মাদকের থাবা থেকে ফিরে আসার গল্প

স্কুলে বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আড্ডা দিতে দিতে মানস (ছদ্মনাম) নেশা করতে শুরু করে। সেই সময়ে হাতের কাছে নেশা করার জন্য যা যা পাওয়া গেছে, সবকিছু দিয়ে নেশা করেছে মানস। প্রকট আকার ধারণ করে যখন ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক নেওয়া শুরু করেন। মাদকের টাকা জোগাড় করতে মানস বাসার জিনিসপত্র চুরি করতেন। শুধু জানতেন, নেশা করার জন্য টাকা জোগাড় করতে হবে। তা যেভাবেই হোক না কেন। একপর্যায়ে ছিনতাই রাহাজানিও করেছেন। ইনজেকশনের মাধ্যমে মাদক নেওয়ার প্রভাবটা আস্তে আস্তে সকলের চোখে পড়তে শুরু করে। কোথাও আড্ডা হোক বা কাজ হোক যেখানেই যেতেন মানস, ঝিমাতেন। বাসায় মায়ের সঙ্গে, বোনের সঙ্গে খারাপ আচরণ করতেন। একপর্যায়ে সবাই বুঝে গেল যে মানস মাদকে আসক্ত হয়ে পড়েছে। আত্মীয়দের বাসায় গেলে অনেকেই হয়তো তার মুখের সামনেই বলত ঘরের জিনিসপত্র সামলে রাখতে। কিন্তু তাতে কিছুই এসে যেতো না তার। তবে একটা সময় বুঝতে লাগলেন যে, এই নেশা তাকে আস্তে আস্তে মৃত্যুর মুখে ঠেলে নিয়ে যাবে। তার আর মুক্তি নেই।

মানস, মানসের পরিবার যখন হতাশ, চোখে মুখে অন্ধকার দেখছে। ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ একদিন মানসের মায়ের চোখে পড়ল প্রথম আলোর ছুটির দিনে পত্রিকায় এক বিজ্ঞাপন। মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা সভার বিজ্ঞাপন। ছেলের সুস্থ জীবনের আশা ছেড়ে দেওয়া মায়ের মনে হলো একবার তার সেই সভায় যাওয়া উচিত। যদি ছেলেকে সুস্থ করার কোনো পথ পাওয়া যায়। মানসের মা সেদিন গেলেন ধানমন্ডির ডব্লিউভিএ মিলনায়তনের প্রথম আলো ট্রাস্টের ‘মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা সভায়’। এই পরামর্শ সভায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকগণ মাদকের ক্ষতিকারক দিক নিয়ে আলোচনা করেন। আগত সকলকে বোঝান যে, মাদকাসক্তি এক ধরনের রোগ। সঠিক চিকিৎসায় যা সম্পূর্ণভাবে সেরে যায়। শুধু একটু ধৈর্য রাখতে হয়, মনে সাহস রাখতে হয়, মাদকাসক্তকে ভালোবাসতে হয়, তার পাশে থাকতে হয়। মায়ের মন একটু একটু করে যেন ওই সভা থেকে সাহস পেলেন। স্বপ্ন দেখলেন তাঁর ছেলে আবার সুস্থ হয়ে যাবে। ওই সভায় ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজালের সঙ্গে পরিচিত হন। মানসের সম্পর্কে কথা বলেন। ব্রাদার রোনাল্ড ড্রাহোজাল মানসকে জিজ্ঞেস করলেন, সে আসলেই সুস্থ হতে চান কিনা। ততদিনে মনের জোর হারিয়ে ফেলা মানস সত্যি সত্যি সুস্থ হতে চায়, স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে চায়, বাঁচতে চায়। সে জানাল, সুস্থ হতে চায়। ব্রাদার রোনাল্ড তাঁকে কথা দেন, তিনি এবং এই সভায় উপস্থিত সকলেই তাঁর ছেলের পাশে আছেন এবং চিকিৎসায় সহায়তা করবেন।

শুরু হয় মানসের চিকিৎসা। চিকিৎসার পুরোটা সময় মা ধৈর্য ধরেছেন ছেলে সুস্থ হয়ে ওঠার। ছায়া হয়ে থেকেছেন ছেলের পাশে। মায়ের আশীর্বাদ, বিশেষজ্ঞদের চেষ্টা বিফলে যায়নি। মানস সুস্থ হয়ে ফিরে আসে। মানস যখন সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতে শুরু করল, সবাই অবাক হতো। সবাই দেখল মাদকাসক্ত হয়েও চিকিৎসা নিয়ে সমাজের মূল স্রোতে ফিরে আসা যায়। সুস্থ সমাজের একজন হয়ে বেঁচে থাকা যায়। জীবন যাপন করা যায়। আশপাশের সবাই যারা একসময় মানসের বাবা-মা, বোনকে খুঁচিয়ে কথা বলত, তারাই তাঁদের বলতে শুরু করল তোমাদের ছেলেতো সুস্থ হয়ে গেছে।

ছেলে সুস্থ হয়ে যাওয়ার পরও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মানসের মা মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা সভায় আসতেন। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ শুনতেন। যদি তার ছেলের মতো অন্য কাউকে পরামর্শ দিয়ে, সুস্থ হওয়ার পথ দেখিয়ে সুস্থ করতে পারেন। মানস এখন একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন। নিজের পরিবার নিয়ে ভালো আছেন। মানস বলেন,'একজন মাদকাসক্ত থেকে সুস্থ হয়ে সমাজে ফিরে আসা, এটি আমার জন্য খুব বড় একটা বিষয়। হয়তো এটা সবার কাছে খুব স্বাভাবিক বিষয়। এই চিকিৎসার পুরো সময়টা কত কঠিন ছিল, কীভাবে সুস্থ হয়েছি, আমি জানি। আমার পরিবার জানে।'

মাদকাসক্তি এক ধরনের মানসিক রোগ এবং এটি সম্পূর্ণ নিরাময়যোগ্য একটি রোগ। একজন মাদকাসক্তকে ভালোবেসে, যত্ন নিয়ে, ধৈর্য ধরে চিকিৎসা করালে সে নিশ্চয়ই সুস্থ হয়ে যাবে। ২০০৯ মাসের ২৩ মে প্রথম আলো ট্রাস্টের কার্যক্রম শুরু হলে মাদকবিরোধী আন্দোলনের কার্যক্রম ট্রাস্টের অধীনে চলে আসে। প্রথম আলো ট্রাস্ট মাদকবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে নিয়মিতভাবে মাদকবিরোধী সংগীতানুষ্ঠান, মাদকবিরোধী মানববন্ধন, প্রতি মাসে মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা সভা, গোলটেবিল বৈঠক, শোভাযাত্রা, মাদকবিরোধী বন্ধুমেলা, কনসার্টসহ বিভিন্ন কর্মতৎপরতা চালিয়ে থাকে। প্রথম আলো মাদকবিরোধী আন্দোলনের স্লোগান ‘মাদককে না বলো, মাদকাসক্তি একটি ব্যাধি’। অনুষ্ঠানের পাশাপাশি মাদকসংক্রান্ত প্রতিবেদন, ক্রোড়পত্র, বিজ্ঞাপন, সম্পাদকীয় ও চিঠিপত্র প্রকাশ করা হয়ে থাকে। সারা দেশে স্টিকার, পোস্টার, লিফলেট বিলি করা হয়, যা মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করে। মাদকের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার অংশ হিসেবে ২০০৩ সাল থেকে গত ১৮ বছরে প্রায় প্রতি মাসেই পরামর্শ সহায়তা সভা আয়োজিত হয়েছে, এ ছাড়া মাদকবিরোধী কনসার্ট হয়েছে ১৭টি। একই সঙ্গে সচেতনতা সৃষ্টিতে প্রতিবছর মাদকবিরোধী স্টিকার ডিজাইন প্রতিযোগিতা আয়োজন করা হয়।