‘দিনমজুরের কাজ করে পড়ালেখা চালিয়েছি’
গ্রাম থেকে অনেক দূরের একটি স্কুলে পড়তে যেতে হতো গ্রামের শিক্ষার্থীদের। ফলে শিক্ষার্থীদের নানা সমস্যার পড়ালেখা বন্ধ হতে বসেছিল। বিষয়টি লক্ষ্য করে গ্রামের শিক্ষানুরাগী ব্যক্তিদের উদ্যোগে একটি মাধ্যমিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। জেলা ও উপজেলা সদর থেকে দূরের গ্রাম নওগাঁর গুড়িহারি। এখানে ছিল না কোন মাধ্যমিক স্কুল। পরে প্রথম আলো ট্রাস্ট গুড়িহারি-কামদেবপুর আলোর পাঠশালা প্রতিষ্ঠা করলে রাজিত দাস সেখানে যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি সহকারী প্রধান শিক্ষার দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এই গ্রামেরই সন্তান। পাঁচ ভাইবোনের মধ্য সবার ছোট রাজিত বেড়ে ওঠেন অভাবের মধ্য দিয়েই। তাঁর বাবা-মায়ের স্বপ্ন ছিল ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা শেখানোর। কিন্তু অভাবের তাড়নায় এক এক করে চারটি সন্তানই প্রাথমিকের গণ্ডি পেরোতে পারেনি। তখন তাঁর মা জেদ ধরে বসেন, ‘যত কষ্টই হোক ছোট ছেলেকে পড়াতেই হবে।’
রাজিতদের সংসারে একজনের উপার্জনে ৮ জনের ভরণপোষণ। প্রায় নাভিশ্বাস হয়ে ওঠার অবস্থা। তা ছাড়া সারা বছর জমিতে কাজ না থাকায় অনাহারে অর্ধাহারে দিন কাটে তাঁদের। এত কষ্টের মধ্যে দিয়েও পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন রাজিত। মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফলাফল করেন। এ সম্পর্কে রাজিত দাস বলেন, ‘আমার মাধ্যমিকের রেজাল্ট দেখে সবাই খুব খুশি হয়েছিল। আমার বাবাও খুশি হয়েছিলেন। এর কিছুদিন পর বাবা আমাকে ডেকে বললেন, দেখ বাবা, আমি অনেক কষ্ট করে তোর পড়ালেখার খরচ চালিয়েছি। কিন্তু কলেজে অনেক খরচ। তারপর আবার সাইন্সের সাবজেক্ট প্রাইভেট পড়া লাগবে। পড়ানোর ইচ্ছা থাকলেও এত টাকা জোগাড় করা আমার পক্ষে সম্ভব হবে না। তুই যদি পড়ার খরচ চালাতে পারিস তাহলে পড়। আমি বারণ করব না।’
তারপর থেকে আমিও বাবার সঙ্গে দিনমজুরের কাজ করে, টিউশনি করে পড়ালেখা চালিয়ে এসেছি। এতে আমার পরিবারের সকলে আমাকে অনেক সাপোর্ট করেছেন। বিশেষ করে আমার মা- জনালেন রাজিত।
এভাবে তিনি অনেকটা নিজের আগ্রহে রাজশাহী কলেজ থেকে প্রাণিবিদ্যা বিভাগে এমএসসি ডিগ্রি অর্জন করেন। পড়ালেখা চলাকালীন সময়ে তিনি উত্তরবঙ্গ শিশু উন্নয়ন প্রকল্পে প্রায় চার বছর শিক্ষকতা করেন। শিক্ষকতা পেশাকে তিনি খুব উপভোগ করেন। কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ায় জীবিকার তাগিদে ঢাকায় চলে যান। সেখানে প্রায় এক বছর থাকার পরে এক বড় ভাইয়ের পরামর্শে আলোর পাঠশালায় সহকারী শিক্ষক হিসাবে কাজ শুরু করেন। তারপর বিদ্যালয় কতৃপক্ষ তাঁকে সহকারী প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব প্রদান করেন। নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি তাঁর দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বিদ্যালয়ের যেকোন উন্নয়নমূলক কাজে তিনি মূখ্য ভূমিকা পালন করেন। পাঠদান, একাডেমিক কার্যক্রম দেখাশোনার পাশাপাশি এলাকার বাল্যবিয়ে বন্ধসহ সমাজের উন্নয়নমূলক কাজে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন তিনি।