মাদকবিরোধী অনলাইন পরামর্শ সহায়তা সভা
বাবা মায়ের সম্পর্ক এমন থাকবে যেন সন্তান তার মনের কথা তাদের খুলে বলে
কৌতূহল থেকে মাদক গ্রহণ শুরু হয়, হতাশা কাটাতে নেশা কখনোই না । এই প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘সম্প্রতি তার কাছে একজন রোগী এসেছিলেন। তার সম্পর্ক ভেঙে যায়, মানসিক চাপ ছিল আর মানসিক চাপ থেকে মাদক গ্রহণ করতে থাকে। মাদক গ্রহণের ফলে অনেক নতুন বন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হয়। সাময়িকভাবে হতাশা কাটাতে, পড়াশোনার জন্য রাত জাগার জন্য অনেকেই মাদক গ্রহণ করেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলছি, আপাতদৃষ্টিতে মাদক সাময়িকভাবে হতাশা কমালেও মূল সমস্যা কিন্তু থেকে যায়। সমস্যা সমাধানের জন্য মাদক নয় বরং আসক্তি নতুন সমস্যা যোগ দেয়। মানসিক চাপ, হতাশা, ঘুম হয় না, ভীষণ কষ্টের মধ্যে থাকেন। কখনো মাদকের নেবেন না বরং চিকিৎসকদের সঙ্গে কথা বলুন। মাদকের মতো ভয়ংকর জিনিস গ্রহণ করা কখনই উচিত নয়। মন খারাপ হলে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া। এনজাইটি থাকলে পরামর্শ নিতে চিকিৎসকের কাছে যাবেন।’
গত ৩০ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার বিকেল চারটা থেকে আধা ঘণ্টা প্রথম আলোর ফেসবুক পেজে মাদকবিরোধী অনলাইন পরামর্শ সহায়তা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা সঞ্চালনা করেন প্রথম আলো ট্রাস্টের সমন্বয়ক মাহবুবা সুলতানা। অনলাইনে মাদকবিরোধী পরামর্শ সহায়তা সভার এটি ছিল ২৮ তম আয়োজন।
মাদকের পথে হাঁটা শুরু করে মানুষ সুস্থ অবস্থায় মনে করেন ফিরে আসা উচিত। এ অবস্থায় কি করবে? এর উত্তরে ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘মাদক গ্রহণ ও আসক্তি পার্থক্যটা বুঝতে হবে। মাদক গ্রহণ না করলে প্রত্যাহার জনিত নানা রকম অসুস্থতা বোধ করে। মাদক ছাড়ার প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে নিজের কাছে মাদক গ্রহণ স্বীকার করা। অনেকেই স্বীকার করতে চান না, ইচ্ছে করলেই মাদক ছেড়ে দিতে পারি বলেন। রাসায়নিক প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকে । মাদককে আমরা অপরাধ হিসেবে দেখি। তাই মাদক গ্রহণ করতে অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হয়। মাদকাসক্তি মস্তিষ্কের একটা রোগ। এরও চিকিৎসা রয়েছে। মাদকাসক্তিকে রোগ হিসেবে দেখতে হবে। এমনি এমনি ঠিক হয়ে যাবে এই ধারণাও ভুল।’
প্রথমত নিজের কাছে স্বীকার করতে হবে। যত সময় যাবে খারাপ তত বেশি হবে। তারপরে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। যত দ্রুত সম্ভব মাদকের চিকিৎসা শুরু করতে হবে। অনেকেই মনে করেন মাদকের চিকিৎসা ব্যয় বহুল। তাদের উদ্দেশ্যে জানালেন, সরকারিভাবে মাদকের চিকিৎসা ব্যয় কম। জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট মাত্র ১০ টাকার টিকিটের বিনিময়ে চিকিৎসা সেবা শুরু করা যায়। তেমনিভাবে ঢাকার তেজগাঁও কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্র অথবা দেশের বিভিন্ন মেডিকেল কলেজগুলোতে বিভাগে সরকারিভাবে কম খরচে চিকিৎসা সেবা পেতে পারেন। জানালেন ডা. মেখলা সরকার।
একজন প্রশ্ন করেন অভিভাবকেরা মানতে চান না তার সন্তান মাদকাসক্ত হয়েছে। একজন অভিভাবক কীভাবে এর সঙ্গে মানিয়ে নেবেন। উত্তরে ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘মাদককে অপরাধ হিসেবে আমরা দেখি, তা- না করে রোগ হিসেবে দেখতে হবে। পরিবারের সদস্যদের তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে । রোগী হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। ব্রেনে কেমিক্যাল পরিবর্তনের কারণ ছেলে বা মেয়ে দানবের মতো আচরণ করছে। মানসিক শক্তি রাখতে হবে অভিভাবকদের। চিকিৎসা পদ্ধতি হবে একটা টিমওয়ার্কের মত। একটি টিমে মনোরোগ চিকিৎসক থাকবেন। পরিবারের সদস্যরা থাকবেন মাদকের চিকিৎসা করবেন। পরিবারের সদস্য ছাড়া মাদকের চিকিৎসা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।’
আরেকজনের প্রশ্ন ছিল, চিকিৎসা পদ্ধতি সাধারণত কত দিনে শেষ হয়?
এ ক্ষেত্রে ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘খসড়াভাবে বলতে পারি একজন রোগী দুই বছর মাদক থেকে দূরে থাকলে ধরে নিতে পারি তিনি মাদক মুক্ত আছেন। মাদকাসক্ত হলে এটা কিন্তু সারা জীবনের রোগ। লক্ষ্য রাখতে হবে, নিজের প্রতি সতর্ক থাকতে হবে। যারা মাদক গ্রহণ করেন যেকোনো সময় আবার তারা মাদক নিতে পারেন। মাদক কি পরিমাণ নিচ্ছেন? মাদকের ইতিহাস জেনে নিতে হয়, ব্যক্তিত্বের ইতিহাস, পরিবারের ইতিহাস ও মাদক গ্রহণের ইতিহাস জেনে নেওয়ার পরে আসলে এর চিকিৎসা শুরু হয়। আর পরিবারের সাপোর্ট থাকলে তার সাফল্য দ্রুত পাওয়া যাবে। অবস্থাভেদে হাসপাতালে এক, দুই, তিন মাস কারও কারও ক্ষেত্রে ছয় মাস পর্যন্ত লাগে। মাদকাসক্তদের নিয়মিত ফলোআপ করতে হয়। চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যক্তি নিজে গ্রহণ করে যদি নিজের গ্রহণ করে এবং রোগী স্বল্পমেয়াদি মাদক গ্রহণ করে তার রোগীর মোটিভেটেড হন, মাদক গ্রহণ করেন না।’
চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে আমাদের দেশে একবারেই মাদক বন্ধ করে দিই। পরিবারে নজরদারিতে রোগীকে রাখতে হয়। এ ক্ষেত্রে প্রত্যাহার জনিত সমস্যা হতে পারে। মাদক গ্রহণ না করলে নাক দিয়ে পানি পড়ে, ডায়রিয়া হয়, গা ব্যথা করে। দীর্ঘদিন মাদক গ্রহণ করলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি রেখে চিকিৎসা করাতে হয়। শরীর থেকে মাদক চলে যায়। এক মাস, দুই মাস হাসপাতালে ভর্তি রাখতে হয়। হাসপাতালে রোগী দ্রুত সুস্থ হয়। টাকা, বন্ধুবান্ধব, সঙ্গী যেন সহজেই জোগাড় করতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
মন খারাপ হতেই পারে। জীবনে চড়াই-উতরাই থাকবে। নেশার দিকে যাওয়া যাবে না। কী কী চর্চার মধ্যে থাকলে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে?
এর উত্তরে ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘তরুণ বয়সে বন্ধুদের একটা চাপ থাকে। কৌতূহল, বন্ধুদের চাপ, আত্ম-অনুসন্ধান কিশোর বয়সে বেশি দেখা যায়। আর কিশোর বা তরুণ বয়সীরা মাদকে আসক্ত বেশি হন। বাবা মায়ের পরে বন্ধুদের সঙ্গে মিশে। এখন বন্ধুদের গ্রুপে কেউ যদি মাদকাসক্ত থাকে তাহলে মাদককে না বলতে হবে । আত্মবিশ্বাস যাদের কম তাদের না বলতে শেখানো বাবা মায়ের দায়িত্ব। পজিটিভ প্যারেন্টিং দরকার। বাবা মায়ের উচিত হবে সন্তানের ছোট ছোট ভালো গুণগুলোর প্রশংসা করা। বাহবা দেওয়া। সন্তানকে না বলা শেখানোটা জরুরি। অন্যের বাচ্চার সঙ্গে তুলনা করবেন না। এতে সন্তান হীনমন্যতায় ভুগে। পড়াশোনার পাশাপশি খেলাধুলা করা সাংস্কৃতিক চর্চার মধ্যে থাকা । বাবা মায়ের সঙ্গে সন্তানের সম্পর্কটা এমন থাকবে যেন সন্তান তার মনের সব কথা খুলে বলতে পারে।’