশি শিখে। এই শিখার বয়সটাতেই তাদের মাদকের কুফল সম্পর্কে সম্যক ধারণা দিতে হবে। যাতে তারা বুঝতে পারে এটা তাদের স্বাভাবিক জীবকে নষ্ট করে দেবে। এই সময়টা বাবা-মায়ের কাছে তারা শিশু। কিন্তু তারপর যখন সে আরেকটু উচ্চতর ক্লাসে উঠে মানে ক্লাস সিক্স থেকে ক্লাস টেন তখন বাবা-মায়ের তাদের একটু বেশি সময় দিতে হবে। তাদের সঙ্গে মিশতে হবে।
সন্তানের বেড়ে ওঠার সময়টাতে তাদের প্রতি বাবা-মায়ের দায়িত্ব কেমন হওয়া উচিত?
মাহমুদা মুহসিনা বুশরা: অনেক সময় মনে করি তারা তো একটু বড় হয়ে গেছে। আবার সন্তানও এই সময়টা নিজেদের একটু গুটিয়ে নেয়। তাদের একটা আলাদা জগৎ হয়। তাদের ব্যক্তিত্বের গঠন শুরু হয়। নিজেদের তারা পরিপূর্ণ মানুষ ভাবা মানে ব্যক্তি ভাবা শুরু করে। সেই ক্ষেত্রে তাদের ব্যক্তিত্বের গঠনের সঙ্গে তারাও কিছুটা স্পেস চায় নিজেদের জন্য। কিন্তু ওই সময়টাই আমরা মনে করি ভালনারেবল। তাদের আচার আচরণ, দৈনন্দিন চলাফেরা এবং তাদের রুটিন ওয়ার্ক গুলি তারা ঠিকমতো করছে কিনা এই বিষয়গুলির দিকে খেয়াল রাখলে আমরা বুঝতে পারব যে আমার সন্তানটি লেখাপড়ার সঙ্গে তার যে চিত্ত বিনোদনের যে বিষয়গুলি সেগুলি ঠিকমতো করছে কিনা কিংবা কোথাও বিচ্যুতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিনা। সে স্কুল থেকে সময়মতো ফিরছে কিনা বা তার আচরণে কোন পরিবর্তন আসছে কিনা তার হবি চেঞ্জ হয়ে যাচ্ছে কিনা যে সন্তান টি বই পড়ত অবসরে সে হঠাৎ করে তার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে কি না। এই বিষয়গুলি যখনই সামনে আসবে তাদের সময় নিয়ে আমাদের বোঝাতে হবে। তাদের মতামতকে গুরুত্ব দিতে হবে। তাহলে সে ও বাবা-মায়ের মতামতকে গুরুত্ব দেবে। এভাবেই তাকে যে কোনো আসক্তি সম্পর্কে জানানো যাবে। আমরা যদি খেয়াল করি তাহলে বুঝব যে সন্তানের কোন বিচ্যুতি ঘটছে কিনা বা তারা মাদকের ভয়াবহতা থেকে তারা মুক্ত কি না। পুরোটা সময় একটা অবজারভেশনের মধ্যে তাদের রাখতে হবে। তাদের খেয়াল রাখতে হবে এবং দেখভাল করতে হবে। অর্থাৎ পুরোটা সময়ই আসলে সচেতন থাকতে হবে।
কখন থেকে সন্তানকে পারিবারিক মূল্যবোধের শিক্ষা দেওয়া শুরু করা উচিত?
ডা. মোহাম্মদ জোবায়ের মিয়া: ফ্যামিলি ডাইনামিক্সটা আমাদের খুবই দরকার। শেখার আসলে কোনো শেষ নেই। আমরা যদি সন্তানদের ছেড়ে দিই বা পর্যাপ্ত সময় না দেই তাহলে সে আসলে অনেক কিছুই শিখবে না। যেমন, আমরা যখন এক সাথে বসে খাবার খাব তখন তাদের টেবিল ম্যানারটাও শেখানো উচিত। আমাদের সঙ্গে তাদের আচরণ এমন হওয়া দরকার যেন তারা খুব সহজেই আমাদেরকে তাদের মনের কথা শেয়ার করতে পারে। এই বিষয়গুলোর চর্চা আসলে ছোট বেলা থেকেই হতে হবে। জাজমেন্টাল না হয়ে সময় নিয়ে তাদের কথা শুনতে হবে। তাহলে এই প্র্যাকটিসটা যখন শুরু হয়ে যাবে সে তার গোপনীয় যে বিষয়গুলি বা কষ্টের বিষয়গুলি সে শেয়ার করবে। তাদের কথায় গুরুত্ব না দিলে সে আস্তে আস্তে পরিবার থেকে দূরে সরে যাবে। তার মধ্যে যদি এই ভাবনাটা সে যে, তার মা সবকিছু হয়তো তার বন্ধুর মাকে বলে দেবে। তাহলে সে কখনোই তার মনের কথা খুলে বলবে না। এ ক্ষেত্রে বাবা-মাকেই সন্তানের আস্থা অর্জন করে নিতে হবে। তার মতামতের দাম দিতে হবে। তাকে অন্যদের সঙ্গে তুলনা করা যাবে না।
বয়ঃসন্ধিকালে সন্তানের সঙ্গে কেমন আচরণ করা উচিত?
মাহমুদা মুহসিনা বুশরা: একটা সময় যে বাচ্চাটা আমার সঙ্গে খুব কথা বলত কিংবা খুব সহজেই মিশতো ১৩-১৪ বছর বয়সে সে হঠাৎ করে গুটিয়ে যাচ্ছে। তখন হয়তো ওর একা থাকতে ভালো লাগছে। অনেক সময় দরজা বন্ধ করে নিজের মতো থাকছে। তখন সেটাকে খারাপ কিছু ভাবা যাবে না। আমাদের বুঝতে হবে যে, একসময় আমরাও এমনই ছিলাম। এই সময়টা আমাদেরও পার করতে হয়েছে। আমরা আসলে যখন বাবা মায়ের জায়গাটায় দাঁড়িয়ে যাই তখন আমরা ভুলে যাই যে আমরাও একসময় টিনএজ ছিলাম বা এই রাস্তাটা ধরে আমরাও পার হয়ে এসেছি। আমারও এ রকম লেগেছিল যে কেউ কেন আমাকে এখন কোশ্চেন করে। ছেলে হোক আর মেয়ে হোক এই যে আঁচল ধরে রাখার যে একটা টেন্ডেন্সি থাকে বাচ্চাদের বয়ঃসন্ধিকালের সময় আঁচলটা ছেড়ে দেয়। যখন ছেড়ে দেয় তখন কিন্তু বাবা-মায়েরা ভীষণ ইনসিকিউর হয়ে যায়। তারা চান আঁচলটা বাচ্চাটা ধরে রাখুক। ওনার ভয় থেকে উনি কিন্তু বাচ্চাটাকে তখন শুধু আঁকড়ে ধরতে চান তুমি দরজা বন্ধ করলা কেন? বা তুমি এতক্ষণ কি করতেছো? তুমি চুপচাপ থাকো কেন? তুমি কেন এদিকে আসো না? কেন এসে খাও না? এই রকম নানান ধরনের প্রশ্ন তাদের করতে থাকে। এই সব না করে সন্তানদের আস্থার জায়গাটা তৈরি করতে হবে। তাদের বলতে হবে আমি তোমার সঙ্গে আছি। তোমার প্রয়োজন হলে আমাকে বলবে। আমি তোমার হেল্পের জন্য সারাক্ষণ আছি।
সন্তানের সঙ্গে বাবা-মায়ের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের গুরুত্ব কতটুকু?
ডা.মোহাম্মদ জোবায়ের মিয়া: আমাদের প্যারেন্টসদের আমি বলব যে আমাদের অতিরিক্ত অনুসন্ধিৎসু মনোভাব থেকে বের হয়ে আসতে হবে। সন্তানদের পেছনে গোয়েন্দাগিরি করতে গিয়ে আমরা আসলে তাদের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করে ফেলি। ছেলে-মেয়েরা তখন মনে করে তাকে সিসি ক্যামেরার মধ্যে রেখেছে। কেউ সারাক্ষণ তার ওপর নজর রাখছে। যেটা তার স্বাভাবিক চলাফেরার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। সেটা না করে তাদের আমরা স্পষ্ট করে জানাব তার কাছে আসলে আমরা কি চাই। যেমন সন্ধ্যা সান্ধ্যকালীন আইন যেটা আমরা ভোগ করে এসেছি সেটা তার ক্ষেত্রেও কার্যকর হবে কি না? তাকে বোঝাতে হবে সন্ধ্যার পরে বাইরে গেলে কি হতে পারে। এর কুফল আসলে কি সেটা তাকে খোলামেলা ভাবে জানাতে হবে। ধূমপান এবং মাদকের কুফল সম্পর্কে তাকে জানাতে হবে। যাতে তারা সচেতন হতে পারে। আপনি আপনার সন্তানকে কতটা ভালোবাসেন সেটা তাকে জানাতে হবে। পরিবারে তার মূল্য দিতে হবে। মোট কথা তাদের সঙ্গে যোগাযোগটা বাড়াতে হবে। যাতে তাদের সঙ্গে আপনার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরি হয়।
মাদকাসক্ত সন্তানের বেড়ে ওঠার সময় ওপর বাবা-মায়ের প্রভাব কেমন?
মাহমুদা মুহসিনা বুশরা: বাবা মা একজন সন্তানের জন্য বেস্ট টিচার এবং বেস্ট ডক্টর। তারা যদি মাদকমুক্ত সন্তানদের সহযোগিতা করেন এবং বলেন নরমাল লাইফে লিড কর তাহলে তো সাইকিয়াট্রিস্ট সাইকোলজিস্ট কাউকেই প্রয়োজন হয় না। মাদকাসক্ত হয়ে গেলে অনেক সময় কিন্তু সন্তানরা সেটা বলে না। অনেক সময় সন্তানরা কিন্তু এটা অস্বীকার করে। ধীরে ধীরে তারা আরও বেশি মাদকাসক্ত হয়ে যায়। তারা মনে করে এটা যদি কোন গার্জিয়ান শুনে যায় যে ছেলে মাদকে আসক্ত তাহলে কিরিঅ্যাক্ট করবে? আমাকে খারাপ ভাববে বা আমার অনেক কিছু হয়ে যাবে। আমার অনেক শাস্তিমূলক ব্যবস্থা আসতে পারে। সেই ক্ষেত্রে তারা কিন্তু ডিনাই করে। সেই সব ক্ষেত্রে বলতে হবে যে তোমার তো স্বাস্থ্যটা খারাপ। আগের থেকে তুমি খাচ্ছ না। তোমাকে মলিন লাগছে। শুধু তোমার শারীরিক চেকআপের জন্য একটু ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। যদি মাদকের বিষয় হয় তাহলে সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে আগে যাবে।
যখন মনে হবে আপনার সন্তান মাদকাসক্ত কি না সেটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য কি কি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার?
ডা.মোহাম্মদ জোবায়ের মিয়া: এই রকম পরিস্থিতিতে বাবা-মায়ের কৌশলী হতে হবে। যেমন, আমরা বলতে যে তোমার স্বাস্থ্য দিন দিন খারাপ হচ্ছে বা তুমি ঠিকমতোঘুমাচ্ছ না। চল তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। তার যে রুটিন পরীক্ষার সঙ্গে একটু ডাক্তারকে যদি বলা হয় যে আমার সন্দেহ হচ্ছে যে নেশা করে কিনা তখন ডাক্তার একটা রুটিন ইউরিন এক্সামিনেশন দিয়ে মাদকের ডোপ টেস্টটা করতে পারে। যদি সাত দিনের মধ্যে সে মাদক নিয়ে থাকে তাহলে কিন্তু পজিটিভ আসবে এবং এই এভিডেন্সটা দিয়ে কিন্তু তখন ছেলেকে বা মেয়েকে বলা যায় যে তুমি হয়তো স্বীকারকরোনি কিন্তু তোমার ব্লাডে এটা এসেছে। তোমাকে আমরা অপরাধী ভাবছি না যে এটার জন্য এটা কি করা যায়। তখন কিন্তু সে আত্মসমর্পণ করবে। তখন তাকে বুঝিয়ে ট্রিটমেন্ট আওতায় আনতে হবে। তখন তাকে বিশেষজ্ঞদের কাছে নিয়ে যেতে হবে। যাতে তার সঠিক চিকিৎসা হয়। এটা একটা দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। তাই ধৈর্য সহকারে এর চিকিৎসা করতে হবে।
মাদকাসক্ত সন্তানের চিকিৎসার ক্ষেত্রে অভিভাবকের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত?
মাহমুদা মুহসিনা বুশরা: অনেক সময় দেখা যায় আমরা আসলে বিশেষজ্ঞদের কাছে যেতে চাই না। এবং বিশেষজ্ঞরা কোন পরামর্শ দিলে সেটাও আমরা কনটিনিউ করতে চাই না। দুই দিন পরে যখন আমরা একটু ভালো ফিল করি তখন মনে হয় যে আমাদের আমার বোধ হয় রোগটা সেরেই গেল। এটা হচ্ছে আমাদের সব মিলিয়ে কম বেশি। এটাই আমাদের বাস্তবতা। সেই জায়গাটাতে যখন চিকিৎসা চলতে থাকবে তখন খেয়াল রাখতে হবে চিকিৎসাটা যাতে মাঝপথে থেমে না যায়। অভিভাবক হিসেবে যেন সাহস না হারিয়ে ফেলি। প্রথমত অভিভাবকদের এর চিকিৎসা সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। ভালো করে এর প্রক্রিয়া গুলো বুঝতে হবে। মনে রাখা প্রয়োজন এটা অনেক সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সাইকোলজিক্যাল ট্রিটমেন্ট একটা লম্বা জার্নি এবং মাদকাসক্তদের জন্য যে ট্রিটমেন্ট এটাও একটা লম্বা জার্নি। প্রফেশনাল কারও কাছে যেয়েজানব যে জায়গাগুলোতে আমার কোশ্চেন থাকে। কোনটার পরে কোনটা আসবে কিভাবে তখন আমি সাপোর্ট দিব এবং তার পরবর্তী ধাপটা হচ্ছে আমার মধ্যে কিছু সাইকোলজিক্যাল এডুকেশন নিতে হবে। কিভাবেকি করলে সন্তানের জন্য ভালো হবে সেটা অবশ্যই বাবা-মাকে জানতে হবে। ঘরে এবং বাইরে তার সঙ্গে আমাদের আচরণ কেমন হবে সেটাও জানা দরকার। এমন কিছু বলা যাবে না যাতে তারা নিজেদের ছোট ভাবে বা অপরাধী মনে করে। তাহলে খুব সহজেই তাদের পরিপূর্ণ সুস্থ করা সম্ভব।
সন্তান মাদকমুক্ত হয়ে ফিরে আসার পর তাদের সঙ্গে বাবা-মায়ের আচরণ কেমন হওয়া উচিত?
ডা.মোহাম্মদ জোবায়ের মিয়া: আসলে সন্তান যখন ফিরে আসে তখন সে ভালো হয়েই ফিরে আসে। তার সঙ্গে স্বাভাবিক আচরণ করতে হবে। তার সাইকোলজিক্যাল ব্যাপারগুলো আমাদের বুঝতে হবে। সে যাতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন না ভাবে। ধৈর্য ধরতে হবে। এই লম্বা পথে তাকে সাহস দিতে হবে। সব সময় সচেতন থাকতে হবে। বাবা-মায়ের কোনো কথা বা আচরণে সে যাতে আঘাত না পায় সে ব্যাপারে সচেতন থাকতে হবে। একটা বড় বিষয় হচ্ছে কি আমরা কেউ কাউকে মাফ করতে পারি না। অভিভাবকের মাফ করার মানসিকটা থাকতে হবে। উনারা মাফ করছেন কি করছেন না এটা কিন্তু একটা চর্চার বিষয়। আবার আমি অভিভাবক হিসেবে যখন দেখছি আমার সন্তান কোনো ভুল করে ফেলছে তখন কিন্তু আমিও সে জায়গাতে অসহায়ত্ববোধ করি। তখন যদি এর মধ্যে অপরাধবোধটা আসে তো আমাকেও মাফ করতে শিখতে হবে। মাফ তো আরেকটু কঠিন ব্যাপার হয়ে গেল। আমরা তো সরি বলাই শিখিনি। এই প্র্যাকটিসটাও করতে হবে। বাচ্চারাও তাহলে সরি বলা শিখবে এবং তারা বুঝবে যে এটা ভুল এবং পরবর্তীতে সে সচেতন হবে।