একজন দক্ষ শিক্ষক হতে চান ইমরান

মো. ইমরান

নদীবেষ্টিত ও প্রবল স্রোতের মুখে নতুন জেগে ওঠা একটি এলাকা ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার ১ নং ইউনিয়ন। এই চরে বেড়ে উঠেছেন মো. ইমরান । মদনপুর আলোর পাঠশালা থেকে পাস করেন। বর্তমানে ভোলা সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছেন। পুরো চরের মধ্যে ইমরানই প্রথম যিনি স্নাতক পর্যায়ে পড়াশোনা করছেন।

ইমরানের বাবা মো. রফিক । পেশায় একজন ভূমিহীন কৃষক, যিনি একসময় মাছ ধরতেন। মা শাহানুর বেগম একজন গৃহিণী। ইমরান যখন পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায় অংশ নেন তখন তাঁর বাবা আর পড়াশোনা না করানোর সিদ্ধান্ত নেন। কারণ ৮ ছেলে মেয়ের মধ্যে ইমরান সবার ছোট। তা ছাড়া চরে কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল না তখন। পরে ২০১৪ সালে প্রথম আলো ট্রাস্ট পরিচালনায় মদনপুর আলোর পাঠশালা নামে একটি বিদ্যালয় স্থাপিত হয়।

বেশ কয়েক বছর আগের কথা, মদনপুর আলোর পাঠশালার সহকারী শিক্ষক আলী আজগর বাড়ি ফেরার পথে দেখেন ইমরানসহ আরও কয়েকজন সয়াবিন খেতে কাজ করছে। স্কুলে না গিয়ে কেন সেখানে কাজ করছে জানতে চাইলেন তারা বলে, ‘স্যার আমরা গরিব মানুষ। আমাগো বাবা মা আমাগোরে আর পড়াইবো না। হেরা কয় সমাপনী পরীক্ষার পরে আর পড়ালেহা করা লাগে না।’

এ কথাগুলো শোনার পর সহকারী শিক্ষক আলী আজগর তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের জানান, পড়াশোনার খরচের জন্য আপনাকে চিন্তা করতে হবে না। কারণ, আমাদের বিদ্যালয়টি প্রথম আলো ট্রাস্ট পরিচালিত মদনপুর আলোর পাঠশালা। যেখানে সরকারিভাবে বিনা মূল্যে বই প্রদান ছাড়াও শিক্ষার্থীদের বিনা মূল্যে পড়াশোনা করানো হয়। বিনা মূল্যে শিক্ষা উপকরণ, শীতবস্ত্র, বিভিন্ন দুর্যোগকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের আর্থিক সাহায্য প্রদান, বিনা মূল্যে স্কুল ড্রেস বিতরণসহ বিভিন্ন কাজে শিক্ষার্থীদের সাহায্য করে থাকে। যা আপনার সন্তানের পড়াশোনা চালিয়ে যেতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।’

একই সঙ্গে ইমরানের বাবাকে বলেন, ‘আপনি ইমরানকে সঙ্গে নিয়ে আমাদের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন, এতে ইমরান অনেক উৎসাহিত হবে। ওর বাকি দায়িত্ব আমরা নিব।’ এসব কথা শোনার পর রফিক মাঝি ওনার সন্তানকে স্কুলে পাঠাতে রাজি হন এবং ভর্তি করিয়ে দেন। এরই ধারাবাহিকতায় ইমরান ষষ্ঠ ও ৭ম শ্রেণির বার্ষিক পরীক্ষায় সর্বোচ্চ ফলাফল অর্জন করেন। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত মদনপুর আলোর পাঠশালা থেকে জেএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে ভালো ফলাফল অর্জন করেন। পরবর্তীতে একইভাবে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে বর্তমানে ভোলা সরকারি কলেজে ইংরেজি বিভাগের প্রথম বর্ষে পড়াশোনা করছেন।

মদনপুর আলোর পাঠশালার সহকারী শিক্ষক মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘ইমরান ইংরেজি বিভাগে পড়াশোনা করেন তাই এলাকায় সবাই তাঁকে আলাদাভাবে মূল্যায়ন করে। ইমরান নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি এলাকার অন্যান্য শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেন এবং ভোলা শহরে স্থানীয় একটু কিন্ডারগার্টেনে পাঠদান করেন। যা তাঁর নিজের এবং অন্য ভাইবোনকে পড়াশোনা করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।’

ইমরান নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি বিদ্যালয়ে এসে শিক্ষার্থীদের করোনাকালীন স্বাস্থ্য সচেতনতা তৈরি, বয়:সন্ধিকালীন করণীয়, মাদকের কুফল, বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিক ইত্যাদি বিষয়ে ব্যাপক ভূমিকা পালন করছেন । তাঁর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সফলতা হলো, তিনি নিজে স্থানীয় মানুষদের সহায়তায় চারটি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করেছেনি। ইমরানকে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা জানতে চাইলে বলেন, ‘আমার এই অনগ্রসর এলাকাকে এগিয়ে নিতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নাই। তাই বিএ এবং এমএ শেষ করে একজন দক্ষ শিক্ষক হতে চাই।’