বন্ধু থেকে আলোর পাঠশালার শিক্ষক

শিক্ষার্থীদের ল্যাবে ক্লাশ নিচ্ছেন প্রধান শিক্ষক আলী উজ্জামান নূর।

২০১০ সালে ছিলেন প্রথম আলো বন্ধুসভার সদস্য। একদিন বন্ধুদের সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী (পিইসি) পরীক্ষার্থীদের বিদায় সংবর্ধনা জানাতে যান বাবুডাইং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। ভটভটিযোগে প্রায় ১০ কিলোমিটার যাওয়ার পর আরও প্রায় চার কিলোমিটার বরেন্দ্র এলাকার উঁচু-নিচু, পাহাড়ি ও জমির আইল পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছান বিদ্যালয়ে। সেখানে ছিল আলোচনা সভা। অনেকটা আবেগঘন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে বিদায়ী শিক্ষার্থীদের মাঝে বন্ধুসভার সদস্যদের নিয়ে আসা পরীক্ষা উপকরণ ও ফুল দিয়ে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। পরে অনুষ্ঠিত হয় ঐতিহ্যবাহী কোল ক্ষুদ্র জাতিসত্তার শিক্ষার্থীদের নাচ-গান।

জানতে পারেন সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের শিক্ষায় পিছিয়ে পড়ে থাকার গল্প। আরও কয়েকবার সেই জনপদের মানুষের মাঝে শীতবস্ত্রসহ নানা সাহায্য উপকরণ নিয়ে বন্ধুসভার বন্ধুদের সঙ্গে হাজির হন তিনি। বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে যেতেন পাঠদান করাতে। সেই থেকে শুরু। ২০১৬ সালে সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়টি মাধ্যমিক শ্রেণিতে পাঠদান শুরু করে। নাম হয় বাবুডাইং আলোর পাঠশালা। যা পরিচালিত হয় প্রথম আলো ট্রাস্টের মাধ্যমে। সেখানে নিয়োগ পান সহকারী শিক্ষক হিসেবে। সহকারী শিক্ষক থেকে সহকারী প্রধান শিক্ষক হন। ২০১৯ সাল থেকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব পালন করছেন আলী উজ্জামান নূর।

শিক্ষার্থীদের নতুন বই বিতরণ করছেন প্রধান শিক্ষক আলী উজ্জামান নূর।

আলী উজ্জামান নূর নবাবগঞ্জ সরকারি কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর পাস করে বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। পাশাপাশি চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম আলো বন্ধুসভার সাবেক সভাপতি। স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে রোভার স্কাউট ও রেড ক্রিসেন্ট-এ কাজ করেছেন । প্রতিদিন প্রায় ২৯ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে তিনি বিদ্যালয়ে যাতায়াত করেন। সবার কাছে তিনি কিরণ স্যার নামেই পরিচিত।

প্রথম আলো ট্রাস্ট পরিচালিত এই বিদ্যালয় থেকে গত দুই বছরে ১৩জন শিক্ষার্থী এসএসসি পরীক্ষা পাস করেছে। তারা এখন পড়াশোনা করছে কলেজে। শুরু থেকেই এ বিদ্যালয় থেকে পিইসি, জেএসসি ও এসএসসি পরীক্ষায় শত ভাগ পাস করে আসছে শিক্ষার্থীরা। পরিবর্তন হয়েছে বিদ্যালয়ের নানা কাঠামো ও আঙ্গিণা। প্রতিবছর বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির মধ্য দিয়ে হয়েছে সবুজায়ন। বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে রয়েছে নানা ধরণের ওষুধি ও ফুল-ফলের গাছ। এসব দেখে মনটা আনন্দে ভরে ওঠে।

প্রধান শিক্ষক আলী উজ্জামান নূর।

কথা হয় নবম শ্রেণির ছাত্রী মাহফুজা খাতুনের মা জামিলা বেগম, লিপি খাতুনের মা মোসা. দুলালী ও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী রুমেশা খাতুনের মা সাকেরা বেগমের সঙ্গে। তাঁরা বলেন, ‘হামরা গরিব মানুষ। ছ্যালাপিল্যাকে বেশি পড়াইতে পারি না। বিশেষ কইর‌্যা হামারঘে বেটিরা একটু গায়ে-গতরে বড় হোইলেই বিহ্যা দিয়্যা দিই। কিন্তু এখন ওরা কেহু বিহ্যা করতে চাহে না। কহে, এসএসসি পাস করার আগে বিহ্যার কথা কহবিন্যা। আর হামি যদি তোরঘে ঘরে বোঝা হয়্যা যায়, তবে কহা, কিরণ স্যারের বাড়ি চইল্যা যাবো। কিন্তু বাল্যবিহ্যা করবো না। জোর কইর‌্যা বিহ্যা দিলে স্যারকে কহ্যা তোরাকে পুলিশে দিব। বেটিরঘে মুখে এমন কথা শুইন্যা মনটা ভইর‌্যা যায়। মনে মনে কহি, আর যাইহোক, হামারঘে ছ্যালাপিল্যারাতো আগাইছে।’

গ্রামের মোড়ল কার্তিক কোল টুডু ও মাধব কোল সরেন বলেন, ‘করোনাকালে সবজাগার স্কুল বন্ধ থাকলেও এ স্কুলের মাস্টাররা বাড়িতে আইসাও পড়াইছে। আর সব মাস্টাররা আগিয়্যা অ্যাসাছে হেড মাস্টারের ল্যাগা। এ হেড মাস্টার ম্যালা কাজ কর‌্যাছে। এছাড়া হামারঘে যে কুনু সমস্যাতেও হামারঘে মাস্টাররা সাহায্য করে। হামরাকে ভালোবাসে।

হরেন কোল মুর্মু বলেন, হামরা বাড়ির পুরুষ-মহিলা সবাই কাজ কইর‌্যা খাই। ছ্যালাপিলারঘে তেমন খোঁজ লিতে পারি না। কিন্তু কিরণ মাস্টারকে দেখি, কুনু ছ্যালাপিল্যা যদি একদিন বা দুদিন যদি স্কুলে না যায়, তোবে সে বাড়িতে খুঁজতে আসে। বাড়িতে ছ্যালাপিল্যাকে পাইলে ধইর‌্যা স্কুলে লিয়া যায়। যদি বেড়াইতে গিয়্যা কয়েকদিন না আসে, তাও কিরণ স্যার বাড়িতে আইস্যা হামারঘে সোথে ঝগড়া করে। কেনে ওরাকে স্কুল বাদ দিয়্যা বেড়াইতে পাঠাইছি এ লিয়্যা বকাঝকা করে। এরফলে হামরা আরও সচেতন হয়্যাছি। হামারঘে ছ্যালাপিলারাও স্কুল বাদ দিয়্যা কাজ করতে বা বেড়াইতে যাইতে চাহে না। ফলে ওরাও পড়ালেখাতে আগাইছে।’