মেঘনার উত্তাল ঢেউ পেরিয়ে আলোর পাঠশালা দর্শন

মদনপুর আলোর পাঠশালা শিক্ষার্থীরা।

ভোলা জেলার নাসির মাঝি ঘাট থেকে প্রতিদিন সকাল আটটায় একটি নৌকা ছাড়ে। মাঝারি আকারের ইঞ্জিনচালিত নৌকাটির গন্তব্য চর মদনপুর ইউনিয়ন। সম্প্রতি সেই নৌকার যাত্রী হয়ে ইউনিয়নটির একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয় মদনপুর আলোর পাঠশালা ঘুরে দেখার সুযোগ হয়েছে। নৌকার সহযাত্রী আব্দুছ ছালাম কথা প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখানে প্রতিটি দিন সংগ্রামের। চরবাসী একপ্রকার জীবন হাতে নিয়ে প্রতিদিন নৌপথে চরে যাতায়ত করেন।’ তাঁর কথার সত্যতা পাওয়া গেল মাঝনদীতে এসে। মেঘনার উত্তাল ঢেউয়ে ইঞ্জিন নৌকা প্রায় ডুবে যাওয়ার জোগাড়। পাঠশালাটির পাঁচজন শিক্ষকও প্রতিদিন ভোলা সদর থেকে চর মদনপুরে যাতায়ত করেন। তাঁদের একজন মদনপুর আলোর পাঠশালার সহকারী শিক্ষক আলী আজগর বলেন, ‘মেঘনার পানি জোয়ার–ভাটা অনুসরণ করে বাড়ে–কমে। জোয়ারের সময় উত্তাল ঢেউয়ে নৌকা টলমল করে। আবার ভাটার সময় ডুবোচরে নৌকা আটকে যায়। তখন হাঁটু থেকে কোমড় পানি ডিঙিয়ে স্কুলে যাতায়ত করতে হয়।’

নতুন বই পেয়ে উচ্ছ্বসিত মদনপুর আলোর পাঠশালার শিক্ষার্থীরা।

প্রায় চল্লিশ মিনিটের নৌযাত্রা শেষে দেখা মিলল চর মদনপুরের। মেঘনা নদীর মাঝখানে মদনপুর চরের অবস্থান। চরের চারপাশজুড়ে ফসলের খেত। বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো কিছু ঘরবাড়ি চোখে পড়ে। চরবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মদনপুর ইউনিয়নটি ভোলা জেলার দৌলতখান উপজেলার অংশ। মদনপুর ইউনিয়টি দুবার মেঘনায় বিলীন হয়েছে। ১৯৯১-৯২ সালের দিকে শেষ মদনপুর চর জেগে ওঠে। এলাকাবাসী জানান, ২০০১-০২ সালে কোমড়সমান কাদা ভেঙে মানুষ চরে বসতি স্থাপন শুরু করে। প্রথম দিকে মহিষের বাথান ছাড়া কিছুই ছিল না। এরপরের শীতে এক ফসলের আবাদ। তারপর দুই ফসল। বড় বড় ইঁদুর। ফসল খেয়ে ফেলে। তারই মধ্যে আবাদ। মাটি ফেলে উঁচু করে টংঘর বাঁধা শুরু হয়। সুপারির খুঁটিতে টংয়ের ঘর। নিচে গবাদিপশুর বাস। ওপরে মানুষ। রাস্তা নেই, ঘাট নেই, গভীর নলকূপ নেই। আছে শুধু মানুষ। আলপথ ধরে হাঁটা মানুষ। ২০০৭ সালের দিকে মদনপুর চরে ঘর বাঁধা পরিবারের সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় দুই হাজারে। এসব পরিবারের শিশুদের পড়ার কোনো বিদ্যালয় ছিল না। একটি মক্তব ছিল আর নামাজ পড়ার জন্য একটি মসজিদ বানান গ্রামবাসী। বসান হাট। ২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর ঘূর্ণিঝড় সিডর আঘাত হানে। আবারও ছিন্নভিন্ন হয় মদনপুর চরের সদ্য সাজানো সংসার।

পরবর্তী সময়ে গ্রামবাসী মসজিদটিকে কোনোমতে দাঁড় করালেও মক্তবটিকে আর দাঁড় করাতে পারেননি। মসজিদেই চলত মক্তব। প্রথম আলো ট্রাস্ট ২০০৭ সালে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় বানানোর শর্তে আর্থিক অনুদান প্রদান করে। ওই অনুদানের সঙ্গে গ্রামবাসী অনুদান যুক্ত করে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। সেই বিদ্যালয় বর্তমানে তিনতলা ভবনে দৃশ্যমান। ‘মকবুল আহমেদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে চরে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে।

বার্ষিক ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা শেষে মদনপুর পাঠশালার পুরস্কার বিজয়ী শিক্ষার্থীরা।

স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মদনপুর ইউনিয়নে বর্তমানে প্রায় ১২ হাজার লোকের বাস। ইউনিয়নটিতে তিনটি প্রাথমিক বিদ্যালয় থাকলেও কোনো মাধ্যমিক বিদ্যালয় ছিল না। ফলে চরে বসবাসকারী ছেলেমেয়েরা মাধ্যমিক শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছিল। অনেকের আগ্রহ থাকলেও দারিদ্র্যের কারণে দৌলতখান উপজেলা কিংবা ভোলা সদরের কোনো মাধ্যমিক প্রতিষ্ঠানে পড়তে পারছিল না শিক্ষার্থীরা। পরবর্তী সময়ে প্রথম আলোর ভোলা প্রতিনিধি নেয়ামতউল্যাহ ও স্থানীয় মানুষের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় প্রথম আলো ট্রাস্ট ২০১৫ সালে ‘মদনপুর আলোর পাঠশালা’ প্রতিষ্ঠা করে। বর্তমানে মদনপুর আলোর পাঠশালা ইউনিয়নটির একমাত্র মাধ্যমিক বিদ্যালয়। চরের মধ্যে একটি সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে। সেই সাইক্লোন শেল্টারে মদনপুর আলোর পাঠশালা অবস্থিত। সাইক্লোন শেল্টারে পৌঁছে দেখা গেল, তিনতলা ভবনটির প্রথম ও দ্বিতীয় তলাজুড়ে আলোর পাঠশালা অবস্থিত। স্কুলের সামনে একটি ছোট মাঠ রয়েছে। সামিটি গ্রুপ ও আঞ্জুমান–আজিজ চ্যারিটেবল ট্রাস্টের অর্থায়নে প্রথম আলো ট্রাস্ট পরিচালিত বিদ্যালয়টির বর্তমান ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১১৮।

বর্তমানে ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত বিদ্যালয়টিতে পাঠদান চলমান। পাঠশালাটিতে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি। ছেলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা তুলনামূলক কম। বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষক আক্তার হোসের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ইউনিয়নের প্রায় প্রতি বাড়িতেই স্কুলে পড়ার মতো ছেলেমেয়ে আছে। সবাই হেঁটে হেঁটে, খেয়া পাড়ি দিয়ে স্কুলে আসে। যখন জোয়ারের পানি বেড়ে যায়, কেউ কেউ স্কুলে আসতে পারে না। আবার ঝড়–বৃষ্টির সময় নদীতে স্রোত বাড়ে৷ তখন অনেক শিক্ষার্থীই স্কুলে আসে না। আর্থিক প্রয়োজনে পরিবারের ছেলে সন্তানেরা মাছ ধরার কাজে ছোটবেলা থেকেই যুক্ত থাকে। ফলে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র্যের কারণে ছেলে শিক্ষার্থীরা মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়ালেখা শেষ করতে পারছে না।