কানাই চন্দ্র দাস একজন সাদা মনের মানুষ

বাবুডাইং আলোর পাঠশালার অবসরপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক কানাই চন্দ্র দাস শিক্ষার্থীদের শপথ বাক্য পাঠ করানোর সময়।

সপ্তাহে তিন থেকে চারদিন বরেন্দ্রভূমির উঁচু-নিচু শক্ত পথ পেরিয়ে একটি বাইসাইকেলে চড়ে আসতেন কানাই চন্দ্র দাস। শহর থেকে এসে গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা দিতেন। চিকিৎসা দিতে এসে এলাকার সুবিধাবঞ্চিত, শিক্ষাবঞ্চিত শিশুদের দেখে তাঁর মায়া হয়। একদিন চন্দনি নামে ১০ বছর বয়সী এক শিশু বলেই ফেলে, ‘ডাক্তার মশাই আপনিতো লেখাপড়া জানেন। আমাদের পড়াবেন?’ প্রশ্নটা বুকে গিয়ে বিধে তাঁর। ওইদিনই তিনি গ্রামের একটি বাড়ির উঠানে পাটি বিছিয়ে বসে পড়েন আট-দশজন ছেলেমেয়ে নিয়ে। পরের দিন কিছু শ্লেট, বর্ণমালার বই ও চক নিয়ে আবারও হাজির হন তিনি। এভাবে গ্রামের শিশুদের বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকেন। বেশ কিছুদিন যেতে না যেতেই শিক্ষার্থী সংখ্যা বাড়তে থাকে কানাই চন্দ্র দাসের। শিশুরাও আনন্দমুখর পরিবেশ ও ভালোবাসা পেয়ে নিয়মিত আসতে থাকে। এভাবে শিখতে থাকে বর্ণ, সংখ্যা, নামতা, যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগ। লিখতে শিখে নিজেদের নাম, পরিচয়।

সময়টা ২০০৭ সাল। চারপাশে উঁচু টিলা ঘেরা বরেন্দ্রভূমির গহিনে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার কোল সম্প্রদায়ের মানুষদের গ্রাম বাবুডাইং। ওইসময় গ্রামের দুই-একজন প্রান্তিক চাষি ছাড়া প্রায় ৭৫টি পরিবারের সকলেই ছিল ক্ষেতমজুর। গ্রামে ছিল দুইশত জন শিশু। তারা কেউ স্কুলে গিয়ে লেখাপড়া করত না। স্কুল শব্দটার সঙ্গে তাদের কোন পরিচয় ছিল না। গ্রামে ছিল না কোন টয়লেট। তাই অসুখ-বিসুখ সবসময় লেগেই থাকত। আর তাঁদের অসুখ-বিসুখ হলে একমাত্র ভরসা ছিলেন পল্লী চিকিৎসক কানাই চন্দ্র দাস। চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক আনোয়ার হোসেন দিলু বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। পত্রিকায় প্রতিবেদনটি পড়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ঢাকার এক শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য কিছু আর্থিক সাহায্য দিয়ে যান। ওই অর্থ দিয়ে ২০০৭ সালে খাস জমিতে গড়ে তোলা হয় বাবুডাইং প্রাথমিক বিদ্যালয়। ২০০৯ সালে প্রথম আলো ট্রাস্টের সহায়তায় মাটির দেয়ালের ওপর ঢেউটিনের ছাউনির একটি শ্রেণিকক্ষ তৈরি হয়। ২০১৩ সালের এপ্রিল মাস থেকে বিদ্যালয় পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব নেয় প্রথম আলো ট্রাস্ট। নামকরণ করা হয় বাবুডাইং আলোর পাঠশালা। এরপর থেকে ট্রাস্টের সহায়তায় চলছে শিক্ষকের বেতন ও বিদ্যালয় পরিচালনার আনুষঙ্গিক খরচ। এতে সামিট গ্রুপ সহায়তা করছে। বাবুডাইং আলোর পাঠশালার প্রতিষ্ঠাতা প্রধান শিক্ষক কানাই চন্দ্র দাস। ২০১৯ সালের ৩১ অক্টোবর কানাই চন্দ্র দাস অবসর গ্রহণ করেন।

বাবুডাইং আলোর পাঠশালার বর্তমান প্রধান শিক্ষক আলী উজ্জামান নূর জানালেন, ’কানাই চন্দ্র দাস (৬৭) চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌর এলাকার উপররাজারামপুর তাঁতিপাড়ার মৃত কিশোর চন্দ্র দাসের ছেলে। তাঁর কাজের জন্য ২০০৮ সালে ইউনিলিভার বাংলাদেশে লিমিটেডের পক্ষ থেকে ‘সাদা মনের মানুষ’ ও রাজশাহীর রোটারী ক্লাব অব পদ্মা ও রোটারী ক্লাব অব মেট্রোপলিটন থেকে ‘ভোকেশনার অ্যাওয়ার্ড’ হিসেবে সম্মাননা দেয়া হয়। এছাড়াও প্রথম আলো বন্ধুসভা, চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা শাখা ও টিআইবি তাঁকে সম্মাননা দিয়েছে। দাম্পত্য জীবনে তাঁর দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রয়েছে। কয়েকবছর আগেই স্ত্রী বিগত হয়েছেন।’ প্রধান শিক্ষক আলী উজ্জামান নূর আরও জানালেন, ‘চাকরিজীবন থেকে অবসর নিলেও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁকে নিয়ে আসা হয় বিদ্যালয়ে। তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ, গ্রামবাসী ও শিক্ষার্থীরা। তাঁর ভালোবাসায় সিক্ত সকলে। তিনি এ জনপদের মানুষের হৃদয়ে ঠাঁই করে নিয়েছেন ।’

বাবুডাইং গ্রামের মোড়ল মাধব কোল টুডু কানাই চন্দ্র দাস সম্পর্কে বলেন, ‘কানাইদা না থাকলে হামারঘে ছ্যালাপিলারা আইজ কলেজে পড়তে পাইতো কি না ঠিক নাই। ওই ইসকুলে পইড়্যাই ছ্যালা-পিল্যারা কলেজে যাইতে পাইছে। কোনদিন এক কাপ চা খাইয়্যাও তিনি হামারঘে শিশুরাকে পড়াইছেন। তাঁর এ অবদান হামরা কুনুদিন ভুলবো না। ওর ল্যাইগা হামারঘে ভালোবাসা থাকবে চিরদিন।’

অন্য আরেকজন মোড়ল কার্তিক কোল টুডু বলেন, ‘কানাই বাবু আইসাই হামারঘে ছুটু ছুটু ছ্যালাপিল্যাকে পড়াইতে শুরু করে। বিনা টাকাতে পড়াইছে। নিজের টাকা দিয়্যা চক-সিলেট কিন্যা দিছে। এভাবেই একদিন এ ইসকুল হইয়্যাছে। এ ইসকুলে ওয়ান, টু থেকে আইজ টেন পরযন্ত পড়তে পাইছে হামারঘে ছ্যালারা। এটা কী কম বড় পাওয়া। কানাই বাবুর ভালোবাসার ল্যাগাই এ ইসকুল আগিয়্যা গেছে। তাঁর পতি হামরা কৃতজ্ঞ।’