শিক্ষকতা যার নেশা

মদনপুর আলোর পাঠশালার প্রধান শিক্ষক বই তুলে দিচ্ছেন এক শিক্ষার্থীকে।

‘ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার মদনপুর ইউনিয়নের আশপাশেও কোন হাইস্কুল নাই। প্রাইমারি স্কুল পাস করার পর পড়াতে পারি না। তাই মেয়ে স্কুল গিয়ে কি করবে?’ কিছুদিন থেকে স্কুলে না যাওয়ায় বাড়িতে খোঁজ করতে আসা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের একজনকে শিক্ষককে আক্ষেপের স্বরে কথাগুলো বলছিলেন একজন অভিভাবক। কথাগুলো পাশে থেকে শুনছিলেন ভোলার সদর উপজেলার পরানগঞ্জ গ্রামের আক্তার হোসেন নামে এক যুবক। মাস্টার্স পাস করার পর তিনি ওই এলাকায় একটি বেসরকারি সংস্থার স্যানিটেশন নিয়ে প্রোজেক্ট ভিত্তিক কাজ করতেন। সেই সুবাদে সেই প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের সঙ্গে পরিচয়। ওই শিক্ষার্থীর মায়ের কথাগুলো বুকে গিয়ে বিধে তাঁর। সেই থেকে উদ্যোগ নেন ওই প্রত্যন্ত এলাকায় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার।

মেঘনা নদীর চরে অবস্থিত এ রকম গ্রাম ও আশপাশের কয়েকটি গ্রাম জুড়ে মাত্র তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও ছিল না কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয়। তাই প্রাথমিক পাস করার শিক্ষার্থীদের আর পড়াশোনা হতো না। ছেলেরা কর্মে যুক্ত হতো আর মেয়েরা হতো বাল্যবিয়ের শিকার। ঘটনাটি প্রায় এক যুগ আগের।

আক্তার হোসেন সেই এলাকার শিক্ষার্থীদের এগিয়ে নিতে স্থানীয় গণ্যমান্য, শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি ও ইউপি চেয়ারম্যানের সহযোগিতা চান। ইউপি চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ের একটি কক্ষ পান পাঠদানের জন্য। পাঁচ সেট বেঞ্চ, পাঁচটি চেয়ার ও ব্ল্যাকবোর্ডের ব্যবস্থা ছিল। সেই থেকে বিদ্যালয় শুরু। আক্তার হোসেন সঙ্গে আরও চারজন শিক্ষককে নিয়ে শুরু করেন বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। তাঁদের মধ্যে দুজনের বাসা বিদ্যালয়ের আশেপাশে। আক্তার হোসেন বিদ্যালয়ে যাতায়াত করেন প্রায় ২০ কিলোমিটার দূর থেকে। এভাবে নানা প্রতিকূলতা পাড়ি দিয়ে চলে শিক্ষার আলো ছড়ানোর কাজ।

পরবর্তীতে মেঘনা নদীর চরে মদনপুর ইউনিয়নের চরটবগী গ্রামে সরকার থেকে একটি সাইক্লোন শেল্টার করে দেওয়া হয়। সেই ভবনে স্কুল হয়। যা পরবর্তীতে পরিচালনার দায়িত্ব নেয় প্রথম আলো ট্রাস্ট। স্কুলটির নাম হয় মদনপুর আলোর পাঠশালা। এই স্কুলের প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন আক্তার হোসেন। বর্তমানে এ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাস করে শিক্ষার্থীরা কলেজেও পড়াশোনা করছে।

মদনপুর আলোর পাঠশালার প্রধান শিক্ষক আক্তার হোসেন।

মদনপুর আলোর পাঠশালা থেকে এসএসসি পাস করে কলেজে পড়াশোনা করছেন নুপুর আক্তার তাঁর বাবা চরপদ্মা গ্রামের গ্রাম পুলিশ মো. নাসির (৪২) বলেন, ‘এ স্কুলটার জন্যই আমার মেয়েটা কলেজে পড়ছে। আমার ছেলে মো. হাসনাইল অষ্টম শ্রেণিতে ও এক মেয়ে হাপসা বেগম ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। সবাই বিনা পয়সায় পড়াশোনা করছে। আর এসব হয়েছে এ বিদ্যালয়ের জন্য। শিক্ষকদের জন্য। হেড স্যারতো প্রায় ফোন দিত ছেলে-মেয়েরা স্কুলে অনুপস্থিত থাকলে । তাঁদের জন্যই আজ আমাদের সন্তান উচ্চ মাধ্যমিকে পড়াশোনা করতে পারছে।’

এ বিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী কলেজছাত্র মো. ইব্রাহিম ও ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী মোসা. সুমাইয়ার বড় ভাই মাঝের চর গ্রামের আবুল হাসেম বলেন, ‘আমাদের সময় এখানে কোন মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল না। এ জন্য আমরা প্রাইমারি পাস করে আর পড়াশোনা করতে পারিনি। কিন্তু আক্তার স্যারের মত মানুষদের উদ্যোগে এখানে মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। এ জন্য আমাদের ভাই-বোনসহ শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক শ্রেণিতে পড়াশোনা করতে পারছে বিনা পয়সায়। পড়ছে কলেজেও। এতে আমাদের সমাজের উন্নতি হচ্ছে। শিক্ষার মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এ জন্য আমরা এ স্কুল, স্যার ও প্রথম আলো ট্রাস্টের কাছে কৃতজ্ঞ।’